বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২৫

বাসুন,

অনেকদিন পরে তোকে লিখতে বসলাম. বলতে পারিস লিখতে শুরু করতে পারলামকেন এতদিন লিখতে পারিনি বা পারছিলাম না এর কোন উত্তর জানা নেই আমার কাছে মাঝে বহুবার তোর এই ছোট্ট চিঠিটা নিয়ে বসেছি। অনেক দূর লিখেছি, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। কিছুতেই পারিনিকিন্তু বাবু, আজকে হঠা আমার স্মৃতি আমাকে উল্টে পাল্টে দিলো বলতে পারিস। এখনো তা আমাকে তাড়া করে ফিরছে। সত্যি সারা আপা আসবেন! দেখা হবে আমার সাথে সারা আপার এবং এই শহরেই?  কিছুতেই অপেক্ষার তর সইছে নারে বাবু

১৯৯১ সাল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়ি জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু  নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  বোরহানউদ্দিন খান জাহাংগীর স্যার এর  সমাজ নিরীক্ষন কেন্দ্রে বলে রাখা দরকার বাংলাদেশে নৃবিঞ্জান বিভাগ খোলার পিছনে বিকেজের  অবদান অনীস্বির্কাযসেই রকমই এক সকালে, ৮ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে আমরা অনেকেই ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরী চত্বর থেকে প্রেস ক্লাব এর উদ্দেশ্যে রওনা হলামমিছিল প্রায় শুরু  হবে এমন সময় আমাদের  লাইনের শেষ মানুষ হিসেবে যোগ দিলো লম্বা ছিপছিপে গড়নের একটি মেয়ে। চোখে মুখে বাংগালীপনার কোন ছাপ সেই। পান্জাবী আর চোস্ত সালোয়ার  পরা, পায়ে চটি  স্যান্ডেল। যতই সাধারন থাকার চেষ্টা করুক না কেন মেয়েটিকে প্রথম  দর্শনেই বোঝা যায় ও ঢাকার জল হাওয়াতে বড় হয়নি

মিছিল চলতে শুরু করেছে। মেয়েটিকে আমার খুব ভালো লাগলো বলেই আমি কয়েকবার ওকে পিছন ঘুরে দেখলামএরপর কখন প্রেস ক্লাব এ পৌঁছেছি, রোদ মাথায় দিয়ে শ্লোগান দিচ্ছি, খেয়ালই নেই। হঠা পিছন থেকে এসে সেই মেয়েটি আধো ইংরেজি আধো বাংলা ঢংয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু  করলো। মিছিলের ভিতর যে ছোট খাটো ইন্টারভিউ হয় অনেকটা সেইরকম (এখানে বলে রাখা ভালো আমার হম্বিতম্বি আর  গলার জোর দেখে অনেকই  মনে করেন আমি বুঝি দেশ উদ্ধার করে ফেলবো।  আসলে যে আমি কি তা তো আমি ছাড়া কেউ জানে না)। আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি

এর পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে  আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। গতকালের ঘটনা বর্ণনা করছিলাম তাকে। হঠা করেই মনে হলো বন্ধুকেই বরং জিজ্ঞেস করি মেয়েটা কে? জানতে চাইলাম আর সদ্য হালে পানি পাওয়া সাংবাদিক বন্ধু চিকার দিয়ে উঠলো, ‘লুনা , তুই প্লিজ সারা হোসেনকে(ডঃ কামাল হোসেনের মেয়ে) যোগাযোগ কর। উনি অনেক বড় লইয়ার, মাত্র লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন,

 বাবু, জানিস, সেই সারা হোসেন যার হাত ধরে আমি প্রথম বাংলাদেশের  নারী আন্দোলনের জন্য কাজ করেছিলোম। সারা আপার সেই বেইলী রোডের বাড়িতেও গিয়েছিলাম কয়েকবারশ্রেনী সচেতনতা  সব দেশেই আছে, ইংরেজীতে যাকে বলে ক্লাস কনসাসনেসআমি গরীব কলেজ শিক্ষকের মেয়ে। আমার বাবাই প্রথম জেনারেশন যিনি ঢাকাতে এসেছিলেন। সেইদিক থেকে বিবেচনা করলে সারার সাথে আমার আকাশ পাতাল দূরত্ব। বাংলাদেশের পলিসি মেকিং এ কাজ করেন সারা এবং তার মা হামিদা হোসেন। খুব কাছ থেকে দীর্ঘদিন দেখেছি এখনো বাংলা সোজা করে বলতে পারে না। ইংরেজীতে কথা  বলে অর্নগলঅনেক উঁচু তলার মানুষ হলেও সারা আপা বাংলাদেশকে ভীষন ভালোবাসে। আর সেকারনেই বোধহয় বিদেশের সব  সুখ আরামকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে

বাবু, তোকে বলছিলাম ১৯৯১ সালের কথা। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত  সারা সহ অনেরে  সাথেই খুব নিবিড়ভাবে সময় কেটেছে আমার। যতবার সারাকে দেখেছি ততবার মনে হয়েছে পল্যিটিকাল লিডার হিসেবে কামাল হোসেন  যত ব্যর্থ মানুষই হোক না কেন বাবা হিসেবে তিনি সফল। সারার মতো একটি মেধাবী এবং মানবিক মেয়ের বাবা তিনি

২০০৮ সাল। টরোন্টো শহরে অন্য দশটা দিনের মতোই  সকালে অফিসে গেছি। দেখি অফিসে আমার টেবিলের উপর সেমিনারে অংশগ্রহন করার আমন্ত্রণ পত্রচিঠি  খুলে  দেখি সাউথ এশিয়ান ফোরাম অব অন্টারিও (ফোর্স ম্যারেজ অব সাউথ এশিয়া) দুই দিন ব্যাপি সেমিনারের আয়োজন করেছেআজ টরোন্টোতে শুক্রবার, উইকএন্ড ইভিনিং বলেই আনন্দ নিয়ে শুরু হয় দিনটার ঘরের দরজা বন্ধ করে টেবিলে দিন শুরুর ভাবনা ভাবতে থাকি। হঠা  হাতে ধরা চিঠিতেই শেষ কিনোট পেপার প্রেজেন্টার এর নামে চোখ আটকে যায়। সুন্দর ইংরেজী হরফে লেখা সারা হোসেন, লইয়ার ফরম বাংলাদেশ বাবু, টরোন্টোতে সারা আপা আসবেন, আমি সেখানে থাকবো। কত দীর্ঘদিন পর সারাকে দেখবো। আমার স্মৃতি আমাকে তাড়া করছে বাবু

সেই সকাল থেকে ভাবছি। সারাদিন অফিসের কাজে সময় চলে গেছে। এখন টরোন্টোতে সামারের ঝকঝকে বিকেল। বাড়িতে এসেই লেখাটা লিখতে বসলাম। ইচ্ছে হলো তোকে বলে রাখি, বাসুন, তোর মায়ের অবারিত বয়ে যাওয়া এই ছোট জীবনে বেশ কিছু গভীর প্রাপ্তি আছে। যা তাকে সাহস যোগায়, একা পথ চলতে শক্তি দেয়। মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোন অর্জন মানুষকে পোড়ায় নাঅসম সাহসে ফেলে আসা তারুন্যের দিনগুলোতে সারা হোসেনের মতো ব্যক্তিত্ব আমাকে নাড়া দিয়েছিলো প্রবলভাবে। সারার জন্য রইলো মঙ্গল কামনা

তোর মা

১ জুন ২০০৮ ,টরোন্টো  

Email:[email protected]

পর্ব ২৪                                                                          পর্ব ২৬