বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনঃ সংকটসংস্কার ও সম্ভাবনা

মোঃ জানে আলম

 

ভূমিকা

ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে সর্বাগ্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি বিকাশমান গণতন্ত্রে প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের তাদের স্ব স্ব অধিকার উপস্থাপন-আদায়-সংরক্ষণ করার জন্যÑ নিজস্ব সংগঠন থাকা অপরিহার্যট্রেড ইউনিয়ন শিল্প-কারখানা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের সে রকম একটি সংগঠন, যার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার তুলে ধরতে পারে এবং তা আদায় ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনে লড়াই-সংগ্রাম করেআধুনিক শিল্পোন্নত বিশ্বে ট্রেড ইউনিয়ন কেবল মেহনতি শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে না, বরং তা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় শ্রমিক শ্রেণীর মতামত তুলে ধরে, শ্রমিকদের সুসংগঠিত করে শিল্প কারখানায় সুস্থ শিল্প-সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে উপাদনশীলতা বৃদ্ধিরও অপরিহার্য শর্তে পরিণত হয়েছেতাছাড়া যে কোন রাষ্ট্রে সঠিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ ও তাকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে সে রাষ্ট্রের উপাদিকা শক্তি মেহনতি শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের অপরিহার্য হাতিয়ার হিসাবে ট্রেড ইউনিয়নের এখনো কোন বিকল্প নেইতাই বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এমন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে যে, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তা ভূমিকা রাখতে পারেন্যুনপক্ষে তাদের অবজ্ঞা করে সে সকল দেশে কোন রাষ্ট্রপরিচালনা চলতে পারেনা তার বিপরীতে আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এখনো যেন তার প্রাথমিক স্তরও অতিক্রম করতে পারেনিতাই আমাদের কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রে পৌছতে হলে শ্রমজীবি মানুষের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে সঠিক ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।  এ কথা ভাবার অবকাশ নেই যে, কোন কর্তৃপক্ষ বা সরকার বদান্যতা দেখিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিচ্ছে এবং ইচ্ছা করলে তা তারা বন্ধ  করে দিতে পারে১৯৪৮ ইং সালের সার্বজনিন বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার ২৩(ঘ) ধারা, আই,এল,ও কনভেনশন অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার যে কোন দেশের শ্রমিক শ্রেণীর মৌলিক মানবাধিকার

ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সম্পর্কে দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের দেশে এক প্রচণ্ড নেতিবাচন ধারণা বিরাজ করছেতার প্রধান কারণ আমাদের দেশে বিদ্যমান রুগ্ণ রাজনীতির ভাইরাস সংক্রমণ থেকে আমাদের দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও রক্ষা পায়নি

দেশে বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সংকট-সমস্যার যেমন আছে ঐতিহাসিক পটভূমি, তেমনি আছে সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতাপূর্ব কালে, অর্থা পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠতে থাকেআমাদের দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্ষালে ঐ সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ব্যানারে সেদিনের মেহনতি শ্রমিক শ্রেণী অত্যন্ত লড়াকু ভূমিকা পালন করেছিলস্বাধীনতা যুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্যস্বাধীনতার অব্যবহিত পর ক্ষুদ্র-বৃহ-মাঝারি প্রায় আট শতাধিক শিল্পকারখানা জাতীয়করণ নীতির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সে সকল প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী বেসিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠেযুগপভাবে বিভিন্ন জাতীয় ভিত্তিক শ্রমিক ফেডারেশনও গড়ে ওঠে স্বাধীনতার অব্যবহিতপর ১৯৭৪ সালে সরকার বেসিক ইউনিয়নগুলোর দরকষাকষির অধিকার হরণ করে একটি আইন প্রণয়ন করেন (The state owned manufacturing industries workers’ (terms & condition of services) Act-1974 ) যে আইনের ফলে বেসিক ইউনিয়নগুলো ৬ টি বিষয়ে তাদের দরকষাকষির অধিকার হারিয়ে ফেলে, যেমন- ১) বেতন-ভাতা, ২) ঘর ভাড়া, ৩) বোনাস, ৪) পালা ভাতা, ৫) মেডিকেল ভাতা, ৬) যাতায়াত ভাতাযার ফলে বস্তুত মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো কর্তৃপক্ষের সাথে দরকষাকষির সুযোগ হারালফলত ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিক-কর্মচারীদের পদোন্নতি-বদলী, বাসা বরাদ্ধ, ইউনিফরম ইত্যাদি কমগুরুত্বপূর্ণ  বিষয়ে তাদের মনোযোগ সন্নিবেশ করল।  তাদের কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের আশ্রয় গ্রহণ করে শ্রমিক-কর্মচারীদের বাড়তি কিছু, যেমন- বিশেষ বেতন বৃদ্ধি, এসগ্রেসিয়া, বোনাস ইত্যাদি আদায় করা যায় কিনা তার চেষ্টায় লিপ্ত হলসুযোগ লুপে নিল সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের দলীয় সভা সমাবেশে লোক সমাগম ঘটানোর জন্য দল বেঁধে শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে যেতে বাধ্য করল শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে বস্তুত তখনো জাতীয় ভিত্তিক শ্রমিক ফেডারেশনগুলো অন্তত অফিসিয়ালী কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠন ছিলনাকিন্তু জিয়াউর রহমানের সে কুখ্যাত পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশন জারী করে রাজনৈতিক দলগুলো রিভাইভ করতে তাদের অঙ্গ সংগঠনের নামও ঘোষণা করতে বাধ্য করলে তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের শ্রমিক ফ্রন্টের নামও ঘোষণা দেনবস্তুত এভাবেই শ্রমিক সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ার সুত্রপাত ঘটেঅতঃপর প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের মূল ইউনিয়নগুলো নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, অন্ত ও আন্ত ইউনিয়ন দলাদলিতে শক্তি অর্জন, কর্তৃপক্ষের সাথে দরকষাকষির সুবিধা, বিশেষভাবে নেতৃবৃন্দের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক ফ্রন্টের অন্তর্ভূক্ত হতে থাকেএমনকি একই প্রতিষ্ঠানের একাধিক ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ থাকলেও তারা একই জাতীয় ফেডারেশনের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে, ফেডারেশন নেতৃত্বের কোন্দল কাজে লাগিয়েএ ভাবে আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলন বস্তুত শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের মূল দায়িত্ব থেকে ছিটকে পড়ে রাজনীতিবিদদের কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোরÑবিশেষ ভাবে যখন যারা ক্ষমতায়Ñতাদের ক্রীড়নক বরকন্দাজে পরিণত হয়এ ধারাতেই কতিপয় শ্রমিক নেতৃবৃন্দ নানা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে রাতারাতি তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলে।  উপরোক্ত কারণে শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে, আমাদের দেশে তা হতে পারেনি

আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর  আমাদের দেশে বিদ্যমান ছোট, মাঝারি ও বৃহ প্রায় সকল শিল্প কারখানার মালিকানা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছাত্রদের ১১ দফায় সকল শিল্পকারখানা জাতীয়করণের দাবী সন্নিবেশিত ছিলতাছাড়া অধিকাংশ শিল্প কারখানা যেমন ছিল পাকিস্তানী মালিকদের পরিত্যক্ত, তেমনি অধনবাদী বিকাশের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ ছিল আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নতাই তখন শিল্পকারখানা সমূহ জাতীয়করণ করা ছাড়া কোন বিকল্প ছিলনা তকালীন সরকারের হাতে কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতিতে নানা বাস্তব কারণে জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানা স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি এ অজুহাতে ১৯৭৪ ইং সালের দিকে জাতীয়করণকৃত শিল্প কারখানা ও ব্যাংক-বীমা পূণঃ ব্যক্তিমালিকানায় প্রত্যার্পনের সমর্থনে একটি ক্ষুদ্র অথচ শক্তিশালী গোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে উঠলেও বস্তুতঃ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা পর্যন্ত কোন শিল্প কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা হয়নি।  কেবল ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের শিলিং ১৫ লক্ষ টাকা থেকে ২৫ লক্ষ টাকা করা হয়েছিলকিন্তু ১৯৭৫ইং সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে তারা জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের গতিমুখ পাল্টে দেয়অর্থনৈতিক বিকাশের পুঁজিবাদী পথকেই তারা সর্বরোগের ধন্বন্তরী মহৌষধ মনে করল মায়ের অজ্ঞতাপ্রসূত অযত্নে কাতর শিশুটিকে তুলে দেওয়া হলো স মাতার ক্রোড়েসঙ্গত কারণেই এবার সরকারীভাবেই প্রচারণা শুরু হলো রাষ্ট্রায়াত্ত্ব শিল্পকারখানার বিরুদ্ধেসরকারের আমদানী রপ্তানী  ও শুল্কনীতি রাষ্ট্রায়াত্ত্বখাতকে ব্যক্তিখাতের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় নিক্ষেপ করলো ফলতঃ  লোকসান বাড়তে লাগল রাষ্ট্রায়ত্ত্বখাতেরশুরু হলো বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া বিভিন্ন শিল্পকারখানা অত্যন্ত সুলভমূল্যে তুলে দেওয়া হতে লাগল বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে৮০ এর দশকে বিরাষ্ট্রীয়করণ সর্বোচ্চমাত্রা লাভ করে১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ ইং সাল পর্যন্ত কাল পর্বে উন্নয়ন অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০০০(এক হাজার ) কোটি টাকার ঋন ও বিরাষ্ট্রীয়করণের ও পুজিঁ প্রত্যাহারের মাধ্যমে ১০০০(এক হাজার ) কোটি টাকার পরিসম্পদ তুলে দেওয়া হয়েছে কতিপয় ব্যক্তির হাতে।(বাংলাদেশে পুজিঁবাদী বিকাশের সংকট--রেহমান সোবহান ও ডঃ বিনায়ক সেন।) বলাবাহুল্য এ প্রক্রিয়া বিগত আওয়ামী শাসন আমল হয়ে ৪ দলীয় জোট সরকারের আমল পর্যন্ত  অব্যাহত ছিল

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ মুক্তনীতি ও ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণের নীট ফলাফল দাঁড়াল নিন্মরূপঃ

ক) রাষ্ট্রায়াত্তখাতের পাঁচ শতাধিক  শিল্পকারখানা  ব্যক্তি মালিকেরা ফেরত ফেল

খ) বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোটাই হস্তান্তরিত হলো ব্যক্তি খাতে

গ) যে সমস্ত শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান জাতীয় অর্থনীতিতে স্পর্শকাতর ভূমিকা রাখার জন্য এমনকি অগ্রসর পুজিঁবাদী দেশেও বক্তিমালিকানায় রাখা নিরাপদ মনে করা হয়না, যেমন বিদ্যু, তেলগ্যাস, রেল ইত্যাদি সেক্টরকেও ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো

ঘ) সার ও কীটনাশক ঔষধসহ কৃষি উপকরণের উপর থেকে ভর্তুকী প্রত্যাহার , কৃষিঋণ বিতরণে দুর্নীতি ও অনিয়ম  এবং সামগ্রিকভাবে সরকারের ধনিক ও শহর অভিমুখী উন্নয়ন প্রয়াসের ফলে গ্রামীণ দারিদ্র পরিস্থিতি  ভয়াবহ রূপ ধারণ করল

