বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২৪
বাসুন,
২০০২ সাল। ব্যক্তিগত জীবনে নানান টানাপোড়েন পেরিয়ে একটু নিজের কাছে থিতু হয়েছি। অফিসে যাই, বাড়িতে আসি। আবার রাত আসে, সকাল হয়,আমার নিস্তরংগ বহমান সময়। একটু বৈচিত্র্য আনা দরকার। বেসরকারী সংস্থায় কাজ করি বলেই সপ্তাহে দুদিন ছুটি। ভাবলাম কন্ঠশীলনে আবৃত্তির একটা কোর্স করে ফেলি । যে কথা সেই কাজ। ফেব্রুয়ারীর এক নরম রোদকে সাথে নিয়ে হুড খোলা রিকসায় হাজির হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির হলরুমে । প্রায় ৮০/৯০ জন শিক্ষার্থী বসে আছে। সামনে ছোট টুলের উপর সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পড়া ছোটখাট মানুষ ওয়াহিদুল হক। আমাদের অনেকের প্রিয় কাকু। আমার এই ছোট জীবনে আমি যে কয়েকটা আলোচনা খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম তার ভিতর সেদিন কাকুর বলা কথাগুলো অন্যতম। কাকুর সামনে সেদিন আমরা যারা বসেছিলাম সবাই তরুন, বলা চলে কাকুর চেয়ে যারা নিঃসন্দেহে ৩০ বছরের ছোট। খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে সেদিন কাকু যা বলেছিলেন তার মর্মকথা হলো, ‘তোমরা যারা আমার সামনে বসে আছো তার নিজেদের যতই আধুনিক এবং ইংরেজী জানা মনো করো না কেন, আমি হলপ করে বলতে পারি তোমরা কেউই ভালো ইংরেজী জানো না। কারন তোমরা ভালো বাংলা জানো না। যে মানুষ নিজের ভাষা ভালো করে জানে না সে আরেকটা ভাষা রপ্ত করবে কি করে?’ আমি পরে কাকুর এই কথাটা কয়েকজনের কাছে বলেছিলাম। কাকুর সমসাময়িক ইংরেজীর শিক্ষক প্রফেসর খান সারোয়ার মুরশিদ আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যদি একজনকেও সঠিক ইংরেজী জানা লোক বলতে হয় তবে তার নাম হবে ওয়াহিদুল হক’।
বাবু, আজ ২০০৮ সাল। টরোন্টো শহরে দুপুর ২টায় বসে বাংলাদেশের পত্রিকা পড়ছিলাম। আমি সাধারণত পত্রিকার আদ্যপান্ত পড়ি। হঠাৎ চোখে বাংলাদেশে ভাষা প্রতিযোগীতা হচ্ছে, আজকের প্রজন্ম অংশ নিচ্ছে, গুনীজনেরা তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন, আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাগুলো পড়তে থাকি । অফিসের সময় পার হয়ে গেলে বাসায় ফিরে সাংসারিক কাজ সেরে আবার তোর চিঠিটা নিয়ে বসি। কিন্তু বাবু, লেখা শেষ করতে পারছি না। তুই তো জানিস সোনা তোর আর আমার নিঃশব্দ জীবন। ইতোমধ্যে তুই স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে পাশের ঘরে গিয়ে কম্পিউটারে গেমস খেলছিস আর আমি চিঠিটা শেষ করতে না পারার তাড়না নিয়ে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ি। আবার অস্থির হয়ে আমার প্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামান এর ভাবনা ভাষান্তর পড়ি, আবার মনোযোগ ফেরাবার জন্য আখতারজ্জামান ইলিয়াস এর গল্পগ্রন্থ নিয়ে বসি। কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না লেখা। চিঠিটা শেষ করতে পারছি না বাবু। মনে পড়ছে আজ থেকে তিনবছর আগে তোর স্কুলে এক মিটিং এ তোর কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা বলেছিলেন, আমরা যারা অভিবাসী হয়ে কানাডায় এসেছি তারা যেন বাচ্চাদের মাদার টাং কে গুরুত্ব দিয়ে শেখাই । তখনো মনে পড়েছিলো কাকুর কথা, ভীষন ভাবে সত্যি মনে হয়েছিলো কন্ঠশীলনের সেদিনের সেই আলোচনা। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে তুই এসে গলা জড়িয়ে ধরে বললি মাম্মি ,” লিসেন প্লিজ” ? আমি লেখা বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি তোর শিশু মুখের দিকে ? এ কোন গল্প লিখছি সোনা আমি ? কেন বাংলাটা বলতে চাস না তুই? শেষে কি পরাজিত হবো নিজের বহন করা শরীরের অংশের সাথে ? তোর কাছে ? তুই বাংলা ভাষাটা না শিখলে আমি মুখ লুকাবো কোথায় ?
তোকে আদর সোনা।
তোর মা,
২৩ এপ্রিল , ২০০৮ ।
Email:[email protected]