মৃত্যুঞ্জয়ী সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকঃ ইতিহাসের এক ক্ষণজন্মা পুরুষ
মোঃ জানে আলম
পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে যে কিশোর সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক পূর্ববঙ্গে এসে ক্রীড়াঙ্গনে পদচারণা শুরু করেন, স্বপ্নীল যৌবনের নান্দনিক আবেগ তাকে ক্রমে টেনে নিয়ে যায় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে । কিন্তু কেবল সংস্কৃতির নন্দনতাত্ত্বিক চর্চা তাকে তৃপ্ত করতে পারেনি। তিনি ঠিকই উপলব্ধি করলেন, যে চিন্তা চেতনা ও মূল্যবোধ মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাড়িত করে, তার বিকাশ ঘটে জীবনঘনিষ্ঠ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে। তাই গণমানুষকে সচেতন, উদ্বুদ্ধ ও লড়াকু করতে হলে তার সাংস্কৃতিক চেতনাকে শাণিত করার কোন বিকল্প নেই। তিনি বুঝেছিলেন, গণমানুষের মুক্তির লড়াইয়ের যে রাজনীতি, তার সাথে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের এক সময়েরর সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক নিজকে রাজনীতি থেকে বেশি দিন দূরে রাখতে পারেন নি। খেলার মাঠ পেরিয়ে, সংস্কৃতি চর্চার আঙিনা মাড়িয়ে পরিণত বয়সে তিনি রাজনীতিতে হয়ে ওঠেছিলেন ইতিহাসের বরপুত্র; গ্রহণ করেছিলেন সর্বহারা মানুষের মুক্তির রাজনীতিকেÑজীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে। সে ব্রতে তিনি ছিলেন আমৃত্যু অবিচল ও নিরাপোষ। বিত্ত-বৈভব, যশ-খ্যাতি-ক্ষমতা এসবের কোন মোহই তাকে তার সুকঠিন ব্রত থেকে এতটুকু বিচ্যূত করতে পারেনি আমৃত্যু ।
সাইফু্িদ্দন আহমেদ মানিকের সাথে আমার পরিচয় ঘটে আশির দশকে। তখন তিনি একজন তুখোড় শ্রমিক নেতা। ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ নামে দেশের ছোট বড় ১৬ টি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বেরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। আমি তখন শাহ মোঃ আবু জাফর ও ফজলুল হক মন্টুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। ঐক্য পরিষদের বিভিন্ন সভাসমাবেশে মানিক ভাইয়ের সাথে পরিচয়, একই সভায় বক্তৃতা দেওয়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। তার সহজবোধ্য রসালো ও তেজোদীপ্ত বক্তৃতা উপস্থিত শ্রমিক-জনতাকে বিমোহিত ও উদ্বেলিত করে তুলত । অত্যন্ত কঠিন কথা হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপনের এক বিরলগুণের অধিকারী ছিলেন মানিক ভাই। মানবতাবোধের কী গভীর অভিঘাত থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, খ্যাতনামা জাতীয় ক্রিকেটার, সুপরিচিত সংস্কৃতি কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ছাত্র রাজনীতির অন্যতম দিক্পাল দেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, ন্যুব্জ¡দেহ-কুব্জ্যপৃষ্ঠ, অধিকার-বঞ্চিত মেহনতি শ্রমিকদের মাঝে প্রবেশ করতে পারে, তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে, তা ভাবতে আমরা অভিভূত না হয়ে পারিনা। সেখানেও তিনি ভুঁইফোড় ছিলেন না। একজন বদলী শ্রমিক হিসাবে ঢুকে বিপুল ভোটে তিনি ডেমরা পাটকল শ্রমিক ইউনিয়ন (সিবিএ) এর সভাপতি পদে নির্বাচিত হন।
তাঁর সাথে আমার এ পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠতে থাকে ১৯৯৩ সালে গণতান্ত্রিক ফোরাম নামে একটি নাগরিক উদ্যোগ চলাকালে । এ গণতান্ত্রিক ফোরাম যখন ঐ বছর ২৮ থেকে ৩০ সে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপী এক সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ফোরাম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন সে উদ্যোগের অন্যতম নেপথৈ নায়ক ছিলেন সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক। গণফোরাম নামক রাজনৈতিক দল গঠিত হওয়ার পর থেকেই মানিক ভাইকে নিকট থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়। একান্তে তার সাথে আমার অনেক আলাপ হয়েছে। কম্যূনিষ্ট পার্টির বিভাজন, সে আন্দোলন থেকে সরে এসে গণফোরামের মত একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠন, বাংলাদেশে বাম আন্দোলনের ভবিষ্যত ইত্যাকার বিষয় নিয়ে আমি সুযোগ পেলেই তার সাথে একান্তে আলাপ করতাম। তার বিশ্লেষনী ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। নিজের