ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ রেখে মে দিবস উদযাপনঃ মেহনতি শ্রমিক শ্রেণীর সাথে নির্মম রসিকতা!
মোঃ জানে আলম *
প্রায় সোয়া শ’ বছর পূবের্, আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে, প্রধানত আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা বিশ্রাম ও আট ঘন্টা বিনোদন এর অধিকারসহ শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মবলিদান করেছিল যে সকল শ্রমিক, তাদের স্মরণ করার মধ্যদিয়ে, সারা দুনিয়ার মেহনতি শ্রমিকদের সাথে বাংলাদেশের শ্রমিকদেরও আজ মহান মে দিবস উদ্যাপন করার কথা। কিন্তু ভাবতে আশ্চার্য লাগে, হে মার্কেটের সে ঘটনার পর সমাজ-সভ্যতা অনেক এগিয়েছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার আজ উন্নয়নের মাপকাঠিতে পরিণত হয়েছে, দেশে দেশে সে আট ঘন্টা কাজের অধিকারসহ অনেক মৌলিক অধিকার অর্জিত হয়েছে, অথচ আজও বাংলাদেশের মেহনতি শ্রমিকদের সে মৌলিক অধিকারটুকু ভুলুণ্ঠিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আজ আই,এল,ও নামক শ্রম সংস্থার সদস্য। সে আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩ টি কনভেনশন প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে ৮ টি কোর কনভেনশনসহ বাংলাদেশ ৩৩টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। সুতরাং বাংলাদেশ যে কোন শ্রম আইন প্রণয়ন আইএলও এর অনুসমর্থনকৃত কনভেনশন এর আলোকে করতে হবে। অথচ আমাদের দেশে সর্বশেষ প্রণীত “বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬” এ শ্রম ঘন্টা নির্ধারণ করা হয়েছে দৈনিক ন্যুনতম ৯ ঘন্টা, এবং ১০ ঘন্টার বেশি নয় যা অধুনা বিলুপ্ত আইনে ছিল ন্যুনতম ৮ ঘন্টা এবং ৯ ঘন্টার বেশি নয় । বস্তুতঃ আইনে যে বিধানই থাকুক না কেন, ন্যুনতম মজুরীর কারণে এখনো অনেক শিল্প-কারখানায় শ্রমিকেরা দৈনিক ১২ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হয়, অতিরিক্ত শ্রমের মজুরীর আশায়। গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে এটাত নিত্যদিনের ব্যাপার এবং অনেকটা বাধ্যতামুলক। তাছাড়া, গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত, বিগত ২৫ শে জানুয়ারী, ২০০৭ ইং হতে বাংলাদেশে সকল প্রকার ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের উপরই নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান। ফলতঃ মালিক বা কর্তৃপক্ষের যে কোন একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বাদ-প্রতিবাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ রহিত হয়েছে। পক্ষান্তরে শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থ-পরিপন্থী, বিশেষভাবে ছাটাই-চাকুরীচ্রুতি থেকে মালিক পক্ষকে বিরত রাখার কোন আইনী বিধান রাখা হয়নি। সে সুযোগে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর নেমে এসেছে কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের খড়গ্। বিশেষভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও ইপিজেডস্থ দেশী-বিদেশী কারখানাগুলোতে তার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এর অনুসমর্থনকৃত আইএলও এর ৮ টি কোর কনভেনশন এর মধ্যে আছে কনভেনশান নং ৮৭, যাতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং কনভেনশন নং ৯৮, যাতে যৌথ দরকষাকষির অধিকার প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ ইং সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনার ২৩(ঘ) ধারায়ও শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়। আইএলও এর যে সকল কনভেনশন তার কোন সদস্য রাষ্ট্র অনুসমর্থন করে, সে সকল কনভেনশণ মেনে চলা তার জন্য বাধ্যতামূলক। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত সে সকল অধিকার রহিত করা আছে, যা আইএলও কনভেনশন এর পরিপন্থী। স্মর্তব্য যে, ইপিজেড অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প-কারখানাগুলোতে ক্রমান্বয়ে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে ১৮ই জুলাই ২০০৪ সালে “ ইপিজেড শ্রমিক সংঘ ও শিল্প সম্পর্ক আইন ২০০৪” প্রণয়ন করা হয়েছিল। সে আইনের বিধান অনুসারে ইপিজেডস্থ প্রত্যেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের ভোটে নির্বাচিত হয় “শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব ও কল্যাণ কমিটি ”(ডজডঈ) । উক্ত আইনের বিধান অনুসারেই বিগত ১ লা নভেম্বর, ২০০৬ ইং থেকে ইপিজেড অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইপিজেডে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কর্তৃপক্ষ সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের উপরোক্ত আইন অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন থেকে বিরত থাকার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। এমনকি কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ চাকুরীর ভয় দেখিয়ে ইউনিয়ন করতে তারা ইচ্ছুক নয় মর্মে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় করেছিল। বর্তমান জরুরী অবস্থা জারীর পর ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ বিদ্যমান আইনের তোয়াক্কা না করে “শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব ও কল্যণ কমিটির” নির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে চাকুরী থেকে ছ্টাাই করে দিয়েছে। এভাক্ষেই “ইপিজেড শ্রমিক সংঘ ও শিল্প সম্পর্ক আইন ২০০৪” অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে