বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩২
বাসুন,
স্মৃতির পাতায় জমে থাকা ধুলো জমলে তা সরাতে কতক্ষন লাগে? বা আদৌ কোন সময় লাগে কিনা ? মানুষের চীরতরে চলে যাবার ভার কি এতটাই কঠিন হয় নাকি কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে শুধু বিস্ময়কর এক ঘোর তৈরী করে?
টরোন্টোতে এক রমজানের সন্ধ্যায় ইফতারী শেষে বাড়ি ফিরছি, পাশে বান্ধবী মঞ্জরী গাড়ি চালাচ্ছে, ওর স্বামী পিছনে বাচ্চাদের সাথে বসা। বান্ধবীর পাশের সিটে বসে বেশ আলোকিত এক শহরে গাড়ি চলছে, হালকা মেজাজে কথাও বলছি আমরা হঠাৎ সশব্দে বেজে উঠল মুঠোফোন, ফোনের ওইপ্রান্তে আমার বড়বোনের গলা, ফোন করেছে ফ্লোরিডা থেকে। শান্ত স্বরে বড়পা জানালো, চুনী চাচা রোড একসিডেন্টে মারা গেছে, ঢাকা থেকে মা ফোন করেছিলো। আমি নিবার্ক, আমার গলা আটকে আছে ছোট যন্ত্রের ভিতর, কি বললে বড়পা তুমি?”
এই তো চলে যাওয়া বাবু, মানুষ জন্মেই জানে যে তার জন্মের ঠিকুজি কি, কিন্তু চলে যাবার সময় কি জানতে পারে তার ঠিকানা কি হবে? চুনী চাচা এখন কোথায় ? উচু পাহাড় থেকে পড়া ছিন্ন দেহ কি পড়ে আছে আফ্রিকার সেই ফ্রিটাউন শহরে? এই কি পরিনতি ছিলো চুনী চাচার? বরিশাল মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা যে তরুনের জীবন গড়ে তোলার কথা ছিলো চিকিৎসক হিসেবে সে কাজ শুরু করলো বাংলাদেশের বেসরকারী সংস্থাতে, ডঃ শাহনেওয়াজ আলম খান ওরফে চুনী( সম্পর্কে যদিও চাচা হয় কিন্তু আমরা চারবোনই ওকে নাম ধরে বা চুনী করেই ডাকতাম) বিসিএস ডাক্তারীতে কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় ভালো করার পরও সেই পথ ছেড়ে এনজিও লাইনে কাজ শুরু করেছিলো। বাংলাদেশের চাকরির বাজারে মামা/চাচার জোড় ছাড়াও যে শুধু মেধা দিয়ে সফলতার শীর্ষে উঠা যায় চুনী সেই গোটাকয়েক উদাহরনের ভিতর এক জল্বজল্বে দৃষ্টান্ত। খুব অল্পদিনেই চুনী কনসার্ন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়েছিলো, আমি নিজেও তখন এনজিওতেই কাজ করতাম বলেই জানতাম চুনী কতটা উপরে উঠেছে । কিন্তু আফিস শেষে প্রায়ই যখন চুনী বাসায় আসতো আম্মাকে ভাবী, ভাবী করে চিৎকার দিতো, আমাদের সাথে বাচ্চাদের মতো আচরন করতো আমি তখন চুনীকে অনেকদিন অবাক হয়ে দেখতাম , মানুষের ভিতর কি শিশু বাস করে ? চুনী চাচা শত ব্যস্ততায় আন্তরিক ভাবে সময় দিতো, ভদ্রতা ও বিনয় যেন ওর দেহেরই একটা অংশ। ১৯৮৪ সালে পিএটিসির চাকরির সুত্রে ডাক্তার আংকেল এর পরিবারের সাথে আমাদের সখ্যতা, আজ ২৪ বছরের দীর্ঘ পথ আমাদেও দুই পরিবারের, ডাক্তার আংকেল মানে ডঃ হাসান সাইদী খান তো আমাদের পরিবারে সব বিপদের একমাত্র এবং প্রথম ভরসা। তিনিও তো আমাদের পাশাপাশি বাসায় বাস করছেন আজ প্রায় ১২ বছর, কি করে এমন একটা ঘটনাকে মোকাবেলা করছে ঢাকাতে সবাই ?
বাসুন, তোকে উপরের এই লেখাটুকু শুরু করেছিলাম দুপুর বেলা, তখনো বার বার মিডিয়াগুলোতে খুজেছি কোথাও চুনীকে নিয়ে কোন নিউজ দিয়েছে কিনা, এখন বিকাল চারটা, আমি নানান কাজ শেষ করে আবার নেট এ বসলাম, এবার প্রথম আলোতে নিউজ, ”সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশী চিকিৎসক নিহত” । এই তো বাবু, এক নিমেষেই জীবন প্রদীপ নিভে গেলো চুনীর, কেমন করে এই শোক কাটাবে আপনজনেরা? কি করছে সবাই?কোনদিন কি জানতাম যে চুনীকে দেখতে পাবো না, একবারও না? এ কেমন চলে যাওয়া চুনী?কেন চলে গেলি এভাবে? তোর সাথে যে আরো কিছু কাজ বাকী ছিলো চুনী? কেন রেখে গেলি শুধু স্মৃতির কান্না?
বাবু, তুই জন্মাবার পর পরই চুনী হসপিটালে এসে তোর মুখ ধরে বলেছিলো” ভাইয়া তাড়াতাড়ি বড় হ, অনেক কাজ বাকী” কই চুনী , সব কাজ ফাকি দিয়ে আফ্রিকার পাহাড়ে গিয়ে কেন নিজেকে লুকিয়ে ফেললি, কোথায় খুজবো তোক চুনী?
বাসুন আমার কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, আজ আর না।
তোর মা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৮
Email:[email protected]