সাজেদুল ও তার লাল মার্বেলখুব সতর্কভাবেই যে মার্বেল থেকে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছিল সেই মার্বেলটি সাজেদুল তুলে আনে। সাজেদুলের কাছে লাল মাবের্লটা পয়মন্ত । তার বিশ্বাস এটা তার সৌভাগ্য বয়ে আনে। খুব সাবধানে সাজেদুল মার্বেলগুলোর লাইন ঠিক করতে থাকে এবং একসময় সেটি মেঝের মধ্যে সাপের মতো গড়িয়ে গিয়ে ঠিক জায়গায় আঘাত করে। সাজেদুল এবার আরও পঞ্চাশ টাকার মালিক হবে।
‘স্কুল থেকে ফিরে আমি তোকে দেখে নেব-’
‘অবশ্যই নিবি’- সাজেদুল দ্বিধাহীনভাবে বেশ জোরের সঙ্গে উত্তর দেয়।
কিশোরীগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার এবং অঙ্ক শিক্ষক আবদুল্লাহ্ স্যার স্কুল শুরুর বেল বাজাতে থাকে। কিন্তু মার্বেল খেলায় অভ্যস্ত সাজেদুল তার টাকা গোনাতেই ব্যস্ত।
খুব বেশী দিন আগের কথা নয় যেদিন সাজেদুল প্রথম অন্য সবার সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল। সাজেদুলের মা সখিনা তাকে একটা নতুন শার্ট পরিয়ে দেয়। অন্য সবার চেয়ে ১ বছরের বড় ছিল বলেই স্কুলের পড়া সাজেদুলের কাছে সহজ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে সাজেদুল তার অঙ্ক শিক্ষক আবদুল্লাহ্ স্যারের কাছে খুব ঋণী। কারণ সে বলে, ‘অংক ক্লাস করার কারণেই আমি মার্বেল খেলে যে টাকা রোজগার করি তার হিসাবটা সহজেই করতে পারি।‘ খুব বেশি সরলতায় সাজেদুল কথাগুলো উচ্চারণ করে। ব্যাপারটা বদলে যেতে থাকে যখন থেকে সাজেদুলের বাবা সাজেদুলকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে যায় তাদের এক আত্মীয়ের বাসায়। চাচাতো ভাই হান্নানের সঙ্গে সাজেদুলের দেখা হয়, কথা হয়। হান্নান একজন রিকশাচালক এবং পাকা জুয়ারী। সাজেদুলের মত আগ্রহী খেলোয়াড়কে হান্নান খুব নিপুনভাবেই তার খেলা শেখায়। ঢাকায় সাজেদুল দুদিনেই ৬০০ টাকা জিতে নেয়। অন্যদিকে সখিনা ভাবত পড়াশুনা খুব জরুরি এবং সাজেদুলের অবশ্যই তা করা উচিত। আবার সাজেদুলের বাবা সাজেদুলকে তার সঙ্গে মাঠে নিয়ে যেতে চাইত সংসারে আয় বাড়ানোর জন্য। কিন্তু সাজেদুল বলে, এক সন্ধ্যায় মাঠে কাজ করে সে যা পায় তার চেয়ে দ্বিগুণ আয় করতে পারবে মার্বেল খেলে। এর বিপক্ষে যুক্তি দাড় করানো খুব কঠিন।
‘কেন তুমি স্কুলে যাবে না?’ এই প্রশ্ন যখন করা হয় তখন সাজেদুল চুইংগাম চিবাচ্ছিল এবং মার্বেলগুলো সাজাচ্ছিল। প্রশ্ন করার পর সাজেদুল খুব স্পষ্ট করে জানতে চায় ‘কেন যাবো?’
‘নিশ্চয়ই মার্বেল খেলাই তোমার জীবনের উদ্দেশ্য নয়?’
সাজেদুল হঠাৎ থেমে যায় এবং এক মূহুর্তে ওর মুখ ফ্যকাসে হয়ে যায়। তারপরই হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে সাজেদুল বলে- ‘নিশ্চয়ই নয়, এর পরের বার যখন আমি ঢাকায় যাব হান্নান আমাকে তাসখেলা শেখাবে এবং সেটাতেও আমি বাজিমাৎ করব।’ তখন সখিনা সাজেদুলের স্তুপ করা বইয়ের ধুলো ঝাড়ছিল এবং অপেক্ষা করছিল কখন সাজেদুল স্কুলে ফিরবে।
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেড়ে উঠছে এরকম অসংখ্য সাজেদুল। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক হলেও এদেশে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাবার আগ্রহ তৈরী হয় না, বিশেষ করে করে যারা দারিদ্র্যর সঙ্গে যুদ্ধ করে । সাজেদুল এর বাবা দরিদ্র কৃষক, মা ছেলেকে বড় করবার স্বপ্ন দেখলেও এর সাথে জড়িয়ে আছে তীব্র অর্থকষ্ট । তাই সাজেদুলের মতো ছেলেরা প্রাথমিকভাবে জড়িয়ে পড়ে মার্বেল খেলার সাথে, আস্তে আস্তে জড়িয়ে যায় জুয়ার সাথে। একসময় হয়ে পড়ে নেশাগ্রস্থ তরুন। আর এভাবেই সমাজ থেকে ঝড়ে পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম । সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরির্বতনে উদ্যোগ না নিয়ে কেবল কিছু নিয়ম কানুন দিয়ে ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করা যাবে না ।
নীলফামারী জেলার কিশোরীগজ্ঞ থানার সাজেদুলরা তাই স্কুলে যাবার চেয়ে নগদ টাকাকে বেশী চেনে এবং সত্যিকার অর্থে সেটাই ওদের কাছে বাস্তব।টরোন্টো, কানাডা । Email:[email protected]