কথার কথা

লুনা শীরিন


গল্প এক

শায়লার সদ্য বিবাহিত বড় মেয়ে ময়ুরী বিয়ের দেড় বছর পর একদিন বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসে মা শায়লাকে আড়ালে ডেকে বলল , মা ”তোমার জামাই আমাকে ইগনোর করে আমি আর ওর সাথে থাকবো না। ” মা তখুনি কিছু না বলে চলে যায়। এরপর মা আর মেয়ে যখন রান্নাঘরে দাড়িয়ে খাবার গোছাচ্ছিলো , তখন শায়লা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ”তোর বাবা আমার গায়ে চল্লিশ বছর ধরে হাত তুলছে ,আমি আছি না ? আর জামাই তোমাকে ইগনোর করে বলে তুমি থাকবে না , ঢং এর আর জায়গা পাচ্ছো না”। ময়ুরী দুদিনের জন্য মায়ের বাড়িতে থাকতে এসছিলো , দুপুরে ভাত খাবার পরে আর থাকতে ইচ্ছে করলো না । হুড খোলা রিকসাতে করে ময়ুরী যখন নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো তখন প্রায় বিকেল , গত দুদিন ইকবালের সাথে কতখানি যুদ্দ করতে হয়েছে সেকথা বলার মতো কাউকে খুজে পায় না ও । এভাবে মযুরীর জীবনে আরো দশবছর পার হয়েছে , ময়ুরী জানে সহ্যক্ষমতা কাকে বলে ।

গল্প দুই

প্রায় ১২ বছরের সংসার জীবন আলেয়ার । স্বামী সসরকারী চাকুরে, ঘরের সব দায়িত্ব আলেয়াই পালন করেন। দুপুরে খাবার টেবিলে আলেয়ার পরিবারের সবাই AàTa‡ শশুড়/ শাশুড়ি , দেবর/ননদ নিজের স্বামী ছেলেমেয়ে খেতে বসলে প্রায়ই আলেয়াকে অনুরোধ করা হয় মুরগীর রানটা নিতে , কিন্তু আলেয়ার জোর আপত্তি , না আমি রান খাই না, তোমরা খাও।আমি রান খেতে পছন্দ করি না ।

একদিন এক বিয়ের দাওয়াতে যায় আলেয়া , দীর্ঘদিনের কাজের মেয়েকে পাশে বসিয়ে আলেয়া রান চেয়ে নিয়ে বিয়ের খাবার খেতে বসে। বাবুর্চি কাজের মেয়েকে মুরগীর অন্য অংশটা দিয়েছিলো,আলেয়া বাবুর্চিকে ডেকে কাজের মেয়ের পাতে রানটা তুলে দিতে দিতে বলে,খা ভালো করে খা,এখানে তো তোকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। আলেয়াও মনে মনে দীর্ঘদিনের রান খাবার ইচ্ছেটাকে পুরন করে। আলেয়া জানে বাড়িতে খাবার টেবিলের সমঅধিকার ওর নেই ,কারন অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা না থাকলে ইচ্ছের জোর বেশীদিন থাকে না তাই স্বামীর বাড়ি হোক আর শশুড়বাড়িই হোক সেখানে অন্যর জন্য নিজের ইচ্ছেকে বিলিয়ে দেয়া। আর এখানে, এই বিয়ে বাড়িতে টাকা দিয়ে উপহার নিয়ে এসছে, এখানে অধিকার প্রতিষ্ঠাতে বাধা নেই ।

সমাজে নিজেদের সুবিধার জন্যই আমরা কিছু নিয়ম তৈরী করেছি ,ভালো / মন্দের ধারনাও নিজেদের সুবিধার প্রেক্ষিতে তৈরী হয়েছে । কেবল আজকের সমাজেই নয় সমাজ বির্বতনের শুরু থেকেই শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত টাকাকে ক্ষমতার ধারনা দিয়ে বিবেচনা করা হয় এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা আয় করলেও সংসারের নিয়ন্ত্রন থাকে পুরুষের হাতে তাই সেখানে নারীর স্বাধীনতাকে মুল্যায়ন করা হয় দীর্ঘদিনের বয়ে বেড়ানো ধারনার ( যাকে অন্যভাবে বলা হয় প্রথা বা নিয়ম) প্রেক্ষিতে। আবার অনেক সময় সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসলেও মানুষ স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় প্রথাগত ধারনার যুগপোযোগী পরিবর্তন এবং সমাজনামক ধারনায় সেই নিয়মকে প্রতিষ্ঠা করা । সম্প্রতি বাংলাদেশে এক জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী (প্রথম আলো ,অগাষ্ট ২ ,২০০৫) দেশে প্রতি ১০০ জন মহিলার ভিতর ৬২ জন মহিলাই প্রতিদিন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন,এই নির্যাতন প্রক্রিয়ায় রয়েছেন স্বামী /বাবা/ভাই /মা এবং অনান্য আত্বীয়পরিজন। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে একটি পরিবার তিনদিন জার্নি করে নর্থ আমেরিকায় এলেই কি সে বা তার পরিবারের ভিতওে বয়ে বেড়ানো দীর্ঘদিনের বিশ্বাস/অবিশ্বাস ,নিয়ম/নীতি ও চর্চা বদলে যায় ? আর সেই বদল কি কেবলই প্রয়োজনের তাগিদে, নাকি বেচে থাকার নিমিত্তে? মেনে নেয়া আর মনে নেবার ভিতর দিন/রাতের ফারাক আছে ক্ষুদ্র একক হিসেবে পরিবারের বাইরের ভদ্রতার আবরনকে বাচিয়ে চলতে মুলত নারীকেই । বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ সহযোগী ভুমিকায় থাকে । অন্যদিকে সমাজ অনেকটাই এগিয়েছে , যুদ্দ করতে হয় নারী /পুরুষ উভয়কেই,তবে নারীর জন্য সুযোগ কম থাকে বলেই দায়টা বেশী বহন করতে হয় নারীকেই।

টরোন্টো, কানাডা।
                                                                                              Email:[email protected]