বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩৩

বাসুন,

বিচিত্র কারনে আজকে সকাল থেকেই আমার মনটা প্রসন্নতায় ভরে আছে, মনে হচ্ছে জীবনের কাছে আমার আর কি চাইবার আছে? তাহলে কি আমি পৃথিবী থেকে তাড়াতাড়ি চলে যাবো বাবু? আমি তো আরো দীঘর্দিন এই পৃথিবীতে থাকতে চাই সোনাতোর ছোট্ট শিশুমুখের দিকে তাকিয়ে অপরিসীম আনন্দ,সাহ আর ভালোলাগা দিয়ে আমি প্রতিটা দিন শুরু করি বাবু, অন্তত আর কেউ না জানুক তুই তো জানিস বাবু আমাদের এই ছোট সংসার আমরা কত ভালোবাসি?

বাবু, দীর্ঘ প্রতিক্ষীত ঈদ আজ, সপ্তাহের ঠিক মাঝের দিন বলেই টরোন্টো শহরে সেভাবে ইদের আমেজ আসেনি , তোকে স্কুলে পাঠিয়েছি সকালে,আমিও অফিসে একটু বুড়ি ছুঁয়ে এসেছিএখন দুপুর, বাইরেটা আজ যেন নীলাম্বরী সাজে সেজেছে, আমার নতুন এপার্টমেন্টের জানালার কাঁচ দিয়ে আমি অনাবৃত আকাশ দেখতে পারছি, দূরে অন্টারিও লেকের নীল আলো, প্রকৃতি যে এত রূপের আঁধার হয় তা যেন বহুবারের মতো আবার বিস্মিত করছে আমাকে, জানিস বাবু, আবার আমার সেই প্রিয় সময়, মানে ভর দুপুর, আমাকে এই নির্জন দুপুর উন্মাদনা দিয়ে ভরে দিয়েছে আজীবনআমি নিশি পাওয়া মানুষের মতো নিজের পৃথিবীতে ঘুরতে থাকি এইসময়টা, কি যেন বলতে চাই আমি, কি যেন খুঁজে ফিরেছি অমি এই দুপুর গুলোতেআমার এখনো  পরিস্কার মনে পড়ে, সাভারে পিএটিসিতে যখন থাকতাম, ক্লাস টেন/নাইনে পড়ি, আমাদের বাসা থেকে জানালা দিয়ে তাকালে আরিচা রোডের অনেকটা অংশ দেখা যেতো, বড় বড় গাড়ি চলতো, আমি ঠিক হিসেব কষে বলতো পারবো না কতদিন আমি জানালার শিক ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতাম কি দেখতাম আমি? সেই গতিময় রাস্তায় কি খুঁজতাম আমি? আমার ভবিষৎ? আমার আগত জীবন? বা আমার এই জীবনটা, যা এখন যাপন করছি তাই কি দেখতাম আমি? বা আমার এই একাকিত্ব? ঠিক কতদিন ধরে আমি স্বপ্নটা বুনেছি আমার মনে পড়ে না, তবে ১৫ বছর তো চোখ বন্ধ করেই বলা যায় যে, আমি একা থাকতে চাইতাম বাবু , তুই পৃথিবীতে আসার আরো বছর চারেক আগে, যখন আমি জাহাংগীরনগরে হলে থাকতাম, আমার রুমের জানালা দিয়ে ক্যাম্পাসের অপূর্ব প্রকৃতি দেখা যেতো তখন থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম, আমার নিজের একটা জীবন হবে, শুধুই আমার, কোনদিন কারো মুখাপেক্ষি যেন হতে না হয়, সারাদিন কাজ সেরে ফিরে আসবো আমার নিজের সংসারে, সময় কাটাবো আমার নিজের মতো করেবাবু, সেই জীবনটা যাপন করছি আমি, শুধু মাঝখান দিয়ে তুই এসে আরো ভরিয়ে দিয়েছিস আমার জীবনটাকেবাবু তোকে ছাড়া আমার জীবনটা পার হতো না, কিছুতেই না সোনা, আমি বহুবার ভেবেছি কি হতো তুই যদি না থাকতি আমার? মানুষের অবলস্বন লাগে,  এটা জলের মতো সত্যি সোনা, এই যে ঈদের একটা দিন, তুই স্কুলে গেছিস, আমি রান্না করেছি, গতরাতে তোকে ঈদের গিফট কিনে দিয়েছি এসবই তো জীবনের পরম পাওয়া বাবু

তবুও নির্জন  দুপুর আমাকে মাতাল করে বাবু, না বলা ভাষায় মুহুর্ত, ঘন্টা, মাস, বছর কেটে যায় আমার দুপুর শেষ হয় না সোনা ফাঁকা ঘরের নির্জন কান্নার এই প্রতিধ্বনি আমাকে শক্তি দেয়, হয়তো কোন দুপুরে শান্তিদেবের ভরাট গলায় রবিন্দ্রনাথের সেই গানটার মতো হয়ে উঠে জীবন ঝরা পাতা গো, আমি তোমারই দলে, ঝরা পাতা

তোকে ঈদের অনেক অনেক আদর সোনা

তোর মা

টরোন্টো, ১ লা অক্টোবর, ২০০৮

Email:[email protected]

পর্ব ৩২