বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২৮
বাসুন,
তুই বড় হলে এ্যথলেট হব? খেলাধুলা যে জীবনের কত বড় দিক তা বুঝে উঠার আগেই ছোটবেলাটা পার হয়ে গেছে। জীবনের অনেকটা সময় চলে যাবার পর জানতে পেরেছি মানুষের যেদিকে আগ্রহ বা ইচ্ছে সেদিকেই তাকে চর্চা করতে দেয়া উচিত।
গত দুদিন হলো আমার অফিসের কাজেই যাওয়া আসা করছিলাম ইর্য়ক ইউনিভার্সিটিতে। তোকে মনে হয় আগে কোন একটা লেখায় বলেছিলাম যে, আমার বিভাগের জিএম ক্রেগ ব্লাকম্যান একজন দক্ষ এ্যথলেট। সারা টরোন্টোতে ওর নামডাক আছে এই বিযয়ে। আর আমরা যেহেতু ইয়ুথ প্রোগামে কাজ করি (১৩-২৪ বয়সের সাথে), তাই ইয়ুথদের যে কোন কাজের সাথে জড়িত হলে আমরা কিছু অফিসিয়াল সুবিধাও পাই । বাবু, তোকে বলি, বাংলাদেশে থাকতে জানতাম কমিউনিকেশন নাকি আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। এদেশে এসে তা হাতে নাতে উপলব্ধি করলাম। যোগ্যতার বিচারে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কতভাবে নিজেকে বিকশিত করে তার এক জলজল্বে প্রমান আমাদের জিএম। আমি ইর্য়ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়োছলাম সুপারমিট নামে একটা ইয়ুথ প্রোগ্রামে । বাংলাদেশে যেমন আন্তজেলা বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়, তেমনি সুপারমিট টরোন্টো ২০০৮ ও একটি প্রতিযোগিতা। কত ছেলেমেয়ে এসেছে টরোন্টোর বিভিন্ন শহর থেকে। উইন্ডসর, হ্যামিলটন, কিংস্টন, ব্রামটন, গুয়েলফ, অটোয়া থেকে নানান বয়সি ছেলেমেয়েদের দিয়ে মাঠ ভরে আছে। কি আশ্চর্ষ গতি ওদের! মেয়েরা/ছেলেরা লংজাম্প, হাইজাম্প, শটপুট, চাকতি নিক্ষেপ ইত্যাদি সব খেলছে। আশে পাশে ওদেরকে সাহস আর উৎসাহ যোগানোর জন্য বাবা/ মা আত্বীয় স্বজনের আপ্রান চেষ্টা । অন্যদিকে ওদের সাথে একই কাতারে খেলা চলছে প্রতিবন্ধিদের। তুই বড় হলে হয়তো কোনদিনও তুলনা করতে পারবি না যে, কি দেশ থেকে তোর মা তোকে তুলে এনে কোথায় মানুষ করলো। কানাডাতে প্রতিটি প্রতিবন্ধি মানুষ সাধারণ মানুষের সুবিধা পাবে এটা অনেকটা সরকার দ্বারা স্বীকৃত নিয়ম। আজ থেকে মাত্র দেড় বছর আগের কথা। আমার সোসাল সার্ভিস প্রোগামের শিক্ষক ছিলেন ন্যান্সি নিকোল। ওর দুটো পা জন্মগতভাবে ছোট, পঙ্গু এবং ওর একটা হাত অচল। প্রফেসর নিকোল চলেন হুইল চেয়ারে শুধু একটা হাত সক্ষম আছে তবুও আংশিক । একদিন ক্লাসে বসেই আমি আমার ক্লাসমেট স্টিফেনীকে বললাম নিকোল গাড়ি চালায় কি করে? স্টিফেনীর সেই তাকানোটা আমি কোনদিন ভুলবো না। ওর চোখেমুখে যেন ভেসে উঠেছিলো আমি কি কোন বর্বর সমাজ থেকে উঠে এসেছি। স্টিফেনী আস্তে বলল, তুমি জানো ডিজএবলদের জন্য আলাদা গাড়ি তৈরী হয়। আমি সেদিন আর কথা বাড়াইনি। কেন বাবু, এইতো গত সপ্তাহে, তোর মনে নেই? আলো খালামনিদের বাড়িতে এক বাংগালী