শ্রমিক কর্মচারীরা মালিক পক্ষের বাঁধাহীন নির্যাতনের মুখে পড়েছে। আমাদের দীর্র্ঘদিনের অভিজ্ঞতা হল সে পাকিস্তান আমল হতে যখনি দেশে কোন সামরিক শাসন জারী হয়েছে, কিংবা কোন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, তখনি রাজনীতির সাথে সাথে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম। পরবর্তী সময়ে ঘরোয়া রাজনীতি, অতঃপর উম্মুক্ত রাজনীতি করার সুযোগ দিলেও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আর সহজে দেওয়া হত না। অনেক লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের সে অধিকার আদায় করতে হয়েছে বারংবার। কারণ বিষয়টি যতটুকু সরকারের অনুমতি বা বিদ্যমান আইনী ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল, ততোধিক নির্ভরশীল মালিক বা কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা বা আচরণের উপর। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব, এদেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা কেবল তাদের অর্থনৈতিক দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেনি, স্বাধীনতা সংগ্রাম হতে শুরু করে সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তারা অত্যন্ত নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের শ্রমিকশ্রেণীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। অথচ স্বাধীনতার পর দেশের সকল প্রকার পশ্চাৎপদতা ও বিপর্যয়ের সবচেয়ে করুন শিকার এদেশের মেহনতি শ্রমিকশ্রেণী। বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করা উচিত, কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের অবাধ লুঠপাট ও সীমাহীন দুর্নীতি এবং বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা, প্রশাসনসহ সবকিছু ধ্বংসের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে যে চুড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তার জন্য ্েট্রড ইউনিয়ন আন্দোলন কতটুকু দায়ী। এদেশের শ্রমিকেরা এখনো মাত্র ১৬৫৫.০০ টাকা ন্যূনতাম মজুরীর জন্য রাজপথে আন্দোলন করছে, শ্রম-শিবিরের মত অবরুদ্ধ কারখানায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে শ’য়ে শ’য়ে জীবন বলি দিচ্ছে, নির্দিষ্ট শ্রমঘন্টার বিপরীতে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় শারিরীক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, কথায় কথায় চাকুরীচ্যূত হচ্ছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠানে কোন ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হচ্ছেনা, ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা করলে নেমে আসে মালিকদের অমানষিক নির্যাতন, এমতাবস্থায় দেশে অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করে কেবল একতরফা মালিকদের স্বার্থই সংরক্ষিত হচ্ছে ।
যে সকল ট্রেড ইউনিয়ন বা সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে কিংবা দুর্নীতির দায়ে যারা ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের প্রায় সকলেই সরকারী মালিকাধীন ব্যাংক-বীমা, বিদ্যুত, টেলিফোন, গ্যাস ও ওয়াশা সহ বিভিন্ন সেবাখাতের ট্রেড ইউনিয়ন নেত্,া দৃর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমুহের কর্তৃপক্ষের কিছু দুর্নীতিপরায়ন আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এ দুর্নীতি করতে সক্ষম হয়েছে। এর বাহিরে দেশে বহু শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের একমাত্র বর্ম হিসাবে কাজ করে। এসব ব্যক্তিখাত ও বহুজাতিক কোম্পানীর মালিকানাধীন শিল্প ও বানিজ্য প্রতিষ্ঠানে সিবিএ সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করে থাকে। সে সকল প্রতিষ্ঠানের সিবিএ কিংবা ইউনিয়ন নেতাদের চাকুরী রক্ষা করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়, প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি করার কোন অবকাশ তাদের কোথায়? ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সিবিএ শিল্প-সম্পর্ক অধ্যাদেশের (যা বর্তমানে বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর অঙ্গীভূত হয়েছে) বিধান অনুসারে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য প্রান্তিক সুবিধাদি মালিকপক্ষের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা, অতঃপর আলোচনা শেষে একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারণ করে থাকে। তাছাড়া একটি উৎপাদনশীল কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা অবস্থায় দৈনন্দিন অনেক শিল্প-সম্পর্কজনিত সমস্যা উদ্ভূত হয়, যার সমাধানের ক্ষেত্রে সিবিএ অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে, যা কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সহায়কও বটে। কিন্ত ট্রেড ইউনিয়নের সকল প্রকার কার্যক্রম স্থগিত থাকার কারণে যেমন সিবিএ কিংবা বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রতিনিধি নির্বাচন করা যাচ্ছেনা, তেমনি কারখানায় সুষ্ঠু শিল্প-সম্পর্কও বিপন্ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠানের সিবিএ এবং বহু ট্রেড ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচনে সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। একইভাবে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সাথে স্ব স্ব সিবিএর সম্পাদিত চুক্তির । যারফলে দেশীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর মালিকানাধীন শিল্পকারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়োপযোগী করে নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছেনা। ফলতঃ এ দুর্মূল্যের বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ শ্রৃমিক-কর্মচারীরা।