জীবন ও মরণের সীমানা পেরিয়েদিনটা শুক্রবার, আমার পার্টটাইম কাজ বলেই আমি অবসর পাই, একচ্ছত্র অবসর। মনে পড়ে, ঢাকাতে খুব ব্যস্ত জীবনেও কখনো কখনো মনে হতো, আচ্ছা জীবনে ভাত/ কাপড়ের ব্যবস্থা করার পর কি কোনদিন কিছু বাড়তি সময় পাবো না, একটু নিজের মতো করে ভাববার বা কথা বলবার? হ্যাঁ, গত দু বছরের প্রবাসী জীবনে আমি সেই সময়গুলো পাই, সব কাজের বাইরেও শুধু নিজের জন্য কিছুটা সময়। আমার ভালোলাগার এই সময়টুকুতেই আমি বার বার ফিরে ফিরে যাই আমার প্রিয় অতীতে, আমার নিজেরই যাপন করা জীবনে। সেখানে কি নেই ? এই প্রশ্নটা আমাকে তাড়িত করে না বরং বলা উচিত এই তাড়িত হবার জন্য নিজের কাছেই নিজের অপেক্ষা তৈরী হয়। আজ শুক্রবারে ঢাকাতে যখন রাত দশটা আমি আমেরিকা থেকে সরদার (সরদার ফজলুল করিম) স্যারের ল্যান্ড ফোনের লাইনে সংযোগ লাগাতে বলেছিলাম আমার বড় দুলাভাইকে। বড়দা স্যারের বাড়িতে থ্রি ওয়েতে আমকে কানেক্ট করতে পারেনি। কারন স্যারের স্ত্রী মানে কলি চাচী বড়দাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলেছেন, “না না এখন সরদার সাহেবকে দেয়া যাবে না, উনি অসুস্থ্য, ফোন রাখেন এখন কথা বলা যাবে না।” নর্থ আমেরিকায় তখন দিন শুরুর আমেজ। আমার অতি সাহেবী বড় দুলাইভাই বেশ বিরক্তই হয়েছিলো আমার উপর। কিন্তু আমি পড়ে যাই গভীর চিন্তায়, সরদার স্যার অসুস্থ্য, কতটুকু অসুস্থ্য, স্যার? কি হয়েছে স্যারের? কেমন করে সব সামলাচ্ছেন চাচী? নিশ্চয়ই শাকিল ভাই, স্বাতী আপা, তিতু ভাই সবাই স্যারকে নিয়ে ভীষন ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন? আরো তো অগুনিত ছাত্র/ছাত্রী যারা স্যারকে ভালোবাসেন তারাও নিশ্চয়ই স্যারকে দেখাশুনা করছেন। নানান ভাবনা আমাকে গোটা দিন বিচলিত করে রাখে। আমি আচ্ছন্নের মতো অপেক্ষা করতে থাকি কখন সন্ধ্যা হবে, কখন আমি চাচীর সাথে কথ বলতে পারবো। আমার দিন কাটতে চায় না। স্যারের সেই ছোট শরীর, স্যারের কথা আর স্যারের সাথে আমার পথচলা আমাকে নেশার মতো পেয়ে বসে। আমার প্রবাসী জীবনে স্যারের নিজ হাতে দেয়া বইগুলো উল্টাতে থাকি আর কতকিছু ভাবি। স্যারের ইন্দিরা রোডের বাড়িটা বার বার ভেসে উঠে আমার স্বৃতিতে, কেমন আছে স্যার? কেন স্যারের কাছে গিয়ে বসতে পারছি না দু’দন্ড ? জীবনের সফলতা আর ব্যার্থতার হিসেব গুলিয়ে আসে, কাকে সফলতা বলি আমি? স্যারের মতো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি জীবনে সততা আর শিক্ষাকেই সবচেয়ে বড় বলে জেনেছেন, যিনি সারাজীবন ধরে শুধু বিশ্বাস করেছেন, মানুষের বড় সম্পদ তার নীতি এবং আত্মশক্তি। স্যারই তো সেই মানুষ যিনি খুব সামান্য, খুবই সামান্য পার্থিব চাওয়া/পাওয়া দিয়ে জীবনকে বিবেচনা করেছেন, আমার সেই মহান শিক্ষকের কথা ভেবেই তো আজ আমি সারাটা দিন দুঃসহ কষ্ট পাচ্ছি, এই কষ্ট স্যারকে একনজর দেখতে না পাবার কষ্ট, স্যারের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট । আমি অন্তত নিজের কথা খুব সাহসের সাথেই বলতে পারি যে, স্যারের সমসাময়িক সময়ের আরো কিছু শিক্ষককে তো আমি ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি যাদের বিত্ত বৈভব আর ক্ষমতার কাছে সরদার স্যারের জীবন খুব বেশী সাধারন, খুবই সাধারন। কই তাদের কথা তো আমার একবারও সেভাবে মনে পড়ে না যতটা পড়ে স্যারের জন্য? কই তাদের জীবনের কথা ভেবে তো একবারও মনে হয় না কেন সেই জীবনটা পেলাম না, বরং সরদার স্যারের মতো নির্লোভ জীবনটা পেতে ইচ্ছে করে ভীষনভাবে। আমার মতো আরো বহু প্রজন্মের ভিতর স্যার যে আলোটা জাল্বিয়ে দিয়েছেন, আজকের বাংলাদেশে কয়জন শিক্ষক এই কাজটা পেরেছেন সফলতার সাথে? ভুয়া শিক্ষক আর ভুয়া ছাত্র/ছাত্রী দিয়ে ভরা এই সমাজে স্যার যে জীবনাদর্শন রেখে যাবেন সারা বাংলাদেশের সামনে সেই জীবনআর্দশ কয়জন সম্পদশালী শিক্ষক রেখে যেতে পারবেন তা তো হাতের আংগুল গুনেই বের করা যাবে । স্যার এর লেখা দর্শনকোষ, রুশোর সংলাপ, প্লেটো, এরিস্টটল বা এংগেলস কে নিয়ে রচনা গ্রন্থগুলো হাতে নিলে কি একবারও মনে হয়, এই সেই শিক্ষক যিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিজের ভালোমন্দকে বড় করে দেখেননি বলেই একটি দেশ স্যারকে তার প্রাপ্য সন্মান বুঝিয়ে দিতে ব্যার্থ হয়েছে? রাষ্ট্রক্ষমতায় আজ যারা বসে আছেন, আর দুদিন পরেই স্যারের মৃত্যৃতে যারা বড় বড় বিবৃতি দেবেন বা মহান শিক্ষক বলে গলার রগ উচু করে বক্তৃতা করবেন তারা কি আজ একবারও গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন স্যার কেমন আছেন? হয়তো আমার আজকের সারাদিনের চিন্তাটা ভুল, হয়তো অনেকেই স্যারের খোঁজ নিচ্ছেন বা স্যারের দেখভাল করছেন।
পিতৃতুল্য এই শিক্ষকের চিন্তায় আমি সন্ধ্যায় স্যারের বাড়িতে ফোন করি। সেই একই কন্ঠস্বর, চাচী ফোন ধরেই বললেন, ”ও লুনা সকালে তুমি ফোন করছিলা, আমি কথা বলতে পারি নাই, তোমার স্যারের শরীর ভালো না, মেমোরী লষ্ট হইছে, আমার মন মেজাজ খুব খারাপ।“ চাচী একটানা কথা বলছেন। আমি স্যার আর চাচীর এই জীবনের সাথে গত ১৫ বছর পরিচিত। ছবির মতো স্যারের ইন্দিরা রোডের বাড়িটা দেখতে পাই। চাচী বার বার বলতে থাকেন, “তুমি ফোন করছো আমি খুব খুশি হইছি, তোমার স্যার কে বলবো তোমার কথা।“ ১৯৯৩ সালে যেই শিক্ষকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো আজ ১৪ বছর পর আট হাজার মাইল দুরে বসে সেই শিক্ষককে একবার দেখতে না পাবার কষ্ট আমাকে কোন সান্তনা দিতে পারে না। স্যারের লেখা বইগুলোর উজ্জল আলোয় আমি খুঁজতে থাকি আমার প্রিয় শিক্ষকের মুখ, তার আলোকিত জীবন। তার মৌলিক কর্মময় জীবন তাকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। শুধু আমি একবার, মাত্র একবার হয়তো দেখতে পাবো না তাকে। আমার সালাম গ্রহন করুন স্যার ।
২০ নভেম্বর, ২০০৭
টরোন্টো, কানাডা। Email:[email protected]