একহালি সম্পাদক ও একটি মেরুদন্ডহীন জাতির জন্মপ্রক্রিয়া
আরিফ জেবতিকবায়তুল মোকারমের পাশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে খতিব উবায়দুল হকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এসেছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান । ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবী পরে সেখানে প্রথম আলো সম্পাদকের সাথে গিয়ে সুশীল বালকের মতো কাঠের চেয়ারে উপবিষ্ঠ হয়েছেন দুই উপদেষ্টা ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন ও মেজর জেনারেল (অব:)ডা.এ.এস এম মতিউর, যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার,আমাদের সময় এর সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান,মানব জমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। আর খতিব সাহেব সবাইকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে খুব আরামের একটা গদি আটা চেয়ারে বসে বসে কথা বলছিলেন।মনে হচ্ছিল প্রধান শিক্ষকের অফিসে ধরে আনা হয়েছে কিছু বেয়াড়া ক্লাস ছাত্রকে।
আমি হতবাক,বিক্ষুব্ধ। আপাত: মনে হতে পারে এই ক্ষমা চাওয়ার ঘটনায় দেশ ও জাতি একটা বড়ো সংকটের হাত থেকে উদ্ধার পেল। আমি তা মনে করছি না। আমি মনে করি এই ক্ষমা চাওয়ার মাঝ দিয়ে আমরা আরো বড়ো সংকটে প্রবেশ করলাম।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে খতিব সাহেব এই দেশের একজন সরকারী কর্মচারী,এবং রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী তার অবস্থান কতোতম সেটা সঠিক না জানলেও এটা নিশ্চিত জানি যে তিনি প্রটোকলে তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্ঠাদের চেয়ে বেশ খানিকটা নিচে। উপদেষ্ঠাদ্বয় যদি তাদের থেকে পদমর্যাদায় নিচু কোন কর্মকর্তার সামনে নতজানু হয়ে বসেন,সেটা ভবিষ্যত প্রশাষনের জন্য একটি খারাপ নজির হয়ে থাকলো।
তারপর আসা যাক সম্পাদকদের কথায়। এটা নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে এই একহালি সম্পাদক জানেন না যে আরিফুর রহমানের কার্টুনটি আসলে বহুল প্রচলিত একটি পুরোনো কৌতুকেরই প্রকাশ মাত্র,সেখানে ইসলামকে বিপন্ন করার বা রাসুল (সা:)কে আহত নিহত করার কোন ইচ্ছে সেই অবোধ তরুন কার্টুনিস্টের ছিল না।
তারা জানেন,তবু তারা একটি অন্যায় আবদারের কাছে নতজানু হলেন। এর দীর্ঘস্থায়ী ফল হবে ভয়াবহ। এখন যে কোন ইস্যুতেই এই সব আলেম উলামা গন চক্ষু রাঙাবেন,আর সেই চক্ষু রাঙানোকে সরকার বরদাশত করতে হবে।
আমি পুরো বিষয়টিকে দেখি একটি সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারী চক্রান্ত হিসেবে।কাল যদি কোন আলেম দাবী তুলেন যে মহিলাদেরকে কাজ করতে দেয়া হবে না,বা এনজিওদের ক্ষুদ্র ঋন প্রোগ্রাম বন্ধ করতে হবে,বা টিভি চ্যানেলে নাচ গান দেখানো যাবে না,বা পুরুষরা গিরার নিচে প্যান্ট পরতে পারবে না,তাহলে কি এই সব কাজ যারা করেন তারাও খতিবের সামনে হাটুমুড়ে নাকে খত দিয়ে আসবেন? এই ভয়ংকর দৃষ্ঠান্ত তো স্থাপিত হয়েই গেছে।
আমি এই একহালি সম্পাদককে কোনভাবেই ধর্মব্যবসায়ী চক্রের চেয়ে আলাদা করে দেখতে পারি না। তারাও নিজেদের স্বার্থে যে কোন অন্যায়কে মেনে নিতে পারেন।তাহলে তারা কোন বিচারে সুযোগ সন্ধানী ধর্মব্যবসায়ী চক্রের চেয়ে আলাদা হলেন?
