বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২৭

বাসুন,

আবারো টরোন্টোতে সামারের সেই উথাল পাথাল দিনগুলো। মনে পড়ে বাবু তোর?   গতবছর ঠিক এই সময়টাতে আমরা আমাদের এই বাড়িতে উঠে এসেছিলাম। চারিদিকে সোনার মতো দিনের আলো হয়ে পড়তো ভোর হতেইতুই আর আমি কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি পার্কে বসে। আমি শুধু ভাবতাম আহ একটা চাকরি যদি থাকতো আমার’? জীবনের কি বিচিত্র নিয়ম সোনা। কেন এমন করে সময় চলে যাচ্ছে পলক ফেলার আগেই?

এখন ভোর সাড়ে ছয়টা। আমার ঘুম ছেড়ে গেছে আরো ভোরে। ভাবলাম তোর সাথে বরং একটু কথা বলিবিছানা ছেড়ে ল্যাপটপটা খুলে তোকে লেখা এই পুরোন চিঠিগুলো পড়ছিলাম বাবুএকবছর হয়ে গেলো তোকে  এই ধারাবাহিক লেখাটা শুরু করেছি আমি। গতকাল তোর গ্রেড থ্রি শেষ হলো। আমি চাকরি পেলাম আর তুই আরো একটু বড় হলি। আমার আর তোর জীবন থেকে আরো কিছুটা সময় বয়ে গেলো সোনা। জীবন কি এভাবেই বয়ে যায় বাবু? বাসুন আমার, তোকে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমার এই অনাবিল সোনার মতো দিনগুলো। আমি যেদিন অনেক বেলা পাড় করে জীবনের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে যাবো সেদিন পড়বো এই লেখাগুলো। তাই তোকে বলে যাচ্চি আমার এই সাধারণ জীবনের কিছু অনন্য ঘটনা

গতকাল আমার অফিসের বাসরিক বোট ক্রুজ ছিলো। আসলে খোলা বাংলায় যাকে বলে বাসরিক বনভোজন কষ্টি অফিসের প্রায় ২০০/২৫০ স্টাফ নিয়ে এটা বিশালকায় জাহাজ রওনা হয়েছিলো  হারবার ফ্রন্ট লেক থেকেআমরা হাজির হয়েছিলাম মধ্য দুপুরে। সবাই আসছে একে একে, কত বিচিত্র দেশের বিচিত্র মানুষ জুটে গেলো এক মিছিলে। আমি বোটের এক কোনায় দাড়িয়ে লক্ষ্য করছিলামজানিস বাবু, জন্মেছিলাম রংপুরের এক কলেজে। কলেজ শিক্ষক বাবার দ্বিতীয় মেয়ে সন্তান আমি। নিশ্চয়ই ছেলে পাবার  প্রচন্ড বাসনা ছিলো বাবা মায়ের ভিতর? তারপর থেকে কতটা বয়ে আসা আমার এই জীবন। হারবার ফ্রন্টের এই বোটক্রুজে আমার মতো সবচেয়ে দরিদ্র দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। আজো মেলাতে পারিনা আমি। কোথা থেকে শুরু করে মানুষ ? যাক সেসব কথা, আমি চোখে রোদচশমা লাগিয়ে দেখতে শুরু করি।এলসা লোপেজ আমার প্রথম সহকর্মী যার হাতে আমার ট্রেনিং হয়েছিলো ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে। ৩৩ বছর বয়সী এলসা এসছে কলম্বিয়া থেকে। আমাকে হাগ দিয়ে বলল গুড টু সি ইউ এগেইনতামারা ট্রটম্যন, কাজ করে আমার পজিসনেই কিন্তু অন্য লোকেশনেতামারা একহারা গড়নের ছিপছিপে  মিশ্র কালো  মেয়ে। আমি  ওকে দেখে বললাম তুমি নিজেকে এভাবে রাখো কি করে? তামারা ওর ছোট ডাই করা লাল চুলে হাত বুলিয়ে আদুরে ভংগিতে বলে, ‘আমি যা খাই দেখলে সত্যি অবাক হয়ে যাবে

