হেমন্ত বা শরৎ এর পাতা
ইংরেজীতে ফল সিজন এর বাংলা কি? গাড়ি তখনো হাইওয়েতে উঠেনি ছুটির দিন তবুও ক্লান্তিহীন মানুষ ছুটছে। টরোন্টোতে ঋতু বদল চোখে পড়ার মতো, মনে হয় ঘুম থেকে উঠলেই দেশটার প্রকৃতি বদলে যায়। পেজা পেজা বরফ যে মুহুর্তেই কোথায় উধাও হয়ে যায় নিতা তার হদিস পায়নি গত চারবছরেও। কোথায় যায় এই বরফগলা পানি? স্তুপাকারে বরফগুলো যখন জমে জমে চারপাশটা জমাট ঠান্ডায় কঠিন চেহারা নেয় তেমনি এক ডিসেম্বর এর রাতে নিতা টরোন্টো এসেছিলো। ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ, একদিন বা মুহুর্তের জন্যও নিতা ভুলবে না দিনটা ---- অন্তহীন সময় /মাস, বছর পেরিয়ে গেছে নিতার জীবনে। দিব্যি মনে পড়ে, ছোটবোন এরকমই এক সিজনে মানে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোন এক বিকেলে অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিতাকে বলেছিলো, ‘দ্যাখ দ্যাখ গাছের পাতার রংটা কেমন বদলে যাচ্ছে, কি সুন্দর না?’ খুব সামান্য কথা, বোনে বোনে সাধারণ একটা কথা, কিন্ত নিতার মন তখন বিষাদ /বেদনা বা তিক্ততায় ভরা। নতুন দেশ, ছোটবোনের বাড়ি, নিজের জীবনের কি হবে? ৫ বছরের ছোট বাচ্চা নিয়ে এই শহরে কতদিনে শক্ত পায়ে দাড়াতে পারবে, সেগুলোর কোন কিনারাই নেই, প্রকৃতির অপুর্ব রং তখন নিতার মনে দাগ কাটে না, কেবলি হতাশা আর দীর্ঘনিশ্বাস, চারিদিকে হতাশা, এর ভিতরে পাতার রং আসে কি করে? সাধে কি আর কবি বলেছেন ‘এতকিছু বোঝ এটুকু বোঝ না, কি সে কড়ি আসে দুটো?’। হ্যাঁ, এই শহরে শুধু দুটো ডলারের নিশ্চয়তা আর ভালো জীবন যাপনের প্রতিশ্রুতি খুঁজতে নিতাকে পার করতে হয়েছে টানা তিন বছর । সেখানে কি নেই? প্রকৃতির পাতা বদলের গল্প নেই বরং পাতা বদলের পরেই যে কঠিন ঠান্ডা আসবে সেই প্রস্তুতিতে নিতা কি করে টিকবে, ছেলের স্কুল, নিজের ব্যাংকে মাসকাবারি টাকা, একটা চাকরির খোঁজ ইত্যাদির রুঢ় বাস্তবতার গল্প আছে।
আজ মাত্র ৯ মাস চলছে, নিতা উঠে এসেছে মাটির নীচের সেই হীমশীতল বেজমেন্ট থেকে, যেখানে পৃথিবীর আলোবাতাস ঢুকতো না, প্রকৃতির পাতা বদল এর রংতো প্রশ্নই আসে না।
যাক পুরোন কথা, কখন গাড়ি বড় রাস্তায় উঠেছে টের পায়নি নিতা। সামনের সীটে বসা বেবী আর ওর স্বামী রাশেদ, পিছনের সীটে নিতা আর বেবীদের বাচ্চা দীপ্ত। সেদিন কি কথায় বেবী বলছিলো ‘জানো নিতা, আমি যখন বিয়ে করেছিলাম রাশেদকে তখন রাশেদ বিদেশেই থাকতো চাকরিও করতো কিন্তু অনেক টাকা পেতো না। তাই সবাই আমাকে বার বার বলতো বেবী অনেক ভুল করেছে জীবনে, অথচ এই রাশেদই যখন লাখ টাকার চাকরি নিয়ে বাংলাদেশে গেলো তখন সেই মানুষগুলোই উল্টে কথা বলল,আসলে কি জানো, টাকা কথা বলে, মানুষ না’। নিতা রাশেদ ভাইকে লক্ষ্য করলো মুর্হুতের জন্য,শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে আছেন, লক্ষ্য স্থীর। বাংলাদেশের আবেগপ্রবন যে তরুন বাম রাজনীতি করে দেশ বদলে ফেলার কঠিন ব্রত নিয়ে কাটিয়েছে তারুণ্যেরর স্বপ্নীল দিনগুলো, যে চল্লিশোর্ধ যুবক এখনো দেশের গল্প করতে গেলে সময় ও কথার হিসেব গুলিয়ে ফেলে সেই মানুষটাই বৌ /বাচ্চা নিয়ে বের হয়েছে হেমন্ত ও শরৎ এর পাতা বদলের রং দেখতে। ঠিক পৌছে যাবে গন্তব্যে। নিশ্চয়ই যাবে, যে তরুন জন্মেছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে মংগা ও খড়াপীড়িত জেলা নীলফামারিতে, সেই মানুষ আজ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশের হাইওয়েতে একটি টয়োটা সিয়েনাকে ১৪০ কিলোমিটার গতিতে ছুটিয়ে নিচ্ছে, কোন সোজা পথ দিয়ে তো রাশেদভাই আর বেবীর জীবনটা এখানে পৌঁছেনি তাই না? পিছনের সীটে বসে নিতা মনকে ঠাওরাচ্ছিলো, বেবীর ঝাঁকড়া চুলকে পাশ কাটিয়ে সোনাঝরা প্রকৃতিতে চোখ মেলে দেয় নিতা। আজ ওরা বের হয়েছে পাতার রং বদল দেখার জন্য, পিছনের গাড়িতে আরো এক পরিবারের সাথে আসছে নিতার ছেলে। গাড়ি এবার বিশাল প্রকৃতিকে পিছু ফেলে ছুটছে, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আল লাল আলোয় মেশানো বড় বড় গাছ, মনে হচ্ছে চোখের পলকেই ম্যাজিকের মতো অরণ্যর রং আলো ছড়াচ্ছে, এতো রং এর ছোঁয়া কোথায় পেলো গাছগুলো? বাসা থেকে বেরোবার আগেই নিতা ওর ব্যাগপ্যাকে ঢুকিয়েছে প্রিয় সিডি, শ্রীকান্ত আচার্যের আবেগী গলায় গান বাজছে ”বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে বিনা কারনে”। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ছুটে চলা গাছ, চোখ ধাঁধানো প্রকৃতি, কি অপার বিস্ময়কর প্রকৃতির রং, সবুজ পাতার ঝাড়ের ভিতর লালচে আলোর ছোঁয়া, খুব বেশী সুন্দর দেখলে বুকের ভিতরটা খাঁমচে ধরে কে যেন, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। আচ্ছা এই যে আকাশ, সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচেছ পৃথিবী আলো করে, সেই তো একই মেঘ, তাই না? বাংলাদেশেও তো সেই একই আকাশ, তাই না? আবারো নস্টালজিয়া নিতার মনে। চোখ চলে যায় রাংগামাটির প্রকৃতিতে, টরোন্টো আসার সেই বছরটাতেই নিতারা গিয়েছিলো রাংগামাটিতে, দেশে তখনো শীতের শুরু ছিলো, সেই শুভলংবাজার, তবলছড়ি, রাংগামাটি, তখনও নিতা জানতো ওকে ছেড়ে আসতে হবে প্রিয় দেশ, তাই কি স্মৃতির পাতায় শক্ত হয়ে বাসা করেছে রাংগামাটির ছবিগুলো?
গাড়ি থেমে গেছে এক লেকের কাছে, বাচ্চারা নেমে হুটোপুটি করছে নিতারাও নেমে পড়ে সীটবেল্ট ছেড়ে, শীতটা ভালোই পড়েছে এবার। হেমন্ত বা শরৎ এর পাতা গুলো পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়েছে যেন, ঝড়াপাতার সাথে গাছের নতুন পাতা। ২০০৫ সালেও নিশ্চয়ই এভাবেই পাতা বদলেছিলো, এবারও বদলাবে, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাবার সময়ও কি প্রকৃতি এভাবেই উন্মাদ করবে, নাকি আজ এইবেলাতেই শুধু এভাবে তোলপাড় হচ্ছে? চারিদিকে ডিজিটাল ক্যামেরার শব্দ, ব্যাস্ত জীবনে সবাই স্মৃতিকে বাক্সবন্দী করবে, নিতা সোয়েটার এর জীপার আটকে লেকের একদম কোনায় এসে দাড়ায় যেখান থেকে বড় বড় গাছের পাতা ও রং মনের চোখকে ঝলসে দেবে, বহুবারের মতো আবারও জীবনেকে খুউব বেশী ভালোবাসার কারনেই নিতার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এই পাতা বদলের দিনটা।
লুনা শীরিন , টরোন্টো
৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৮
Email:[email protected]