নীট ফলাফল দাঁড়াল- ব্যক্তি খাতে হস্তান্তরিত পাঁচ শতাধিক  শিল্পকারখানার  ৬০% বর্তমানে অস্তিত্বহীন এবং বাকী ৪০% রুগ্ন হয়ে আছেবিয়াল্লিশ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ আত্মসা করেও শিল্পকারখানা গড়ে উঠছেনাবরং উক্ত ঋণের টাকার একটি সিংহভাগ পাচার হয়ে গেছে বিদেশেউপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলাচনা থেকে  আমরা কি এ অনুসিদ্ধান্তে পৌছতে পারিনা, মুক্তবাজার অর্থনীতির যে লাগামহীন ঘোড়ায় জাতিকে সওয়ার করা হয়েছিল এগিয়ে যাওয়ার সোনালী স্বপ্ন নিয়ে, মুক্ত বাজার অর্থনীতির চোরা বালিতে সে ঘোড়া  বহু পূর্বেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে নির্মম ফলশ্রতিতে বিরাষ্ট্রীকরণকৃত শিল্প কারখানা যে গুলো বন্ধ হয়ে গেল, সেগুলোর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক যেমন চাকুরীচ্যুত হল, তেমনি চাকুরী হুমকীর মুখে পড়ল রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিক-কর্মচারীদের, যা বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়র আন্দোলনে মারত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেললবস্তুত এরই ফলশ্রতিতে আশির দশকে জাতীয় ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গুলোর ঐক্যের মাধ্যমে গড়া ওঠা অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদও তার সে শক্তি হারিয়ে অনেকটা সাইনবোর্ড সর্বস্ব সংগঠনে পরিণত হলপক্ষান্তরে ব্যাক্তখাতে যে সকল ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প কারখান গড়ে ওঠেছে, সে সকল শিল্প কারখানায় মালিক-কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের যে কোন মূল্যে ট্রেড ইউনিয়ন করা থেকে বিরত রেখে তাদের মুনাফার আকাক্সক্ষাকে নিরঙ্কুশ করার প্রয়াস পেয়েছেভাবতে আশ্চার্য লাগে, দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও কিছু বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানী ছাড়া কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পকারখানা-বানিজ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের কোন ট্রেড ইউনিয়ন নেইরপ্তানী প্রক্রিয়াজাত এলাকায় জন্ম থেকেই দেশে বিদ্যমান প্রায় সকল শ্রম আইন নিষিদ্ধ থাকলেও ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপে  ইপিজেড অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প-কারখানাগুলোতে ক্রমান্বয়ে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে ১৮ই জুলাই ২০০৪ সালে ইপিজেড শ্রমিক সংঘ ও শিল্প সম্পর্ক আইন ২০০৪প্রণয়ন করা হয়েছিল সে আইনের বিধান অনুসারে ইপিজেডস্থ প্রত্যেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের ভোটে নির্বাচিত হয় শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব ও কল্যাণ কমিটি (ডজডঈ)উক্ত আইনের বিধান অনুসারেই বিগত ১ লা নভেম্বর, ২০০৬ ইং থেকে  ইপিজেড অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত হওয়ার কথা ছিলকিন্তু ইপিজেডে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কর্তৃপক্ষ সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের উপরোক্ত আইন অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন থেকে বিরত থাকার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিলএমনকি কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ চাকুরীর ভয় দেখিয়ে, ইউনিয়ন করতে ইচ্ছুক নয় মর্মে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় করেছিলবর্তমান জরুরী অবস্থা জারীর পর ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ বিদ্যমান আইনের তোয়াক্কা না করে শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব ও কল্যণ কমিটিরনির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে চাকুরী থেকে ছ্টাাই করে দিয়েছেএভাক্ষেই ইপিজেড শ্রমিক সংঘ ও শিল্প সম্পর্ক আইন ২০০৪”  অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে শ্রমিক কর্মচারীরা মালিক পক্ষের বাঁধাহীন নির্যাতনের মুখে পড়েছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট-পরিবহন-নির্মাণ প্রভৃতিখাত সহ ইনফরমাল খাতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত এবং তাদের অনেকের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন াকলেও আইনের অস্পষ্টতা, স্ববিরোধীতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে ঐ সমস্ত ইউনিয়নগুলো বস্তুত প্রতিদ্বন্দী ইউনিয়ন এর সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাতপুলিশদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলন, বিভিন্ন  কারণে অকারণে নিজেদের সদস্যদের মধ্যে চাঁদাবাজি করা ছাড়া তাদের সদস্যদের অধিকার আদায়-সংরক্ষণে তেমন কোন ভুমিকাই রাখতে পারে নাখুব কচ্চি কদাচ্চি পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সরকারের সাথে চুক্তি করে থাকলেও সে চুক্তি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি দেশের বিশাল নির্মান শ্রমিক গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য কোন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন এখনো গড়ে ওঠেনিশ্রমিক হিসাবে দেশে বিদ্যমান শ্রম আইনে তাদের জন্য কোন বিধি-বিধান নেই বললে চলেতাদের কাজ চুক্তি ভিত্তিক হলেও সে চুক্তির শর্ত, ন্যুনতম মজুরী, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝ^ৃঁকি, দুর্ঘটনা ইত্যাকার বিষয়ে কোন আইন আমাদের দেশে এখনো প্রণীত হয়নিফলত আমরা দেখি র‌্যাংগসটেল দালান ভাঙ্গতে গিয়ে কী মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল ডজনাধিক শ্রমিককোন ক্ষতিপূরণত তারা পাই নি, বরং মৃতের লাশ পেতে লেগে গেছে কয়েক মাসস্বাধীনতার পর হতে যারা আমাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের কেউ এব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনা করেছেন বলে মনে হয়নাএ হলো অতি সংক্ষেপে আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সকরুণ চিত্র