দুপুরের রোদ বাড়ছে আর জাহাজ ছাড়বার সময় এগিয়ে আসছে। দূর থেকে দেখতে পাই আমার  বিভাগের জেনারেল ম্যনেজার কালো মানুষ ক্রেগ ব্লাকম্যান এগিয়ে আসছে।  ৫২ এর  কাছাকাছি বয়স হবে  ক্রেগ এর। কিন্তু একজন দক্ষ খেলোয়াড় বলেই ক্রেগকে অনেক বেশী  তরুণ দেখায়বাবু, এই ফাকে তোকে বলে রাখি। তুই তো বড় হবি মেইন স্ট্রিম কানাডিয়ান হিসেবে। আমাদের মতো নিউ ইমিগ্র্যন্ট  এর সিল  থাকবে না তোদের পিঠে এই কানাডাতেই আমি কালোদের নিয়ে নানান আপত্তিকর কথা শুনেছি, যা কম  বেশী সারাবিশ্বেই প্রচলিত। কালোরা খারাপ এবং উগ্রকিন্তু আমি টরোন্টো শহরে তিনজন কালো  মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি, কাজ করেছি।  তারা তো সবাই  মানুষ হিসেবে নমস্য। তাহলে আমার অভিজ্ঞতা তো মিললো না সোনা ।  মানুষকে কখনই বাজারের দরে মাপবি না বাবু। পরখ করবি নিজের অর্জিত  অভিজ্ঞতা থেকে

কালো টি শার্ট, মাথায় ক্যাপ পড়ে হেটে আসছেন ম্যরিও জে কালা, নিবার্হী  পরিচালক (কষ্টি), ধবধবে লাল ফর্সা  ম্যরিও  টরোন্টো শহরে বাংগালীদের ভিতর অনেকটাই পরিচিত। সেই সুত্র থেকেই মনে হয় আমার নাম উনি জেনেছেনম্যরিও আমাকে বলল, ‘তুমি কেমন আছো? কেমন চলছে কাজ’? আমি ম্যরিওর সাথে আলাপ জুড়ে দেই ম্যরিওকে বললাম বাংলাদেশে আমার কাজের অভিজ্ঞতা। কেন আমি কমিউনিটিতে কাজ করতে চাই। ম্যরিও গভীর মনোযোগ দিয়ে কথা শুনলো। জানতে চাইলো আরো কিছু  কথা। ইতোমধ্যে জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। আলাপের ফাঁকেই সংস্থার সিনিয়র পরিচালক মিস জোসি এসে হাজির। গরম  বলেই হয়তো জোসি একটা হাফ প্যান্ট আর  স্লিভলেস টপ পড়েছে আমি জাহাজের আরো  কোনায় চলে এলাম। এবার মুখরিত বোট, চারিদিকে হল্লাবাবু, আমার মন চলে গেলো আরিচা ঘাটে। মাত্র তিনবছর আগে আমিও এনজিওর কাজের সূত্রে চষে বেড়াতাম বাংলাদেশের আদ্যপান্ত। আর এই আমি আজ দাঁড়িয়ে আছি সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ে? এই কি চেয়েছিলাম জীবনে? শুধু নিশ্চিন্তে খাওয়া পরার জোগান? তোর আর আমার বেলা শেষে মাথা গোঁজবার ঠাইঁ? বেলা বেড়ে গেছে বাবু, অফিসে যেতে হবে। আমি বেশী ভাবতে চাই না। সব কেমন এলোমেলো লাগে। তোকে ডেকে তুলবো এখন। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে যেনো আরো কিছুটা সময় পার করতে পারি বাবুতোকে আদর

তোর মা,

২৭ জুন ২০০৮

Email:[email protected]

পর্ব ২৬