জয়তু মানবজীবন
আমার সেমি বেজমেন্ট এর চৌকোনা জানালা দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ কেবল তেতে আসছিলো। চুলোর ওভেনে তখনো তেলাপিয়া মাছের বেকটা শেষ হয়নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি নয়টা সাতান্ন মিনিট। আমার সাত বছরের ছেলে উপরের জানালা দিয়ে ঘাড় কাৎ করে বলল, “আম্মু, ওরা এসে গেছে।“ আমার অতিথিদের আসবার কথা ঠিক দশটায়। আমার এখন অখন্ড অবসর। ওরা ইচ্ছে করলেই দেরি করতে পারতো। কিন্তু বরাবরের মতো আবারো প্রমান মিললো যে এরা একটি উন্নত দেশে বাস করে। সময়ের ব্যাপারে যথেষ্ট রকম খেয়াল আছে ওদের। আমি হাতে করে কিছু নাস্তা নিয়ে উপরের ব্যাকইর্য়াডে চলে যাই।
মাত্র তিনদিন আগেই ক্যান আর হেলেনের সাথে দেখা হয়েছিলো আলো এবং জসীম ভাই এর বাড়িতে। আমার প্রায় তিনবছরের কানাডার জীবনে এই যুগলের (ক্যান এবং হেলেন) সাথে চতুর্থ বারের মতো দেখা হলো। আলোর ছোটবোন লাবী আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। সেই সুত্রে আলো ও জসীম ভাই দম্পত্তি আমার খুব কাছের স্বজন। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী জসীম ভাই এদেশে আছেন প্রায় বত্রিশ বছর। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে এদেশে চলে এলেও খুব সফলভাবে কানাডাতে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন । হেলেন জসীম ভাই এর সহকর্মী এবং পারিবারিক বন্ধু। আমার আজকের প্রসংগ ভীন দেশী এই দম্পত্তি।
ডাচ বংশোদ্ভুত হেলেন সোফিয়া ভ্যানডারকোফের বাবা বেশ রক্ষনশীলভাবেই মেয়েকে বড় করে তুলেছিলো। মাত্র ষোল বছর বয়সে হেলেন যখন কেনেথ হ্যারল্ড ক্যার বা ক্যানকে মিট করে, তখন ক্যান বিশ বছরের এক টগবগে তরুন । আমার বাড়ির পিছন দিকে যে নিকানো উঠোন আছে সেখানেই প্রায় চারজন বসবার মতো কাঠের টেবিলসহ একটি বেঞ্চ পাতা আছে। সকালের নাস্তা সারার পর পরই আলাপ শুরু করেছিলাম আমরা । তিপ্পান্ন বছর বয়সী হেলেন বার বার ফিরে যাচ্ছিলো ওর অতীতে। হেলেন বলতে থাকে, আমি যখন ক্যানকে প্রথম দেখি তখন আমি স্কুল গোয়িং। পাশেই বসা ছাপ্পান্ন বছর বয়সী ক্যান । হেলেন কথা শেষ করতেই ক্যান বলে উঠে, “দ্যাট ওয়াজ ইন জানুয়ারী ফোর্থ নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান।” একটা দিন শুরুর আমেজ তখনো পুরোটা কাটেনি। আমি ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি। কত বেশী গভীরতা থাকলে মানুষ এভাবে মনে রাখতে পারে। ক্যান গত পঁচিশ বছর হলো হুইল চেয়ারে বসে জীবনযাপন করছে। বিয়ের মাত্র ছয় বছর পর ক্যান এর পিঠের পিছনে একটি টিউমার ধরা পরে । প্রথমবার ক্যানকে অপারেশন করা হয় ১৯৮০ সালে। সেই মেজর অপারেশন এর পরও ক্যান হাটতে পেরেছিলো দুইবছর। পরের বার অপারেশন হয় ১৯৮২ সালে। সেবার ক্যানকে ওপেন করা হয় মোট ছয় বার । হেলেন আমার বাড়ির খোলা গাছের নিচে কথাগুলো বেশ সহজভাবেই বলছিলো। কিন্তু প্রকৃতি ওদের সময়ের অংকটাকে সরল রাখেনি। ক্যানের প্রথম অসুখ ধরা পরার তিন বছর আগেই ওদের জীবন আলো করে আসে ফুটফুটে পুত্র সন্তান জাস্টিন ।
