বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩৫
বাসুন,
কোন কোন মুহুর্ত সময় এবং ঘন্টা থাকে যখন আমার আর তোর কিছুই করার থাকে না,কিছুই না,তবুও আমরা দুজনই শুক্রবার সকাল থেকেই প্লান করতে থাকি,আগামী দুদিন (শনি/রবি) বাড়িতেই থাকবো। তুই যখন বড় হবি তখন কি তোর এই সময়গুলোর কথা মনে থাকবে বাবু?তোর কি কখনো মনে পড়বে মায়ের সাথে ছোটবেলায় কেমন সময় কাটাতি তুই?
আজকে শনিবার, সারাদিন কত শত শত ভাবনা ঘিরে রাখে আমাকে, আমি ঘরের কাজ ফাঁকে ফাঁকে তোকে এই চিঠিটা লেখার শব্দ আর ভাবনাগুলোকে সাজাতে থাকি।কিন্তু তারপরও চিঠিটা লিখতে আমার অনেক আয়োজন করতে হয়, জানিস অনেক আগে, মানে আমি যখন ক্লাস টেন/ নাইনে পড়ি তখন কোন এক লেখায় পড়েছিলাম,লেখকের প্রতিটা শব্দই তার সন্তান।আজ অনেকদিন পরে এই নিঃশব্দ রাতে কথাটা খুব সত্য মনে হচ্ছে।আমি আসলে শুয়েই পড়েছিলাম তোর সাথে,মনে হচ্ছিলো আজ রাতে আর লিখতেই পারবো না,কারন সারাদিনে প্রায় চারবার চিঠিটা ডিলিট করেছি, এটা পাচঁবার বসলাম লিখতে। প্রতিবার ভাবনা বদলেছে,ইচেছ বদলেছে,একবার মনে হয়েছে কি লাভ লিখে? কোথায় কোন বদল ঘটবে আমার এই লেখা দিয়ে?সন্ধ্যার সময় বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে ভয়াভহ সব(যদিও বহুদিন হলো এসব খবরে দেশের মানুষের গাঁ সওয়া হয়ে গেছে, তবুও প্রতিটি ঘটনাই নতুন করে অনিরাপত্তার জন্ম দেয়) খবর পড়ছিলাম, দেশের ধর্মীয় সম্প্রদায় নতুন এয়ারর্পোটের কাছে লালনের মুর্তি সরিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে হজ্বে যাবার পথে এমন মুর্তি রাখা যাবে না,সরকারকে অবিলম্বে মুর্তি সরাতে হবে। কি আস্পর্দা একদল মানুষের, আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই সাহস দেখলে। এইসব গুটিকয়েক ঠুনকো মৌলভি কি মনে করে সকল মানুষের মুল্যবোধ আর ধর্মের দায়িত্ব তাদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে? কি করে রাষ্ট্র এসব উগ্র ধর্মীয়গোষ্টির সাহস কে প্রশ্রয় দেয়? কে ওদেরকে বলেছে মুর্তি দেখলে হজ্বে যাওয়া যাবে না, বা মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগবে ? তাহলে মুসলমান বাদে অন্যসব মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করার দায়িত্ব কি ওরা নেবে নাকি আল্লাহ বলেছেন মুসলমান বাদে সব মানুষকে পা দিয়ে পিষে ফেলতে? যদি আল্লার বানী এত ঠুনকো হয় তাহলে তো সেই বানী নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন তোলা উচিত। বাংলাদেশের মতো দেশেই কেবল ধর্ম নিয়ে এত নোংরা বাড়াবাড়ি সম্ভব। মাত্র কয়েকদিন আগে প্রগতিশীল লেখক তসলিমা এক সাক্ষাৎকারে বলেছে----”মৌলবাদীদের ততটা নোংরা মনে হয় না, যতটা মনে হয় দেশের মুখোশধারী প্রগতিশীলদেল” বরাবরই তসলিমা সত্য বলেছে, এবারও তসলিমার সত্যটা বড় বেশী সত্যই মনে হচ্ছে। সরকারের প্রগতিশীলতা নিয়ে যারা এতদিন কথা বলেছে তারা নিশ্চয়ই পায়ের তলায় সর্ষেদানা টের পাবেন ।
বিদেশে বসে থেকেও শান্তি পাই না সোনা, তাই ভাবছিলাম কি হবে এই সমান্য জায়গা থেকে শব্দ উচ্চারন করে যদি একজন অসৎ/নোংরা/অন্ধ ধর্মীয় মানুষের এই বিভৎস কার্যক্রমকে কঠোরভাবে দমন করা না যায়? কি করে বর্তমান সরকার এদেরকে মদদ জোগাচ্ছে?আর কতদিনে আমরা সব মানুষের মুল্যবোধ আর অনুভুতিকে সমান জায়গা থেকে বিবেচনা করবো?
বাসুন, আজকে সারাদিনে আরো অনেকগুলো ভাবনা তোকে লিখবো বলে ইচ্ছে ছিলো, শেষ করলাম মনের ভিতরে পুষে রাখা এই যন্ত্রনা টুকু বলে। কোনদিন মানুষকে ধর্ম দিয়ে বিচার করবি না সোনা, কোনদিন না। যদি সৃষ্টিকর্তা বিচারের দায়িত্ব নেন তবে তিনি সবারটাই নেবেন, শুধু যে হজ্বে যাবে বা পাচঁ ওয়াক্ত মাথা ঠুকেছেন তাকেই আলাদা করা হবে না ---- এটুকু নিশ্চিত জানিস সোনা।
আদর
তোর মা
১৭ই অক্টোবর ২০০৮।
Email:[email protected]