বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২২
বাসুন,
দীর্ঘদিন তোকে এই চিঠিটা আমি লিখি না। প্রায় দেড়মাস হতে চলল, কি অবাক বাবু তাই না ? আজকে হঠাৎ মনে হলো এই তো, এই কথাগুলোই আমি বলতে চাই। ছুটির দিন, ধারাবাহিক নাটক ডলস হাউস দেখছিলাম। নাটকটা যদিও একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীকে অর্থাৎ বাংলাদেশের উচ্চবিত্তকে রিপ্রেজেন্ট করছে তবুও নানান টানাপোড়েন দেখতে ভালোই লাগছিলো । কিন্তু নাটকের ৯৮/৯৯ পর্বে এসে আর ধৈর্ষ রাখতে পারলাম না, কারন অনেক বেশী ”সেলফ মেইড” মানুষ বলেই বড়লোকদের ছেলেমেয়েদের খামখেয়ালী আর ইচ্ছেমতো চলাফেরা করাকে একধরনের গার্বেজ মনে হয়। ব্যক্তিগত জীবনে যার যতবেশী দুঃখ কষ্টই থাকুক না কেন অর্থনৈতিক ভাবে যদি কাউকে নিজের জীবন চালানোর দায়িত্ব নিতে হয় তাহলে সে অনেকটাই যোগ্য মানুষ হতে বাধ্য। যেটার অভাব আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেনীর অনেক ছেলেমেয়ের ভিতরই দেখা যায়।
ডলস হাউস নাটকে দেখাচ্ছিলো শস্পা রেজার ছেলে অর্নব এর সংগে বোঝাপড়া। ছেলে সদ্য বিদেশ থেকে এসেছে, মায়ের গাড়ি হাকাচ্ছে, ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা করছে, সংসারের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। আবার বলছে আমি ঘোরাফেরা করতে চাই, সারাদিন অফিস আমার ভালো লাগবে না। বাবু, নাটকের এই পর্যায়ে আমি টিভি বন্ধ করে তোকে লিখতে বসলাম। একটা কথা কি জানিস সোনা, আজকে তের হাজার মাইল দূরে বসে আমার বাবা/ মা, যারা আমাদের চার বোনকে অর্থনেতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছিলেন তাদের কে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি । নাটকে অর্নবকে দেখেই আমার মনে পড়ছে ঢাকাতে এরকম একটি শ্রেনীর বাবা-মায়ের কথা যারা ছেলে-মেয়েদের জন্য অঢেল সস্পদ করে রেখেছে কিন্তু ছেলেমেয়েরা হয়েছে অর্থব, অযোগ্য এবং সেই সম্পদের হিসেবের সাথে জড়িয়ে রয়েছে চুরি, দূনীর্তি ও অন্যায়। নাটকে ডালিয়া এবং মালিহার পরিবারের জন্য যেটা জ্বলজ্বলে সত্য। বাবু, খুব ইচ্ছে করছে অর্নবের মা হয়ে আমি বলি, “যা নিজের টা নিজে করে খা”। তখন হাজার হাজার অর্নব এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে, ওরকম এলিজারা মাথা উচু করে দাড়াবে। তানভীরদের মতো ছেলেদের বাবারা সারাজীবন করেছে চুরি ডাকাতি অথবা নারীবাজী। যাদেরই বাস্তবের এক অংশ এখন পঁচছে বাংলাদেশের জেলে। সুতরাং ছেলেমেয়েদের ভবিষৎ এরকম হওয়াটাই তো নিশ্চিত ছিলো । নাটকের বাইরেই তাই আজ যখন টরোন্টোতে বসে বাংলাদেশের ক্ষমতাবান আর টাকাওয়ালা মানুষের পাহাড় সমান অন্যায় অবিচারের খবর প্রতিদিনের পত্রিকায় পড়ি, তখন কেবলই আমার বাবার সততার আর অবিচল নিয়মের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আমারই আপন ছোটবোন যে ঢাকাতে এত নামকরা ফ্যাশন হাউস ”সাদাকালো” চালাচ্ছে, অথচ শাহিন কি অসম্ভব ”সেলফ মেইড” মেয়ে সেই ছোটবেলা থেকেই। কই অনেক বড়লোকের ছেলেমেয়েরা তো আমার বোনের সাথে পড়তো তাদের কাউকে তো শাহিনের মতো করে মাথা তুলে দাড়াতে দেখিনি। কারন তাদের অনেকেরই বাবা/ মায়েরা টাটকা চোর ছিলেন যার পরিনতি আজকের বাংলাদেশের জেল/হাজতে উপচে পড়া ক্ষমতাবানদের ভিড়, বা আজকের বাংলাদেশের ইয়াবা ও ড্রাগের দৌরাত্ম। বাবু, এই বিদেশ বিভুঁইএ তোকে নিয়ে যে নিশ্চিত অর্থনৈতিক জীবনের নিশানা আমি পেয়েছি যেখান থেকে ইচ্ছে করলেই তোর ভবিষৎকে আমি গোছাতে শুরু করতে পারি। কিন্ত না বাসুন, আমি ৩৪ বছর বয়সে তোর বাবাকে ছেড়ে শুন্য হাতে জীবন শুরু করেছিলাম। সেদিন আমার সংগী ছিলো আমার অসম সাহস, আমি তোর ভিতরেও সেই জীবন জয়ী সাহস দেখতে চাই। অর্নব বা এলিজাদের মতো বিপথে যাবার ”রেডিমেড জীবন” জীবনবোধ নয় । তোকে আবার লিখবো সোনা, খুব তাড়াতাড়ি লিখবো। আদর।
তোর মা
১৬ ই মার্চ ২০০৮।
Email:[email protected]