ডাচ বংশোদ্ভুত হেলেন সোফিয়া ভ্যানডারকোফ
হেলেন ফিরে গিয়েছিলো তিরিশ বছর আগে। আমাকে গল্প করার সময় যেন ঝলমল করছিলো বিশ বছরের তরুনী হেলেন সোফিয়া। পরিচয়ের পর থেকেই ওরা একে অপরকে সুইটহার্ট ডাকতো। আজ এত বছর পরেও একে অপরের কথা বলবার সময় বার বার ”হান, হান ”করে ভেসে যাচ্ছিলো দু’জন। বাংলাদেশের মতো এক অনুন্নত দেশ থেকে আসার কারনেই হোক আর অন্য যে কোন কারনেই হোক আমার ধারনা ছিলো এদেশের মানুষেরা পারিবারিক জীবনের বন্ধনটাকে অতো জোর দিয়ে দেখে না। খুব সামান্য কারনেই একে অন্যকে উপেক্ষা করে । অথচ আজ দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর হেলেন পরম ভালোবাসায় ক্যান এর হুইল চেয়ার এর পিছনে দাড়িয়ে আছে। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না । গোড়া ক্যথলিক পরিবারের মেয়ে হেলেনকে আমার জিঞ্জেস করতে ইচ্ছে করে, “কোথায় তোমার ঈশ্বর, যে তোমাকে এই পথে আনলো?”
দ্বিতীয়বারের অপারেশনের পর থেকেই ক্যান হুইল চেয়ারে আশ্রয় নেয়। হেলেন তখন ছাব্বিশ বছরের ভরা তরুনী। কোন প্রশ্ন ছাড়াই হেলেন উপভোগ করতে পারতো ওর গোটা যৌবনকে । না, হেলেন সেপথে পা বাড়ায়নি। আর তাই হয়তো প্রকৃতি আরো একটু হেয়ালী করেছে হেলেনের সাথে ।
হেলেন এবং ক্যান এর ভালবাসার পৃথিবী
জীবনের সময়কে সাক্ষী রেখে জাস্টিন পেরিয়ে এসেছে পঁচিশ বছর। হেলেন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে সংসার নামক পৃথিবীতে, যেখানে আছে ক্যান, আর ওদের ভালোবাসায সিক্ত জাস্টিন । একদিন বাইরে থেকে ফিরে এসে জাস্টিন ওর মাকে বলে “ম্যাম আই এম নট ফিলিং ওয়েল।” প্রথমটা গা করেনি হেলেন। কিন্তু সন্তানের সমস্যা বাড়তে থাকে। এক পযার্য়ে ক্যানকে না জানিয়ে হেলেন ছেলেকে ডাক্তার এর কাছে পাঠায়। হেলেন আর ক্যান জানতে পারে তাদের ছেলে আসলে একজন গে। গল্প বলার এই পর্বে হেলেন এর সানগ্লাসকে উপেক্ষা করে আমি ওর চোখের কোনায় জমে আসা কান্না দেখতে পাই। আমার মনে হয় কি লাভ এসব জেনে। ইচ্ছে করে ওদেরকে বলি না আমি আর শুনবো না । কিন্ত আমার হাত পা বাধা। আজ সকালে ওদের সাথে কথা শুরু করার আগেই আমি ওদেরকে বলেছিলাম, “শোন আমি তোমাদের দু’জনের কথা জানতে চাই, খুব আগ্রহ নিয়েই জানতে চাই।” তাই রণেভংগ দেয়া যাবে না, আমকে যেতে হবে হেলেন এর ধৈর্য্যের শেষ সীমা পর্যন্ত। ক্যান এবং হেলেন তাদের একমাত্র সন্তানের এই আপাতদৃষ্টিতে অসম জীবনকে মেনে নেয় কারন হেলেন ইতিমধ্যেই আমাকে বলেছে “আই ক্যান্ট ডু এনিথিং হেয়ার। গড মেক মি হেল্পলেস। আই হ্যাভ টু কোপ উইথ ইট, রাইট লুনা।“ আমি আরো অপেক্ষা করি, কখন হেলেন এর কথা শেষ হবে । এবার হেলেন আরো দীর্ঘ শ্বাস নেয়, যেনো রবার্ট ব্রুসের মতো ধৈর্য্যকে জয় করা এক নারী ও।