পরিবার এলো ৯/১০ বছরের বাচ্চাকে সাথে নিয়ে। বাচ্চাটাকে জন্মের পর থেকেই নল দিয়ে খাবার দিতে হয়। কথা বলতে পারে না, চলতে পারে না, মাথাটা ছাড়া শরীরের আর কোন অংগই ঠিকভাবে চলে না। সেই মহিলা তো দিব্যি গয়নাগাটি পড়ে মনের আনন্দে বাস করছেন। বাচ্চা নিয়ে কথা বলতেই আমাকে বলল, আপা এটা কানাডা। আমার ছেলে স্কুলে যায়,খেলাধুলা করে, আবার গেমসেও সবসময় প্রাইজ পায়। আমি সেদিন আড় চোখে বাচ্চাটাকে দেখেছি কিন্তু কোন কথা বলিনি।
যাইহোক তোকে বলছিলাম সুপারমিট প্রোগ্রামের কথা,সেখানেও ডিজএবল এবং এ্যবল বাচ্চাদের গেমস হচ্ছিলো, সামারের এই ভীষন রোদ মাথায় নিয়ে আমাদের কাজ ছিলো বিভিন্ন খেলার কোচদেরকে সহযোগিতা করা। ছেলেমেয়েরা ফাইনাল গেমস খেলছে আর আমরা দেখছি কে ফার্স্ট। জানিস বাবু, সারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন উৎসাহ আর আবেগে ফেটে পড়ছিলো। যখনই দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছিলো তখুনি বাবা / মায়েরা বন্ধু/বান্ধবরা জোরে জোরে চিৎকার দিচ্ছিলো। সারা প্রোগামেই আমার দেশের কথা মনে পড়ছিলো। বাংলাদেশেও আমি খেলায় অংশগ্রহন করতাম না। কিন্তু মাঠের সব ম্যানেজমেন্ট এ আমার সক্রিয় উপস্থিতি থাকতো। ইয়র্ক এ কাজ করছিলাম আমি আর পিচেস (কালো জ্যামাইকান মেয়ে পিচেস আমার সহকর্মী)। হঠাৎ দেখি ক্রেগ পিছন থেকে বলছে কেমন চলছে। আমি ক্রেগ এর কাছে জানতে চাই এখানে ”যেমন খুশি তেমন সাজো” আইটেমটা হয় কিনা । ক্রেগ মাথা নাড়ে। কিন্তু আমি তো তখন আর টরোন্টোতে নেই বাবু, অমি চলে গেছি ১৯৮৬ সালে। এরশাদ সকারের আমল। সাভারের পিএটিসি ক্যাম্পাসের একদম পিছনের দিকটাকে খোলা মাঠে ঝা ঝা গরমে ফাউন্ডেশন কোর্স আয়োজিত বার্যিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ক্যম্পাসের ছেলেমেয়েরাও অংশগ্রহন করছে। যেমন খুশি তেমন সাজো পর্বে তোর সেজখালা মানে কণা, নীল কাতান পড়ে, লাল ডাই করা চুল ছেড়ে দিয়ে চোখে অবিকল সানগ্লাস পড়ে মিসেস রওশন এরশাদ সেজেছিলো। কণাকে সাজিয়েছিলো নাহিদ আন্টি। সেকি উত্তেজনা! কণাকে সামলানো দায়। উপচে পড়া মানুষের ভিড় শুধু একনজর দেখবে সবাই। সেদিন যদি পিএটিসির আংকেলরা হেল্প না করতো তাহলে খুব মুশকিল হতো। কণা রওশন এরশাদকে নকল করে বক্তৃতা করলো। সেই খেলার মাঠেই কণাকে ফার্স্ট ঘোষণা করা হয়েছিলো । কতদিন আগের কথা বাবু। ২০ বছর কি একটা দুটো দিন সোনা? জীবন থেকে সবচেয়ে দামী যা চলে যায় তা হলো সময়। আমি হাতড়ে বেড়াই স্মৃতি। একদিন ইর্য়ক ইউনিভার্সিটির এই দুইদিনের স্মৃতিতেও মরচে পড়বে বাবু। সেদিন আমি আসবো তোর হাত ধরে। তুই দৌড় দিবি আর আমি দূর থেকে দাড়িয়ে চিৎকার দেবো। জোরে বাবু, জোরে যা তোকে তো প্রথম হতেই হবে।
আদর সোনা,
তোর মা,
২ অগাষ্ট, ২০০৮ টরোন্টো।
Email:[email protected]