বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩৬
বাসুন,
সময়টা আবারো আমার সেই প্রিয় দুপুর, বাথরুমের বাথটাবে দীর্ঘসময় গোসল করবি বলেই তুই গোসলে ডুকেছিস, আর আমার অখন্ড অবসর। মাত্র দুদিন আগে বাংলাদেশের লেখক ও কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের পায়ে পায়ে নামে একটা বই হাতে পেয়েছি, আক্ষরিক অর্থেই বইটাকে আমি গিলছি। যেন মাত্র ঘটে যাওয়া কতগুলো সময়ের কথা বলে যাচ্ছেন তিনি, প্রতিটা পাতায় জীবন্ত মানুষ আমার সামনে, বইটা নিয়ে অনেক অনুভুতি, অনেক বলা/ না বলা কথা, ইচ্ছে/অনিচ্ছে, ভালো/ মন্দলাগা, সব প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে। হাতের কাছেই সেল ফোন, ছুটির দিনের অফুরন্ত অবসর বার বার ফোন করছি সেরীনকে, আমার বন্ধু, বাংলাদেশের পত্রিকায় কাজ করতো বলেই অনেক বিখ্যাত মানুষের নাড়ীর খোঁজ জানে ও এবং ওর জামাই, বার বারই সেরীনকে বলছি আমি, কেন লেখক এটা বললেন, ওটা বললেন? সেরীন বলে, তুই বই শেষ করে একবারে প্রশ্ন কর।
টরোন্টো শহরে হু হু করে বাতাস বইছে, চারিদিকে ন্যাংটোপাতাবীহিন শুকনো গাছ, এই শহরে চাইলেও একটা ভালো বই পাওয়া যায়না, দেশ থেকে ১৪ হাজার মাইল দূরে থাকলেও বাংলা বই দেখলেই যেন ছুতে ইচ্ছে করে, তাই আমি বই একটু চেখে চেখেই পড়ি, যদি শেষ হয়ে যায় । তবু পারি না নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে, কারন লেখক আমাদের সমসাময়িক সময়ের কথাই লিখেছেন, আজকের মিডিয়া জগতের অনুপুংখ বনর্না দিয়েছেন। পড়ছি আর ভাবছি এখুনি উঠে কিছু একটা লিখি, এখন তো কথা না বললেই নয়, এমন সব বিষয় যে মনের ভিতরে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া তৈরী করে। এভাবেই কখন বইটার ৬৪ পাতায় এসেছি টের পাইনি, বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসূর রাহমান ও লেখক এর কথোপকথন এর শেষ অংশটুকু পড়েই আমি বইটা বন্ধ করি।
এমন প্রানবন্ত একটা বইযেরন জন্য লেখক আবু হাসান শাহরিয়ারকে অভিনন্দন। কবি রাহমান ছোটবেলার কথা বলে শেষ করলেন এইরকমভাবে ” মানুষের জীবন খুবই ছোট। ছোট এই মানবজীবনে শৈশবই হচ্ছে বেহেস্ত”। আমার চোখে পানি টস টস করে উঠে, শামসূর রাহমানের মতো এতো অনুভুতিসম্পন্ন কবির পক্ষেই কি এমন নিখাদ অনুভুতিকে বলা সম্ভব, নাকি আমাদের মতো মানুষও তা বলতে পারে ? ছোটবেলার স্মৃতিকে কবি মনে রেখেছেন কি আর্শ্চষভাবে। কবি চোখ বুজলেই দেখতে পান ৪৬ মাহুৎটুলির সেই সময় এর কথা, তার চোখে নাকি ভেসে উঠে নানী বাড়ি, নানীর সাথে কবির স্মৃতি, নানীর কাছে কবির চা চেয়ে খাবার গল্প বলে যাচ্ছেন অর্নগল কবি।
বাবু, আমি তো কবি না, জীবনের অনেকটা সময় চলে গেছে ভাত কাপড়ের সন্ধানে, তবুও ছোটবেলা তাড়িয়ে নেয় কেন? পায়ে পায়ে বইটার ৬৪ পাতার শেষ লাইন আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিলো, আমিও নানীর বাড়িতে বড় হয়েছি রে সোনা, নানীর পায়ে পায়ে ঘুরিছে গোটা বাল্যকাল। আমার বাবার বিদেশে পড়াশোনার কারনেই রংপুরের নানাবাড়িতে ছিলাম পাঁচ বছর, গোটা বাল্যকাল জুড়ে আছে নানীর শরীরের গন্ধ, আমার সেই নানী আজ অসুস্থ্য, পড়ে আছেন রংপুরে। স্মৃতিবিজড়িত সেই নানাবাড়িতেই চলৎশক্তিহীন বিছানায় নানীকে আমিও কবির মতোই চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি। ১৪ হাজার মাইল দূর থেকে এই অনুভুতিকে এই মুহুর্তে জাগিয়ে তুললেন লেখক আবু হাসান শাহরিয়ার। কবি চলে গেছে সেই কবে, কিন্তু সৃষ্টি রয়ে গেছে, সেই কবিকেই পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন আরেক কবি, আবু হাসান শাহরিয়ার । বাবু, তোদের কি এভাবে আলোড়িত হবার সুযোগ হবে? তুই ও তো বড় হয়েছিস নানীর কাছে, আমার মাও তো তোকে বুকে নিয়েই একদিন নিংড়ে দিয়েছিলো তার সব ভালোবাসা। কবির মতো গভীর জীবনবোধ তৈরী না হলে কি কোনদিন বাংলাদেশ নামক একটা রাষ্ট্রের আনন্দ / বেদনা, দুঃখ /কষ্ট তোলপাড় করবে তোকে বা তোদেরকে?
২৬ অক্টোবর, ২০০৮
টরোন্টো।
Email:[email protected]