ম্যাকডোনাল্ডস
টরোন্টো শহরের ইয়র্কভিল এলাকার মাঝামাঝি জায়গায় একটি বড় ফুডকোর্টের ভিতরে ম্যাকডোনাল্ডস এর দোকানটা কোনাকুনি ভাবে দাড়ানো। উইকএন্ডে তেমন ভীড় থাকে না বলে নিতা তিন নম্বর ক্যাশ রেজিস্ট্রারের সামনে দাড়িয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। খুব বেশী বেচাবিক্রি নেই, হৈচৈ ও নেই তেমন। দু তিন মিনিট অন্তর অন্তর কাস্টমার আসে।
“হাই ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ।“ নিতা হাস্য মুখে হাত উঁচু করে।
অতশীপর বৃদ্ধা, দেখে মনে হয় যেন মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছে, তবু জীবনকে কি ভীষন ভালোবাসে। গা ভর্তি গয়না, ঠোটে গাড় লিপস্টিক।
“হোয়াটস দ্যা ডিল টুডে।“
“বিগ ম্যাক, ম্যাম।“ নিতার মুখস্ত বুলি।
বুড়ি খাবারের অর্ডার দিয়ে সামনে টেবিলে গিয়ে বসে। কোন কাস্টমার নব্বই সেকেন্ডের বেশী অপেক্ষা করবে না। তাই নিতা দ্রুত হাতে মিডিয়াম কোক আর ফ্রাইস টা রেডি করে। ততক্ষনে পিছনে দাড়িয়ে রজার বিগম্যাকটা এগিয়ে দিয়েছে।
“হ্যাভ এ গুড ইভনিং ম্যাম।“ যান্ত্রিক হাসি ছুড়ে দিয়ে নিতা বুড়িকে বিদায় দেয় । আবারো কিছুক্ষনের জন্য নীরবতা নেমে আসে। ক্যাশ রেজিস্ট্রারটার দিকে তাকিয়ে থাকে নিতা । ভীষন জটিল লাগে তার যন্ত্রটাকে । ছোট একটা স্ক্রীন, কিন্তু প্রতি পাঁচদিন অন্তর অন্তর নতুন মনে হয় এটাকে ।
দু’পায়ের উপর পাঁচ ঘন্টা দাড়িয়ে আছে নিতা। কানাডাতে ওর আগমনের বয়স মাত্র চার মাস। ম্যাডোনাল্ডসে কাজ করছে দু’ মাস হলো। অনেকেই বলছে কপাল গুনে কাজ পেয়েছেন আপনি, কিছুদিন যাক নিজেই বুঝবেন । তবুও একা একা দাড়িয়ে থাকার এই সময়গুলোকে ভীষন অন্ধকার মনে হয় নিতার।
“হাই, হোয়াটস দ্যা ডিল টুডে।“
নিতা ফিরে আসে আবার বাস্তবে।
“হোয়াট ডু ইউ লাইক স্যার।“
“ওকে, আই নিড স্যন্ডুয়ীচ উইদাউট অনিয়ন এন্ড পিকল।“
রেজিস্ট্রার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে নিতা বুঝতে পারে ও পারছে না। হঠাৎ করেই অপরিচিত লাগে ওর বাটনগুলোকে। কয়েক সেকেন্ডের ভিতর বেশ কিছু কাস্টমার জড়ো হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে নিতার পাশে এসে দাড়িয়েছে ব্রায়ান। সাতাশ আটাশ বছরের তরুন ব্রায়ান খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে। নিতার রেজস্ট্রারে বাটন প্রেস করে লাইন সামলাতে থাকে সে। নিতাও যন্ত্রের মতো অর্ডার সার্ভ করতে থাকে, কিন্তু অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখতে থাকে ব্রায়ানকে। কই, এদেরতো কোন হীনমন্যতা নেই ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করছে বলে। কতবেশী প্রোফেশনাল এরা। ব্রায়ানকে দেখে বোঝা যায় না যে, সে একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি স্টুডেন্ট। অথচ পয়ত্রিশ বছর বয়সেও নিতা যেন পড়ে আছে দুইশ’ বছর পিছনে।
আজকে নিতার ছয় ঘন্টার শিফট। আরো তিনঘন্টা কাজ করতে হবে। এখনো লাইনে তিনজন দাড়িয়ে আছে। পিছন থেকে বাঙালী মেয়ে লাবনী বলে উঠে,
“হেয়ার ইজ ইউর ডাবল চিজ বাগার্র।“
লাবনী ঢাকাতে একটি ইউএন অফিসে কাজ করতো। প্রায় সাত বছরের দামী চাকরি এবং ঠাটবাট ছেড়ে তিনবছর হলো ম্যাক এ কাজ করছে। ওর চামড়ার নীচে গভীর ক্ষত রয়েছে, কিন্তু বোঝা শক্ত । নিতার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন লাবনী ধমকে উঠে বলেছিলো, “লিভ ইউর অল পাস্ট ডেইজ , কনসেন্ট্রেট ইওর প্রেজেন্ট জব।”
গতদুমাসে একটি বাংলা কথাও লাবনীকে বলতে শোনেনি নিতা । নাকে ছোট ডায়মন্ড , হাতে চিকন সোনার চুড়ি , টাইট গেঞ্জি আর প্যান্ট পড়া লাবনীর সারা শরীর জুড়ে লাবন্য। কিন্তু সেসব দিকে তাকানোর সময় নেই ওর, রোবটের মতো চলতে থাকে ও ।
