বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩৪

বাসুন,

রাস্তাঘাট একেবারেই জনমানবশুন্য এই তো, এইমাত্র তুই আর আমি আমাদের মোড়ের দোকান থেকে কফি খেয়ে বাড়ি ফিরলাম, রাত দশটা বাজেলং উইকএন্ডর আজ মাঝের দিন, তাই তাড়াতাড়ি সব বন্ধ হয়ে যাবে আজকে, আর আগামীকাল তো সব বন্ধ থাকবেছুটির দিনের সার্থকতা এইসব দেশে যত আলোড়ন তোলে দেশে ততটা দেখিনি

আমি আর তুই প্লান করেছি ছুটির এই তিনদিন আমরা আমাদের বড়িতেই থাকবো অন্য কোথাও যাবো না, আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তুই  আমাদের এই নতুন এর্পাটমেন্টের ভিতরে তোর বন্ধুদের সাথে খেলছিস আর আমি পড়ে আছি ইন্টারনেট ও আমার নিজের জগ নিয়েতবুও একঘেয়েমি সময়ে আমরা মা/বেটা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম বলেই একটু আগে বাইরের হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম তুই তো আমার লক্ষ্মী ছেলে হয়েছিস,কোন দুঃশ্চচিন্তা হয় না তোকে নিয়ে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি না থাকলেও তুই দিব্যি তোর জীবন গড়ে নিতে পারবিআজ দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন বাঙলা ওয়েব সাইটগুলো ঘুরছিলামহঠা চোখে পড়ল শবনম নাদিয়ার লেখা, আমাদের সেই ছোট্ট মেয়ে দিয়ার লেখাএখন কত বড় হয়ে গেছে, কি সাবলীল লেখালেখি করে দিয়া,ভাবতেও অবাক লাগে এত্তটুকু ছোট ছিলো দিয়া, জাহাংগীরনগরে বিন্দুদের পাশের বাসাতে থাকতো ওরা , আমি তখন  ক্লাস টেন/নাইনে পড়ি, দিয়া তখন থ্রি/ফোরে হয়তো , দিয়া আর রাতুল এসে দাড়াতো ছাদে, বিন্দুদের আর দিয়াদের একই ছাদ, বিন্দুর বাড়িতে ছিলো আমার অবাধ যাতায়াত, সেই সুত্রে দিয়া রাতুলও যেন আমাদের ছোট ভাইবোনআরো পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে নুরুল ইসলাম চাচা/ চাচী দুজনকেই ইংরেজীর  শিক্ষক হিসেবে  পেয়েছিলাম আমরাচাচীর সেই মাথা উঁচু করে চলার ভংগীটা এখনো জ্বলজ্বল করছে আমার চোখেসেই শবনম নাদিয়া দিয়া এখন  তুখোড় পারদর্শি  হয়েছে লেখালেখিতে, উইমেন ইস্যুতে কি এনালাইটিক্যাল লেখা লিখেছে, আমি পড়ছিলাম আর আমার চোখের সামনে ছোট স্কার্ট পড়া দিয়ার লিকলিকে শরীরটা যেন দৌড়ঝাপ করছিলো, কেমন হয়েছে দিয়া দেখতে এখন, এত গভীর লেখা নিশ্চয়ই ওর একান্ত  চর্চারই  ফসল

আজ প্রায় টানা তিনচারঘন্টা বিভিন্ন লেখা পড়তে পড়তেই অন্ধকার নেমে এসেছিলো চারিদিকে, তুই তো পাশের ঘরে কখনো বই পড়ছিস, কখনো গেমস খেলছিস আবার কখনো ছবি আকাঁ  চলছেচোখের সামনে দিয়ে আমাদের দুটো দিন চলেও গেলো বাবুএদিকে, আরো একটা  অপেক্ষা আমাদের দুজনকে অস্থির করছে প্রতিমুহুর্ততোর ছোটখালা শাহিন সাদাকালোর একটা প্রোগ্রামে একমাসের জন্য এসেছে আমেরিকাতে।  প্রায় ১৫ বছর পর আমাদের চারবোনর একসাথে হবার কথা কিন্ত আমি আর তুই কানাডিয়ান পাসর্পোট হাতে পাইনি, সিটিজেনশীপ টেস্ট দিয়ে বসে আছিদিন তো আর শেষ হচ্ছে না সোনা, আপেক্ষার ভার এবার  সত্যিই অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে, কবে যেতে পারবো বোনদের কাছে? ১৯৯২ সালে যখন ঢাকা থেকে  বড়পাকে আমেরিকার ফ্ল্রাইটে তুলে দিয়েছিলাম সেদিন কি জানতাম এই বোনকে দেখতে আমার এক  যুগেরও বেশী সময় অপেক্ষা করতে হবে? অথচ  আজ বিদেশে এসে বুঝতে পারছি কেন আমেরিকা কানাডাকে মানুষ স্বপ্নের দেশ বলে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ দেশের  মানুষ এইসব দেশে একবার ঢুকে আর বের হতে পারেনি, কাগজপত্র ঠিক নেই বলে তারা অপেক্ষা করেছে ৩০/৪০ বছর, এরকম অনেক পরিবারকেই আমি দেখেছি যারা বিদেশ থাকাকালীন সময়ে বাব/ মা সহ পরিবারের বহু  প্রিয়জনকে হারিয়েছে কিন্তু চোখের দেখা দেখতে যেতে পারেনি

বাবু  যখনই তোকে  এই ধারাবাহিক লেখাটা লিখতে বসি, ভাবি যে কিছুতেই দুঃখের বা কষ্টের  কথা লিখবো না, কিন্তু বাস্তবতা এড়িয়ে লেখালেখি করা আমার দ্বারা হবে না, কখনই নাঅনেকেই আমাকে বলেছে আমার লেখা নাকি পড়লেই বোঝা যায় আমার নাম পড়ার দরকার পড়ে নাএটা কমপ্লিমেন্ট  নাকি দুর্বলতা জানি না, তবে এই লেখাটা লিখলে আমি কিছুটা রিলাক্স বোধ করি, একটু হালকা বোধ করিবাবু, জীবনের অনেকটা সময়জুড়ে আমাকে শুনতে হয়েছে আমি  নাকি অনেক  কথা বলি, সেদিন কি জানতাম শুধু শেয়ার করতে না পারার কষ্টও আমাকে  তাড়িত করবে প্রতিমুহুর্ত? কবে বড় হয়ে তুই আমার বন্ধু হবি সোনা? সেদিনের অপেক্ষাতে যে আমার বেলা বয়ে যায় বাসুন

আদর,

তোর মা , ১২ ই অক্টোবর ২০০৮ 

Email:[email protected]

পর্ব ৩৩