ভুল ভ্রান্ত্রি স্বীকারেও তিনি ছিলেন অকপট। মতাদর্শিক গোঁড়ামী তাকে আক্রান্ত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন মুক্তমনা। পরমত সহিষ্ণুতা ছিল তার অসাধারণ। গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির কোন কোন সভায় তিনি তীব্র সমালোচনার মুখোমুখী হতেন; কখনো কখনো কারো সমালোচনা ব্যক্তিগত পর্যায়েও চলে যেত। এমন পরিস্থিতিতেও মানিক ভাইকে উত্তেজিত হতে দেখেনি। তিনি শান্তভাবে তার বক্তব্য রেখে যেতেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম ৮ আসনে আমি ১১ দলের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার জন্য মানিক ভাই বেশ কিছৃ দিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে আমার একাধিক নির্বাচনী প্রচার সভায় অংশ নেন। যে সভাগুলোতে মানিক ভাই বক্তৃতা করতেন, সে সভাগুলো বড় বড় জনসভায় পরিণত হত। তার বক্তৃতার যে ধরণ, কখনো হাস্যরস, ব্যঙ্গবিদ্রুপ এবং পরক্ষণেই আবেগ-উত্তেজনা, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত তার বক্তৃতা শুণত। সভাশেষে অনেক মানুষ তাকে রীতিমত ঘিরে ধরত, নানা প্রশ্ন করত। অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে সহাস্যে তিনি কখনো রস, কখনো স্যাটায়ার করে তার জবাব দিতেন। আমার বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় তিনি একটি কথা প্রায়শঃ বলতেনÑবলতেন ক্ষোভ মিশ্রিত আক্ষেপের সাথে, বলতেন, রাজনীতির নামে দুর্নীতি করে যারা অঢেল টাকার মালিক হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য করেÑ “আপনাদের আর কত টাকা দরকার, ভাতের সাথেত আপনারা আর সোনা-দানা খান না, খানত আমাদের মতই মাছ মাংশ, অনেকেত তাও খেতে পারেন না, পেঁপেভাজি আর ডাল খেতে হয়”। কালো টাকার মালিকদের তিনি এভাবে আক্রমণ করতেন। অর্থবহ পরিবর্তন ছাড়া কেবল ক্ষমতার পালাবদল যে গণমানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবেনা সেটা বুঝাতে তিনি প্রায়শঃ উদাহরণ দিতেন ‘ উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়া’ বলে।
আজীবন সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করা, বিশেষভাবে কম্যূনিষ্ট পার্টির মত পার্টি থেকে এসে গণফোরাম এর মত একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি গড়ে তোলার কারণে অনেকেই হয়ত ধারণা করতেন, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক গণমানুষের শোষণমুক্তির রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। তাদের এ ধারণাটা আদৌ সঠিক ছিল না। বস্তুত বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বন্ধুর পথপরিক্রমায় সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক একজন কুশলী রণবীরের মত তার রণকৌশল পাল্টিয়েছেন কালের দাবীর সাথে সংবেদনশীল হয়ে। কারণ দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সিক্ত মানিক ডগমেটিজমের বিপরীতে একজন প্র্যাগমেটিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক পথ ও মতাদর্শ তাকে কখনো অন্ধ-গোঁড়া করতে পারে নি। পরিবর্তিত অবস্থার সাথে নিজের পথ ও মত পরিবর্তনের সৎ সাহস সাইফুদ্দিন মানিকের মত খুব কম রাজনীতিকের আছে। এখানেই একজন সত্যিকার মুক্তমনা মানুষ হিসাবে তার পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু নিপীড়িত মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির যে সুতীব্র আকাক্সক্ষা তিনি হৃদয়ে অনুক্ষণ লালন করতেন, তা থেকে তিনি কখনো বিচ্যূত হন নি। তাই সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক আমাদের অন্তহীন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। যারা এখনো এদেশে মেহনতি মানুষের মু্িক্তর রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি, সৎ মানুষের রাজনীতির ধব্জা উড্ডীন করে রাখতে চান, তাদের কাছে চিরঞ্জীব করে রাখবে। তাদের বারংবার ফিরে যেতে হবে তার স্মৃতির কাছে ,তাদের চেতনাকে শাণিত করতে, নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে। করাল মৃত্যু তাকে গ্রাস করতে পারেনি। তিনি মৃত্যুঞ্জয়, অমৃতের সন্তান।
(মোঃ জানে আলম)
গবেষণা, পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান বিষয়ক সম্পাদক
গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি