গয়নামুনাজ এর সাথে আর সংসার করা কোনভাবেই হবে না --- এই সিদ্ধান্ত যখন দীপার মনে প্রায় পাকাপাকি ভাবে আসন গেঢ়ে বসে তখুনি কাজটা করে দীপা । মায়ের কাছে রাখা গয়নাগুলো একটা ছোট রুমালে বেঁধে মুনাজের হাতে দিয়ে বলে গয়নাগুলো ছোটবু’র হাতে দিও। মুনাজ প্রথমে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না, এখনোতো ওরা কাগজে পত্রে স্বামী/স্ত্রী তাহলে দীপা গয়না ফেরত দিচ্ছে কেন? মুনাজের বুঝতে পারার কথাও না কারন গল্পটা ছোটবু মানে মুনাজের প্রায় মায়ের বয়সী বড়বোন বিনু, যাকে সবাই ছোটবু বলে দীপাও তাই ডাকতো সেই আপাই করেছিলেন। অনেক আদর আর ভালোবাসা পেয়েছে দীপা ওর শ্বশুড়বাড়ি থেকে, সংসার জীবনের পুরো সময়টা ধরেই দীপার কাছে সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিলো । দীপার বিয়ের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ছোটবু’র শংকরের বাড়িতে বসেই গল্পটা বলেছিলেন। মুনাজের সবচেয়ে বড় ভাই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন সেটা মেনে নেয়নি পরিবারের কেউ এবং বড় ভাবীও নাকি একদিন খুলনা থেকে দাদার উপর রাগ করে ছোট ননদের বাড়িতে চলে এসেছিলো । ছোটবু’ দুদিন পরে সব শুনে বড় ভাবীকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলো “খুব ভালো করেছো ভাবী, আর ফিরবে না তুমি। এবার নিজের পায়ে দাড়িয়ে নিজেকে চালানোর চেষ্টা করো। দাদার এতদিনের সংসার, তবুও এত নীচে নামলো। একবার নিজের মেয়েদের দিকে পর্যন্ত তাকালো না। ভাবী, তুমি নতুন করে ভাবো। ”
নির্জন শান্ত দুপুরবেলা দীপা তখন অফিস থেকে লাঞ্চ আওয়ারে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলো ছোটবুর বাড়িতে । কিন্ত গল্পের এইটুকু বলেই ছোটবু বলল, আয় ভাত খাবি আয় । গল্পের মাঝে ছেদ টেনে দিয়েছিলো বুবু। কিন্তু দীপার মন সরেনি, শেষটুকু শোনার জন্য ভীষন আকুলতা তৈরী হয়েছিলো তার মধ্যে। তাই আবার ছোটবু’কে কাছে টেনে নিয়ে দীপা বলেছিলো, কি হলো তারপর? বড়ভাবী কি করলো বলো না আমাকে। ছোটবু সেদিন একটু ব্যঙ্গ করেই বলেছিলো “অত কি সোজা? মেয়েরা চাইলেই কি স্বামীর বাড়ি ছাড়তে পারে ? পেটে বিদ্যা আর সাহস থাকতে হয়। ভাবী পড়শোনা তো করেছে ছাই, শুধু দাদার সাথে প্রেমই করেছিলো ক্লাস নাইন থেকে। কি আর করবে? নিজের বাপের বাড়িতে ফিরতে পারবে না, আবার নিজেও কিছু করতে পারবে না, আমিই বা কতদিন রাখবো বল ? এদিকে করেছে কি শোন, নিজে তো দাদার উপর রাগ করে এসেছে, দেখি দু’দিন পরে আমার হাতে গয়নার বড় একটা টোপলা দিয়ে বলে, বিনু এটা একটু সামলে রাখো তো । আমি তো অবাক হয়ে বললাম এটা কি? উনি বললেন আমার সব গয়না নিয়ে এসেছি । তুই ভাব দীপা, দাদাকে ছেড়ে এসেছে কিন্তু দাদার আর আমাদের গয়নাগুলোকে ভোলেনি। আমিও সুযোগ বুঝে বললাম, গয়না গুলো দাদার মুখে ছুড়ে মারোনি কেন? ওগুলো সাথে এনেছো কেন? এগুলো তো কোনটাই তোমার না।“
ছোটবু’র সাথে সেদিন আর কথা হয়নি। দীপা আর মুনাজ রাতের খাবার শেষে বাড়ি ফিরেছিলো যথারীতি। কিন্তু বিয়ের এতবছর পরেও এই গল্প দীপাকে আপ্লুত করে। বড় ভাবী দীপাকে আদর করতো ভীষন, যতবার দীপা খুলনায় বেড়াতে গিয়ে ভাবীকে দেখতো ততবার ভাবতো, কেন ভাবী শুধু দুটো ভাত কাপড়ের জন্য এভাবে বেঁচে আছে ? দাদার ভালোবাসাতো কবেই ভাগাভাগি গয়ে গেছে অন্য এক নারীর সাথে। তাহলে কেন শুধু এই নিরর্থক বয়ে বেড়ানো জীবন?
দীপা আর মুনাজকে আরো ছয়বছর পরে সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছিলো যে, ওরা একসাথে থাকতে পারবো না। সেদিনও দীপার চাকরি ছিলো না, বরং সাথে ছিলো ৯ মাসের দুধের শিশু । মায়ের বাড়িতে ছোটশিশুকে কোলে নিয়ে চলে এসেছিলো দীপা। হ্যা, সেদিন দীপার মা এবং পরিবারের সবাই দীপাকে ভালোভাবেই সাহস যুগিয়েছিলো। কেন যোগাবে না ? দীপা জানতো, কারো গলগ্রহ হয়ে থাকার জন্য তার এই জীবন তৈরী হয়নি । তাই দীপা ঠিক পরের দিনই মায়ের আলমারিতে রাখা গয়নাগুলো নিয়ে মুনাজের হাতে দিয়ে বলেছিলো, “এগুলো নিয়ে ছোটবুকে দিও, বলো, আমি দিয়েছি। ” মুনাজ কোন কথা বলেনি , নীরবে দীপার কথা পালন করেছে ।
সেই ১৯৯৪ সালে দীপার বিয়ে , ২০০১ সালে দীপা সংসার ছাড়ে। আর আজ ২০০৭ সাল মোট ১১ বছর। ছোটবু’ চলে গেছেন পরপারে। মুনাজ আবার সংসার পেতেছে। বছরতিনেক আগে দীপা ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে এসছে টরোন্টোতে। আজ টরোন্টোতে ভীষন কুয়াশা পড়েছে। দীপার সেই নয় মাসের ছোট্ট শিশু এখন সাড়ে সাত বছরের দুরন্ত ছেলে । দীপা একটা ট্রেনিং গ্রোগাম থেকে হাফ আওয়ারে চলে এসেছে বাড়িতে। সেই ১৯৯৪ সালেও হাফ আওয়ারে ছোটবু’র বাড়িতে গিয়েছিলো। আসছে শনিবারে দীপা একটা বিয়ের রিসেপশন গ্রোগ্রামে যাবে। হঠাৎ দীপার মনে হলো, সারা বাড়িতে তো একদানা গয়নাও নেই। আর তখনই সাথে সাথেই গয়নার গল্পটা মনে পড়ে ওর । গয়নার কথা কতদিন ভাবেনি দীপা, কতদিন হয়ে গেলো দীপা শুধু সাহস নিয়ে সময়কে অতিক্রম করছে। আজও ট্রেনিং থেকে বাড়ি ডোকার পরেই শান্ত, নীরব বাড়ি। দীপার নিজস্ব বাড়ি , নিজের হাতে গড়া এই ছোট সংসার দীপার। বড় বেশী শক্তি আর দৃঢ়তা নিয়ে বেঁচে আছে ও।
ছোট গয়নার বক্সের আলো দীপার কাছে বড় বেশী ম্রীয়মান, বড় বেশী দীপ্তিহীন মনে হয়।
টরোন্টো, কানাডা । Email:[email protected]