আরো তিনবছর পার করে জাস্টিন গে কমিউনিটিতে। জাস্টিন নাকি খুব সক্রিয় ছিলো ওই কমিউনিটিতে। কিন্ত মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সন্তান। হেলেন আমাকে বলে, “ইউ নো লুনা, আই ডিডনট ফাইন্ড মাই চাইল্ড হ্যাপি, মাই সান ওয়াজনট হ্যাপি এট অল।“ আবারও জাস্টিন মায়ের কাছে আসে। ইতোমধ্যে পার হয়েছে আরো তিনবছর। ঊনত্রিশ বছরের গে জাস্টিন মাকে বলে ” ম্যাম হোয়াট সুড আই ডু? আইএম নট ফিলিং হ্যাপি এট অল।“ আবারো ডাক্তার। এবার জাস্টিন রুপান্তরিত হয় তিরিশ বছরের পরিপুর্ন এক নারী স্যান্ট্যালে (স্যান্টাল একটি ফরাসী শব্দ, অর্থ হচ্ছে সিংগিং বার্ড বা গানের পাখি)। হেলেন এর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার নোটবুক বন্ধ করি । এ কি শুনছি আমি , এ কি খেলা প্রকৃতির? পাশের হুইল চেয়ারে বসা ক্যান তখন তাকিয়ে আছে আমাদের মাথার উপর বড় ঝাউগাছটার দিকে। আমার দৃষ্টি চলে যায় আমার একমাত্র সন্তান এর দিকে। বুকের ভিতর টা কঁকিয়ে উঠে। মনের অজান্তেই প্রার্থনা করি, আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে। পার্থিব কোন সমস্যা মনে হয় ক্যানকে আর বিচলিত করে না, কারন জীবন ওকে ইতোমধ্যেই ষোল আনা হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছে । হেলেন এবার যেনো কিছুটা নিশ্চিন্ত। মেয়ে স্যান্ট্যালকে নিয়ে ওরা এখন নিরুদ্বিগ্ন। কারন এখন নাকি ওদের সন্তান সুখি । স্যান্ট্যাল নিজেই এতদিনে বার বার বলেছে , ”ম্যাম, নাউ আই এ্যাম কোয়াইট এ্যা হ্যাপি উইমেন।“
আমি , হেলেন, ক্যান এবং আমার ছেলে চলে যাই আমার বাড়ির পাশে স্কুল প্লে গ্রাউন্ডে। আমি হাটতে থাকি, পাশে হেলেন টানছে ক্যান এর হুইল চেয়ার । আমরা গিয়ে বসি একটি গাছের ছায়ায়। হেলেন আবার বলে, “আমরা আমাদের মেয়েকে বিয়ে দেবো নেক্সট ইয়ার। স্যান্ট্যাল এখন ওর প্রেমিকের সাথেই অন্য একটি বাড়িতে থাকে। ভীষন হ্যাপি ওরা। আমরা ভালো আছি, লুনা, আমরা খুব ভালো আছি। আমাদের নিজেদের পৃথীবিতে , আমি জানি জীবনে কষ্ট আছে বলেই তো আমরা মানুষ।”
হুইল চেয়ারে ক্যানঃ হেলেনের ভালবাসাতে বেঁচে থাকা
এবার ফিরে যাবার পালা । ক্যান হুইল চেয়ার থেকে দুটো অবশ পা ঠেলে দেয় গাড়ির ভিতর। গভীর মমতায় হেলেন ক্যান এর চেয়ার ভাজ করে গাড়ির পিছনে রেখে আমাকে হাগ করে। ছোট্ট একটু নিশ্বাস ছেড়ে বলে “লুনা, আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন। খুব সুন্দর সময় কাটলো তোমার বাড়িতে। তোমাকে অভিনন্দন।“
গাড়ি যখন আমার দৃষ্টির সীমা ছাড়ায় তখনো আমার চোখ জুড়ে থাকে ওরা, ওদের জীবন । আমার বেজমেন্ট এর ছোট্ট দুটো ঘর। আমি ল্যাপটপের সামনে মাথা ধরে বসে থাকি। কি লিখবো আমি ? হেলেন এবং ক্যান এর জীবনবোধের কাছে তো হার মেনেছে স্বয়ং প্রকৃতি। আমি তো কোন ছার! জয়তু, মানবজীবন।
৩০ অগাষ্ট, ২০০৭ টরন্টো, কানাডা। Email:[email protected]