এন্থনি গোমেজরা কি হারিয়ে যাবে?
খালেদ হালিম চৌধুরী
১৯৭১ সালের মহান যুদ্ধের যে সব ইতিহাস লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই যোদ্ধাদের অবদানের কথা। তারা বড় কাজ করেছেন। তাই তা লেখার বিরুদ্ধে আমি না। এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। কেবল দুঃখ হয় সাধারন মানুষ যেভাবে বুক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আগলে রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে তা হারিয়ে যেতে বসেছে । আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাই বাড়ী থেকে আমাদের পালাতে হয়েছিল। আমাদের যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন তারাও বাবার কারনে ভীত হয়ে আমাদের সাত দিনের ভেতর বাড়ী ছাড়ার নির্দেশ দিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের তখন দুর্দিন। তারা রিট্রিট করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী একের পর এর মুক্তাঙ্গন দখল করছে। যেখানে আমরা আশ্রয় পেয়েছিলাম, সে পাড়ায় একজন দো-আশলাও আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাড়ার প্রতিটি মানুষই বাংলাদেশের পক্ষে বলে তিনি এতদিন ঘাপটি মেরেছিলেন। এবার তার স্বরুপ দেখা গেলো। এশিয়ার সেরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বীরত্বের গাথা প্রচার করে পাড়া মাতিয়ে ফেললেন। আমাদের আশ্রয় দাতা বিধবা মহিলা ও আমাদের বিরুদ্ধে রীতিমত জেহাদ ঘোষনা করলেন। আমাদের কারনে পাকিস্তানীরা কিভাবে বীরত্ব প্রকাশ করবে, তাও বলে বেড়াতে লাগলেন। আর বাবারও খোজ নেই। উপায়ান্তর না দেখে মা আমাকে বললেন, “বাবা, একটা নৌকার ব্যবস্থা কর। আমরা নিজেরা মিলিটারীর কাছে ধরা দেই। মিলিটারীরা আমাদের মেরে ফেলুক। মরে যাওয়াই আমাদের বেচে থাকার একমাত্র পথ।"
ঠিক সেই সময়েই, একেবারে অলৌকিকভাবেই, বির্বন জামা ও আধা-ছেড়া স্যান্ডেল পায়ে অপরিচিত অনাত্মীয় এক স্বুল শিক্ষক আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি বললেন, “স্যার যুদ্ধ করছেন দেশের জন্য, তাই আমাদের কাজ আপনাদের দেখাশুনা করা।" তিনি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের শিকারীপাড়া গ্রামের এন্থনি গোমেজ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য এন্থনি গোমেজ আছেন যারা হারিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন। আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই এই ইতিহাস সংরক্ষন করার উদ্যোগ নেয়া আমাদের আশু কর্তব্য।