উত্তরণের উপায়

চুড়ান্ত বিচারে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নির্ভর করবে একটি বিকাশমান শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উপরআবার সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলা ব্যতীত টেকসই শিল্প খাতের বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হবে বারংবার, যার নজির গার্মেন্টস সেক্টরের সর্বসাম্প্রতিক ঘটনা

বিদ্যমান অবস্থায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে বিকাশের সঠিক পথে স্থাপন করতে হলে নিন্মোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণকরা অতি জরুরী

এক) প্রথমত আইএলও কনভেনশনের আলোকে সকল সেক্টরের সরকারী বেসরকারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা ও দরকষাকষির সুযোগ প্রদান করে আইন প্রণয়ন করতে হবে

 দুই) দ্বিতীয়ত বিদ্যমান শ্রম আইনকে সংস্কার করে আইএলও কনভেনশন এর আলোকে আরো আধুনিক ও শ্রমিকবান্ধব করতে হবে

তিন) আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শ্রম আদালত, শ্রম দফতর, কারখানা পরিদর্শক প্রভৃতি বিভাগকে অধিকতর কার্যকর, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদীহি মূলক করতে হবে

চার) ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের উপর বাহিরের হস্তক্ষেপ, বিশেষভাবে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জন্য আইনানুগ বিধান প্রণয়ন করতে হবে

পাঁচ) ট্রেড ইউনিয়ন করার কারণে যে কোন প্রকার নির্যাতন, চাকুরীচ্যুতি ইত্যাদি বন্ধ করে এবং ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক সহয়োগিতা প্রদানের বিধান সম্বলিত আইনী বিধান প্রণয়ন করতে হবে

ছয়) শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের শিল্প সম্পর্ক বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান নিয়মিত করতে হবে

সাত) সরকার বিভিন্ন কল্যাণমূলক উদ্যোগ যেমন, শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি, কারিগরি প্রশিক্ষণ ইত্যাকার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার উদ্যোগ নিতে পারে

-------------------------------------------------------------------

সভাপতি, ইস্টার্ন রিফাইনারী এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন(সিবিএ),

বাংলাদেশ অয়েল এ্যান্ড গ্যাস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন

সহ-সভাপতি,

বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ফেডারেশন