বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২৩
বাসুন,
কেমন আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছিস তুই। চোখের সামনেই তোর বেড়ে উঠা বাবু, ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাস আবার স্কুল থেকে ফিরে তোর আমার রুটিন বাধা জীবন। কোন নড়চড় হবার উপায় নেই। প্রতি শুক্রবারেই পরের সপ্তাহের রুটিন করা হয়ে যায়। এর মাঝে আমার আনন্দ একটাই, কোন কোন রাতে তুই যখন ঘুমিয়ে পড়িস আমি তখন তোকে এই চিঠিটা লিখতে বসি। শুধু এই কয়েকটি মুহুর্ত আমার অতীত বর্তমান আর আগত সময়গুলো আমাকে এলোমেলো করে। আমি কখনো কখনো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলি। শুধু মনে হয় এই কি সেই জীবন যা আমি যাপন করতে চেয়েছিলাম? মাস গেলে বেতন পাবো আর নিজে ভালোভাবে বাঁচবো। শেষ, এখানেই শেষ হবে একটা জীবন? জানিস সোনা, এখন আবার গভীর রাত। তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস। কোন কারন ছাড়াই এই ছোট ল্যাপটপ-টাকে সংগী করি আমি ফিরে ফিরে যাই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। আজ হঠাৎ একটা খবর চোখে পড়ল ,কোন একটি গ্রামবাসী ভাতের অভাবে মাটি আলু খেয়ে জীবনধারন করছে। অথচ সকালেই তোর বড় খালার সাথে কথা বলছিলাম অফিসে যাবার আগে। রুটিন মাফিক কথা বাবু। তুই তো জানিস প্রতিদিন তোর দুই খালা মানে আমার দু’বোনের সাথে কথা না বললে পেটের ভাত হজম হবে না। সেই তোর বড়খালা মানে আমার বড়’পা বলছিলো, ফ্লোরিডাতে নাকি একজন বাংগালী মহিলা আছেন যার স্বামী ডাক্তার। তার এত এত বেশী টাকা যে তিনি মাত্র তিরিশ হাজার ডলার (বাংলাদেশ টাকায় ২১ লাখ টাকা) দিয়ে একটি হিরের আংটি কিনেছেন। আমি সত্যি ভাবতে পারি না, একজন মানুষ যার শিকড় বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে সে সুস্থ মাথায় এই বিলাসিতা করে কি করে? আমিই হয়তো অসুস্থ্ , হয়তো আমারই চিন্তার দারিদ্রতা আছে বলে আমি এভাবে তুলনা করছি। জানিস সোনা, আমি বাংলাদেশে আনাচে কানাচে ঘুরেছি এনজিওতে কাজ করতো গিয়ে। কখনো যদি গ্রামে আমি টানা সাত/আটদিন থাকতাম ঢাকা শহরের জীবনটাকে আমার কাছ মেকি মনে হতো। রংপুরের যে ছকিতন মাত্র একবেলা ভাতের জন্য সারাদিন কামলা(শ্রম) দেয়, সেই দেশেরই রাজধানী শহরের যে মেয়েটা ১০ হাজার টাকা দিয়ে সালোয়ার কামিজ কেনে, তার ক্রয়ক্ষমতাকে আমার চুরি মনে হতো। যে দেশের গড় আয় এক ডলারের কম, সেই দেশের মানুষ বা একজন মন্ত্রী কয়েকশো কোটি টাকার মালিক হলে তো তাকে চুরিই করতে হবে।
জানিস বাবু, এই কথাগুলো বলতে গেলে আমার মুখের ভিতরটা তিতা হয়ে যায়। আজ বাংলাদেশে যেসব ক্ষমতাবানরা জেলের ভাত খাচ্ছে তাদেরকে খোলা মাঠে নিয়ে গুলি করে মারা উচিত। আজ তাদেরই অনেক বংশধররা এই বিদেশের মাটিতে আছে যারা বাবার চুরির টাকায় বাড়ি/গাড়ি কিনে দিব্যি জীবন চালাচ্ছে। কোন আইন এদের লোম পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না। আবার ফ্লোরিডার সেই হিরের আংটির মালিক মহিলা যার স্বামী শুধু ডাক্তার বলেই ঘন্টায় ৫০০ ডলার আর্ন করে, তাই মহিলার কাছে হিরের আংটি হয়ে উঠে শখ যা আমার মতো গরীব কলেজ শিক্ষকের মেয়ের কাছে একধরনের অসুস্থ্যতা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে বাংলদেশের সেইসব ক্ষমতাবান পঁচে যাওয়া মানুষের ছেলেমেয়রা কি দেশের আর দশটা সাধারন মানুষের মতো ভাত কাপড়ের কষ্ট করছে? ওরা কি ওদের বাবা/ মায়ের জন্য একটুও লজ্জা পাচ্ছে ? ওরা কি কখনই জানতো না যে ওদের বাবা মায়েরা দেশের সাধারন মানুষের টাকা চুরি করে বড়লোক হয়েছিলো। ওদের বাবা / মায়েরা মানুষরূপি হায়েনা বা শুয়োপোকার মতো নোংরা জীব?
বাবু, রাত বাড়ছে ,আমি যা লিখছি তার কোন শেষ নেই। এই লেখা যারা পড়বেন তারা যদি কোনদিন এক টাকাও কষ্ট করে আর্ন করে থাকেন তাহলে শুধু তারাই আমার বেদনা ও হিংস্রতাকে উপলব্ধি করতো পারবেন । তোকে আদর বাবু ।
লুনা শীরিন , টরোন্টো।
১০ এপ্রিল , ২০০৮ ।
Email:[email protected]