আর তাদের কথাই বা বলি কেন? দেশের সবগুলো সুশীল প্রজাতির প্রানী,যারা সংবাদ পত্রের কলামে,টিভির টকশো তে,সেমিনার সিম্পোজিয়ামে মানবাধিকার,বাকস্বাধীনতা,এসব বলে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলেন তাদের শ্রেনী চরিত্রও এই ঘটনায় চেনা হয়ে গেছে।
২০ বছরের কার্টুনিস্ট তরুন আরিফুর রহমানের জন্য একজন উকিল নিযুক্ত করে নি এই রাষ্ট্র কিংবা একটাও মানবাধিকার সংস্থা।অথচ আজকাল মানবাধিকার একটা ভালো ব্যবসা,পাড়ার মোড়ে মোড়ে মানবাধিকার সংস্থাদের অফিস। মানবাধিকার বেচে ফ্ল্যাট হয়,পাজেরো গাড়ি হয়,কখনো কখনো উপদেষ্টার পদ জুটে আর ভাগ্যে থাকলে নোবেলও পাওয়া যায়,নিদেন পক্ষে একটা ম্যাগসেসে পুরষ্কার।
আরিফের ঘটনাটি নিয়ে আদালতে লড়াই করা যেত,মানবাধিকার সংস্থাগুলো জোট বেধে দেশের সুস্থ মানুষদের জনমতকে ঐক্যবন্ধ করতে পারতো,আন্তর্জাতিকভাবে জনমত গঠন করতে পারতো,কিন্তু একটি তরুনকে একা করে দিয়ে সবাই গর্তে লুকিয়েছে।
আমাদের মেরুদন্ডহীনতার ঘটনা শুধু এইবারই প্রকাশিত হলো না,কিছুদিন আগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশৃংখলাতেও প্রকাশ পেয়েছে। এই সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যার শিক্ষকরা নিজেদেরকে সমাজের সচেতন মানুষ হিসেবে দাবী করে থাকেন। শেখ হাসিনা গ্রেফতার হলে তারা জরুরী অবস্থার মাঝেও কালো ব্যজ ধারন করেন কিংবা কর্মবিরতিতে যান। অথচ তাদের সাধারন সম্পাদক কিংবা সভাপতি যখন ঠেকায় পড়লেন তখন "সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে একজন সাধারন সৈনিকের প্রতিও" তারা প্রকাশ্যে করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করতে কুন্ঠিত হন না।তাদের প্রানের মায়া,বড়ো মায়া। বড়ো মায়া সহায় সম্পত্তি আগলে রাখার। যেই শিক্ষক সেই ক্ষমা প্রার্থনা করলেন,তিনি চিরবীর কর্ণেল তাহেরের আত্মজ,যে কর্ণেল তাহের ফাসির মঞ্চেও মাথা উচুঁ করে বলে গিয়েছেন,'নি:শন্ক চিত্তের চেয়ে বড়ো সম্পদ নেই।" প্রিয় তাহের,আজ এই পোড়ার দেশে সেই নি:শন্ক চিত্তের মানুষদের অভাব না পড়লেও,সেই চিত্তকে ব্যবসায় লাগানোর মানুষেরও অভাব দেখা যাচ্ছে না।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামের যে সংগঠনটি সারা দেশে একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল সেই সংগঠনটির কর্তাব্যক্তিরা কোথায়?আজ এই সংকটে তারা শুধু বিবৃতি দিয়ে খালাস হয়ে গেলেন? আজকে জামাত-ই-ইসলামীর উত্থানে তাদের ভুমিকাই প্রকট। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পরে একজন মেরুদন্ডঅলা লোকও কি এই সংগঠনটি পেল না? সব শালাই তাইলে সূধাসদনের ধামাধরা হয়ে গেল। ঘাদানিক হয়ে গেল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন? ধিক,ধিক!
আমাদের চারপাশে আজ কিলবিল করছে এই সব মেরুদন্ডহীন প্রানীরা।তারাই আজ সুশীল তকমা লাগিয়ে,মানবাধিকার,বাকস্বাধীনতা,গনতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি তকমা লাগিয়ে চষে বেড়াচ্ছে আর নিজেদের আখের গুছাচ্ছে।
এই সব শুয়োপোকা আর ধর্মব্যবসায়ী কীটদের মাঝে আজ আর কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।
প্রয়োজন তাই নতুন নেতৃত্বের। প্রয়োজন এমন কিছু মানুষ যারা ঠেকিয়ে দেবে মেরুদন্ডহীন জাতি হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়াকে। জনমানুষের মাঝ থেকে সেই নেতৃত্ব উঠে আসবে বলে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি...।