বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩
বাসুন,
আবারও সেই শান্ত দুপুর, যা আমার ভীষন প্রিয়। আইয়োনভিউ রোডের এই রেসিডেনসিয়াল এরিয়াটা মনে হয় অন্যসব এলাকাগুলো থেকে একটু বেশীই নীরব। নিঃশব্দ এই দুপুরে তুই ওদের সাথে উপরের বাড়িতে খেলছিস আর আমি সোফার কুশনদুটো টেনে নিয়ে কার্পেটে শুয়ে লিখছি । জীবনে কতকিছু করতে চেয়েছিলাম রে সোনা, কিন্তু কোন কোন একাকী মুহুর্তে মনে হয় আমার কিচ্ছু করার নেই , কিছুই না।
আজ আমাদের বেবীসিটিং এর দ্বিতীয় দিন,নাদেরা আর ফুয়াদ তোর বয়সী দুটো বাচ্চা। কি দিব্যি খেলছিস তোরা, আর আমার কাজ হলো অনেকটা চোখের দেখা দেখে রাখা। তাতেই আমি ঘন্টায় ৬ ডলার করে পাবো। কত গরীব দেশ থেকে আমরা পৃথিবীর এরকম একটা দেশে পড়ে আছি তুই জানিস বাবু? গত তিন বছরে বহু বাংগালীকে দেশ নিয়ে বুক চাপড়ে কষ্ট পেতে দেখেছি, কিন্তু এই এরাই সবদুঃখ ভুলে যায় যখন মাস শেষে ডলারকে টাকা দিয়ে গুন দেয়, সাহসী যোদ্ধার মতো কোমর বেধে আবার পরের বছরের প্রস্ততি নেয়। এভাবেই অনেকের জীবনে কেটে যায় ১৪/১৫ বছর, দেশপ্রেমের ’বোধের’ উপর আস্তরন পড়তে থাকে,আস্তে আস্তে আমরা হয়ে উঠি কানাডিয়ান বাংগালী। আমার আর তোর এই বাড়ির মালিকও তেমনি এক বাংগালী, প্রথম দিন বাড়ির জন্য কথা বলতে গিয়ে বুঝিনি উনার বাড়ি বাংলাদেশে। ভদ্রলোক নর্থ আমেরিকায় আছেন ২২ বছর হলো , বিয়ে করেছেন ইন্দোনেশিয়ান এক মুসলিম মেয়েকে, বাচ্চা দুটো বাংলা জানেও না, বোঝেও না। আমরা তো গত ২০ দিনে ওদেরকে কোন বাংগালী পরিবারের সাথে মিশতেও দেখিনি, তাই না রে বাসুন ? ধীরে ধীরে বেলা হচ্ছে , আজ তোদেরকে নিয়ে কাছেই একটা পার্কে যাবো। সেখানে গিয়ে আবার তোকে লিখবো, এই ফাকে তোদেরকে কিছু নাস্তা দিতে হবে।
কোথায় চলে গেলি বাসুন তুই ? বার বার বলি আমার চোখের সীমানার ভিতর থাকবি, কি ভীষন দুরন্ত হয়েছিস তুই, এত জোরে সাইকেল চালাচ্ছিস, এখনই এত গতি? জীবনের বাকী সময় কি করবিরে সোনা? জীবনে গতির সাথে ছুটে চলার যে কত বিপদ তা মায়ের জীবনটা খুড়ে দেখলেই জানতে পারবি। এখন বেলা চারটে মতো হবে, তোরা মাঠে খেলছিস আর আমার হাতে ডাইরি। সামারের এই সময়টা প্রকৃতি যে কি অনাবিল মোহময় হয়ে উঠে নিজ চোখে না দেখলে জানতাম না। প্রকৃতির তো কোন জাত/পাত নেই বাসুন, তবু সুন্দর কিছু দেখলেই নিজের দেশটার কথা মনে পড়ে। তোর হয়তো এই জ্বালাটা তৈরী হবে না। বড় বাঁচা বেঁচেছিস তোরা। পৃথিবী বিখ্যাত একজন কবি, ভিনসেন্ট আলেকজান্ডার তার এক কবি বন্ধুকে বলেছিলো ”উহু কি দারুন ভালোবেসেছো তুমি, কি অসম্ভব কষ্টই না পেয়েছো তুমি”। তেমনি বাসুন, তুই যদি সাহিত্য না পড়িস, দেশ মাটিকে ভালো না বাসিস, শিকড়ের উৎসমুল যদি না জানতে চাস তাহলে এই উক্তির যথার্থতা কখনোই বুঝবি না সোনা। বেলা বাড়ছে, সাথে সাথে রোদের তীব্রতা কমে বাতাস আরো আদুরে হয়ে উঠছে। আমার কানে রবীন্দ্রসংগীত , ”ঝড়া পাতা গো আমি তোমারই দলে” কি অপুর্ব গলা শান্তিদেবের। আমি যেন এই সুন্দর দেশে সাজানো পুতুল , সব আছে শুধু দেহে প্রান নেই মৌলিক কাজের সুযোগ না থাকলে মানুষকে স্বর্গে রাখলেও সে হাঁপিয়ে উঠবে, তেমনি হয়েছে আমার দশা বাসুন , চল আমরা বাড়ি যাই ৬টা বাজতে চলল। বাচ্চাদের বাবা/ মা ফিরে আসবে এখুনি। আদর সোনা ।
তোর মা
১২ জুলাই, ২০০৭। Email:[email protected]
পর্ব ২ পর্ব ৪