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে কাক্সিক্ষত সংস্কার ও শ্রম আইন সংশোধনঃ বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিগত ২০০৬ ইং সালের ১১ অক্টোবরে প্রণীত বাংলাদেশ শ্রম আইনÑ২০০৬ এর সংশোধনীর উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় থেকে তার একটি খসড়া ও প্রণয়ন করা হয়েছে। “বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬” এ যেখানে পূর্বে বিদ্যমান শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে আরো সংকুচিত করা হয়েছে এবং যাকে আরো শ্রমিক-বান্ধব করার দাবী ছিল শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্য থেকে, সেখানে সংশোধনীর খসড়ায় যে ধরনের প্রস্তাব আনা হয়েছে সেগুলো গৃহীত হলে দেশে আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বলে কিছু থাকবেনা। উক্ত প্রস্তাবিত খসড়ায় এমন সব বিধান আনা হচ্ছে, যে গুলো শুধু আইএলও এর কনভেনশন এর পরিপন্থী নহে, বরং রীতিমত নিবর্তনমূলক। আমারা স্বীকার করি বিগত দিনে দেশে বিদ্যমান রুগ্ণ রাজনীতির মত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও রুগ্ণ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল এর জন্য যতটুকু দায়ী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব ,ততোধিক দায়ী হল দেশের অসুস্থ রাজনীতি। কারণ আমাদের দেশের স্বার্থপর রাজনীতিকেরা নিজেদের দলীয় স্বার্থে ট্রেড ইউনিয়নকে ব্যবহার করেছে। তাদেরই পৃষ্টপোষকতায় জাতীয়ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনগুলো বস্তুত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হয়ে পড়েছিল। তারা যতটুকু না শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, ততোধিক উদ্বিগ্ন ছিল তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুঠায়। ফলত রাজনৈতিক স্বার্থের বলয় অতিক্রম করে এদেশে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও গড়ে ওঠতে পারেনি। তাতে শুধু শ্রমিক-কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, দেশে সুস্থ শিল্প-সম্পর্ক ও উৎপাদনশীলতাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ অবস্থা থেকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে মুক্ত করার সদিচ্ছা যদি সরকার পোষণ করেন, তাহলে সরকারের উচিত শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইনী সংশোধনী আনা। তা না করে “মাথা ব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলার” মত বিদ্যমান শ্রম আইনকে আরো কঠোর ও নিবর্তনমূলক করলে দেশে বস্তুত কোন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠবেনা। সংশ্লিষ্ট সকলের স্মরণ করা উচিত, স্ব স্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দিয়ে যে সকল গার্মেন্টস শিল্পের মালিকেরা তাদের মুনাফাকে নিরঙ্কুশ ঝুঁকিমুক্ত ভেবেছিল, গার্মেন্টস সেক্টরের সাম্প্রতিক নৈরাজ্যকর ঘটনা নিশ্চয় তাদের সে ভুল ভেঙ্গে দিয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টরে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে কারখানা পুড়িয়ে দেওয়ার মত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কখনো সৃষ্টি হতনা এবং এ জাতীয় ঘটনার প্রতিকার চেয়ে স্যুট-টাই পড়া মালিকদের রাজপথের ধুলায় গড়াগড়ি খেতে হতনা।
এটা আজ প্রমাণিত সত্য যে, ট্রেড ইউনিয়নের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রাখা সুস্থ শিল্প সম্পর্ক ও উৎপাদন ব্যবস্থার গতিশীলতার জন্য সুফল বয়ে আনবেনা। কারণ উৎপাদনশীল যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে শিল্প বিরোধের উদ্ভব একটি অবজেকটিব কন্ডিশান, আইন করে তাকে রোখা যাবে না, সমাজতাত্ত্বিকভাবে তার সমাধান করতে হবে, ট্র্রেড ইউনিয়ন যার একটি অনন্য হাতিয়ার। সংশ্লিষ্ট সকলের আরো স্মরণ রাখা উচিত ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনীতি এক বিষয় নয়। ট্র্ডে ইউনিয়ন কোন অবস্থাতেই দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে না, বরং আমাদের দেশের রুগ্ণ রাজনীতির ঔরসজাত সন্তান হল আজকের দুর্নীতিপরায়ন কতিপয় শ্রমিক নেতা । আমরা মনে করি, দেশে জরুরী অবস্থা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার মানুষের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণে সচেষ্ট। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের এখতিয়ারভূক্ত এবং তা মানবাধিকারও বটে।
অতএব, অনতিবিলম্বে ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত। আমরা আশা করি দেশের মেহনতি শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা রেখে, মহান মে দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, সরকার সহসা সে ঘোষণা দেবেন। তা না করে সরকারীভাবে মে দিবস উদ্যাপনের যে কোন উদ্যোগ এদেশের মেহনতি শ্রমিকদের প্রতি নিমর্ম রসিকতায় পর্যবর্ষিত হতে পারে।
মোঃ জানে আলম,
সভাপতি, ইস্টার্ন রিফাইনারী এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন(সিবিএ),
বাংলাদেশ অয়েল এ্যান্ড গ্যাস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন।
সহ-সভাপতি,
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ফেডারেশন।