ম্যাকডোনাল্ডস এর এই চেন স্টোরটাতে মোট পাঁচটা বাঙালী মেয়ে নানান শিফটে কাজ করে। লাবনী ছাড়া রয়েছে মুক্তি, ঢাকাতে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করতো। ছোটবেলায় হলিক্রসের মেধাবী ছাত্রী ছিলো। আলাপের প্রথম দিন বলেছিলো, “জানেন তিনবছর হলো কাজ করছি। আমার মা এখনো জানে না আমি কানাডাতে কি করি।“ সেদিন কথা বলতে গিয়ে মুক্তির চোখের কোনা চিকচিক করে উঠেছিলো।
“হাই ম্যাম, হাউ আর ইউ টুডে।“ নিতা সচল হয়ে উঠে আবার।
“ফাইন , কুড ইউ প্লিজ গিভ মি এ সিনিয়র কফি এন্ড ব্লুবেরী মাফিন।“
নিতা আবার হাত তুলে রজারকে ডাকে। এই একটি গুন বিদেশীদের, মুখে কোন বিরক্তি প্রকাশ করবে না। প্রয়োজনে চাকরি থেকে ফায়ার করবে কিন্তু ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় ঘটাবে।
নিতা কফির মগটা বয়স্ক কাস্টমারকে এগিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে। ম্যাকডনাল্ডসে নিতা ট্রেনিং নেবার সময় আরো দুটো বাঙালী মেয়ে ছিলো। এখানকার আটাশ বছরের পুরোন কর্মী লি ইয়েন যে ট্রেনিং দিয়েছিলো। নিতার সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে বাংলাদেশের যে কোন টপ লেভেলের কর্মীও যদি এই ট্রেনিং পায় তাহলেও তার মনে হবে যে, জীবনে সার্ভিস ওরিয়েন্টটেড কোন শিক্ষাই সে পায়নি। ইয়েন ওর ট্রেনিং শেষে বলেছিলো , আপনারা এক একজন কর্মী সম্পুর্ন একটি ম্যাগডোনাল্ডসকে রিপ্রেজেন্ট করছেন, সুতরাং ইউ আর দ্যা ইউনিক পারসন অফ ইচ ম্যাগডোনাল্ডস । লী ইয়েন যেন ওর প্রতিটি সেকেন্ড দিয়ে অনুভব করছে সংস্থাকে। দেশে বেশ কিছু বেসরকারী প্রতিস্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা আছে নিতার, কই সেখানে তো এভাবে কর্মী গড়ে তোলা হয় না। ম্যাডোনাল্ডসের চাকরির জন্য সেই একদিনের ট্রেনিং নিতার জীবনে একটি বড় সঞ্চয় হয়ে থাকবে ।
“হাই নিতা, প্লিজ গিভ মি এ লারজ ফ্রাইজ।“
কখন যে মনিকা কাজ শুরু করেছে নিতা টের পায়নি। মনিকার বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিনে, ইংরেজী বলার সময়ে কিছুটা আঞ্চলিকতা চলে আসে। কিন্তু মনিকা বেশ সপ্রতিভ। চার বছর হলো কাজ করছে এখানে। ঢুকেছিলো সাধারন কর্মী হিসেবে, এখন ক্রু ট্রেনার। নিতার প্রথম তিনদিনের ট্রেনিং মনিকার হাতেই হয়েছিলো । মেধা এবং দক্ষতায় যোগ্য মনিকার স্বামী মামুন কানাডাতে স্বাভাবিকভাবেই কোন ভালো কাজ পায়নি। তাই, মনিকা ওর চাকরিকে যথেষ্ট গুরত্ব দেয় । আর সে কারনেই ট্রেনিং শেষে নিতাকে বলেছিলো, “ওরকম বড় চাকরি ঢাকাতে সবাই করতো। এখানে চাকরি করে দেখেন কত ঠেলা।”
মনিকার মনোভাব নিতাকে আরো গভীরভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলো ।
একটা মিডিয়াম কফি নিয়ে নিতা কোনার একটি টেবিলে গিয়ে বসে। পনেরো মিনিটের ব্রেক ওর। ম্যাকডোনাল্ডসে কাজের কথা শুনে ঢাকা থেকে আফসান ভাই বলেছেন, “খবরদার নিতা, ম্যাকডোনাল্ডসের একটি খাবারও তুমি খেয়ো না।“
চারমাসের কানাডার জীবনে এক মিনিটের একাকিত্বেও নিতা ফিরে যায় দেশে । দূর থেকে দেখতে পাচেছ শেলী আসছে। শেলীদের বাড়ি নেত্রকোনা, কানাডায় ও আছে ছয় বছর। দুই বছর হলো কাজ করছে ম্যাকডোনাল্ডসে। শেলী ঢাকাতে সরকারী চাকরি করতো। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন থেকে মুক্তি পাবার জন্য কানাডায় এসেছে। আসার পরে বুঝেছে ঢাকায় মধ্যবিত্তদের কত সুখ। শেলী সেই বেদনা ভোলার জন্য এখানে ইভনিং শিফটে কাজ করে। শেলী বলেছিলো, “ছয় ঘন্টা কাজ করার পর বাড়ি গিয়ে যখন দেখি সব কাজ আমার জন্য পড়ে আছে, তখন শুধু ঢাকার কাজের মেয়েদের কথা মনে পড়ে। মনে হয় বড় ধরনের কোন পাপ না করলে কেউ এখানে আসে না।“
নিতা আবার ফ্রন্ট ডেস্কে তিন নাম্বার রেজিস্ট্রারের সামনে গিয়ে দাড়ায়। আর দুঘন্টা পর ওর ছুটি। বাড়িতে ছোটবোন , দু’সন্তান অপেক্ষা করছে ।
“হাই ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ।“ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিতা আবার।
সময় ধাবিত হয় আগামীর দিকে। Email:[email protected]