বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৬

বাসুন,
সকাল নয়টা,আজও ছুটির দিন । গতকাল রাত থেকেই নিজের ভিতরটাতে খুব অস্থির বোধ করছি , বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ও প্রধান লেখক হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি বইটা আমার হাতে । কখন পড়া শুরু করবো আমি ? সত্যিই জানিনা সোনা। হাসান স্যারের কথা আমি যত শুনেছি তত অবাক হয়েছি ,এরপর স্যারের বই পড়ে তো অবাক। শিল্পের রূপ কি এত জীবন ঘনিষ্ট হয় কখনো? স্যার লেখেন কি করে? কেমন করে স্যার বলে যান সময়ের কথা? ইতিহাসের কথা? স্যারের লেখা নামহীন গ্রোত্রহীন , জীবন ঘসে আগুন, পাতালে হাসপাতালে, মা মেয়ের সংসার  ইত্যাদি গল্পতে আছে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অন্তর্নিহিত কথা, একটি দেশের ও জনমানুষের ব্যপ্তি ও যুদ্ধের কথা । তোরা কি কোনও দিনও স্যারদের কথা জানবি সোনা ? একটি দেশের সময় ও কালের কথা কি কোনদিনও তোরা জানতে চাইবি বাসুন?

সেদিন বাংলাদেশী চার/পাচজন তরুন ছেলেমেয়ে যাদের বয়স ২৭/২৮ হবে, ওদের কাছে জিঞ্জেস করেছিলাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস , শওকত ওসমান , শওকত আলী বা হাসান অজিজুল হকের নাম শুনেছে কিনা । ওরা এমন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালো মনে হলো আমি যেন বা বদ্ধ উন্মাদ । বাসুন , এই কি তোদেরকে বড় করবার জন্য আমরা জীবনপাত করছি? তোরা নাকি এসব দেশে থাকলে ইন্টারন্যশনাল মানুষ তৈরী হবি , পৃথিবী কোন দেশে গেলেই নাকি তোদের চাকরির কোন সমস্যা হবে না ,বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে নাকি কোন সম্ভবনা নেই , ইত্যাদি নানান কথা শুনে শুনে গত আড়াই বছরে আমার কান পচে গেছে বাবু। তবুও যখন ইলিয়াস স্যারের একটা বই হাতে নেই বা শওকত আলীর কোন প্রবন্ধ শুরু করি, আমার তো মনে হয় এইতো সত্যিকার শিক্ষিত এবং আলোকিত মানুষ ,শিক্ষা তো এমনই হওয়া দরকার । মানুষ কি কেবলই নিজেকে সাব্বোর্চ নিরাপদ রাখবার জন্যই বেঁচে থাকবে, বা কেবলই উচু মানের খাওয়া/পড়া বা বসবাসকে নিশ্চিত করবার জন্যই একটা জীবন? আর উচু মানের বলছিই বা কাকে ? কে আমাদেরকে এই ধারনা দিয়েছে যে, কানাডা আমেরিকার জীবনযাপন উচু আর আমার দেশের মাটির ঘর খুব নিচু? তাহলে কি আমি অস্বীকার করবো আমার পুর্বপুরুষের ইতিহাস? আমার বাবার সব সংগ্রাম ও যাপিত জীবনকে ?  যার ফসল আমি, আজকে এই তোর মা, যে জীবনকে জয় করবার জন্য তোর হাত ধরে পাড়ি দিয়েছে সাত সমুদ্র । সেদিন কে আমাকে শক্তি দিয়োছলো বাসুন ? যেদিন তোকে নিয়ে আমি একা প্লেনে উঠেছিলাম? আমি জীবনকে বুঝে নেবার সাহস পেয়েছিলাম আমার পিতা /পিতামহ ও তার পুর্বপুরুষের কাছ থেকে ,তারা জন্মে ছিলেন বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগায়ে, তারা সেই গ্রামের আলোকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ এর অভ্যন্তরে, সেখানেই রচিত হয়েছিলো শহর ও গ্রামের ধারনা আর সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতাতেই আজকে তোর আর আমার জীবন। তাহলে কেন পিছনের ফেলে  আসা সময়কে অস্বীকার করে বাচা বাসুন ?

জীবনকে যতবেশী গভীর থেকে দেখবি তত বেশী অর্জন করবি সোনা । আর তার চেয়েও বড় কথা , কে তোর/আমার ভিতরে উচু / নিচুর এই ধারনা জন্ম দিলো বাবু? সেই প্রশ্নেরই তো বোঝাপড়া হলো না আজ অবধি । তোকে বলি সোনা , মনোযোগ দিয়ে শোন , যা কিছু তোর নিজের (ভাষা ,শিল্প , সাহিত্য , জীবনবোধ , সর্বপরি সংস্কৃতি) সবকিছু জানা এবং বোঝার নিরন্তর চেষ্টা করবি , জানতে চাইবি তোর উৎস কি ? কোথা থেকে আজকের এই পৃথিবী দেখার সুয়োগ হলো তোর,কেমন করে কোন জীবনের ভিতর দিয়ে তুই আজকের এই জীবনটাকে অর্জন করলি? কোথায় তোর শিকড় ? তাহলে দেখবি জীবন কি অসম্ভব সুন্দর ও পরিপুর্ন। এই যে তোকে একটুকরো চিরকুট লিখি আমি , তাতেই মনে হয় কতকিছু করার বাকী আছে জীবনে,কেন জীবনের সময় এত অল্প?কেন মানুষ দীর্ঘদিন বাচে না? আমি নিরন্তর যুদ্ধ করি আত্বসন্মান নিয়ে বেচে থাকার জন্য, স্রোতে গা ভাসিয়ে বেচে থাকা নয় বাবু, নতুন নতুন অর্জনকে দেখতে চাই আমি , মাথা উচু করে বাচতে চাই বলেই সৃষ্টিশীল মানুষেরা আমার কাছে পৃথিবী চেয়ে বড় হয়ে উঠেন ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেই সাদা দ্বিতল বাড়িতে হাসান আজিজুল হক স্যার এখন কেমন আছেন জানিনা তবে এই টরোন্টো শহরে আগামী বেশকিছুদিন আমি স্যারের  সাথে  থাকবো আমার সাথে থাকবে স্যারের প্রথম উপন্যাস আগুনপাখি । স্যারকে অভিনন্দন সময়কে ইতিহাসে রুপ দেবার জন্য। এই বেলা আর না বাবু, সারা ঘরের কাজ আমার দিকে তাকিয়ে আছে , পরে আবার লিখবো।

তোর মা,

২৯ জুলাই ২০০৭                                                                                                Email:[email protected]

পর্ব                                                                                   পর্ব