কালো সূতা
                                               মাহমুদুল হক ফয়েজ


কই যাইবেন স্যার?
ঘাড় বাঁকা করে তাকাতে তাকাতেই আট দশ বছরের একটি চটপটে মিষ্টি ছেলে সামনে ক্ষ্যাগ ছুঁয়ে দাঁড়ালো। ঢাকার কমলাপুর ষ্টেশানে এরকমই হয়। হাল্কা ব্যাগ নিজেই নিতে পারবো। শীতের ঝাপটাটা একটু বেশী। মাফলারটা আরেকটু জড়িয়ে ব্যাগের হাতলটা আরো জোরে ধরে কিছু না বলেই ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে এগুতে লাগলাম।
পয়সা লাগবোনা স্যার। মিষ্টি হেসে ব্যাগটা একরকম ছিনিয়ে কোলেই নিয়ে নিলো।
চিটাগাঙ্গ যাইবেন স্যার?
সপ্রতিভ প্রশ্ন করে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। কোনো উত্তর দিলামনা। আমার চোখের দৃষ্টিতে মৌনতা। ছেলেটি আমার মনের ভাব বুঝলো। খুশি খুশি ভাব নিয়ে বল্ল,
আমিও যামু।
তুই কই যাবি ?
ভৈরব, স্যার।
ততক্ষণে ট্রেনের কাছে এসে গেছি। প্ল্যাটফরমে কেউ দাঁড়িয়ে বিদায় দিচ্ছে। কেউ নির্দিষ্ট কামরায় উঠছে। পত্রিকার হকার ব্যস্ত তার পত্রিকা বিক্রির কাজে।
কোন কামরা স্যার ?
ঝ-চৌত্রশ, এইতো এই কামরা।
আমার আগেই লাফ দিয়ে উঠে পড়লো ছেলেটা। সিটের নাম্বার খুঁজে ঠিক মতই এসে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে হাসলো যেনো একটা রাজ্য দখল করে ফেলেছে।
ব্যাগটা উপরে রাখতে রাখতে বল্লাম, কি নাম তোর ?
একটা আদুরে গলায় সামনের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বল্ল,-
নয়ন
বাড়িতে কে আছে তোর ?
মা আছে। বাবা নাইক্কা। তিন চাইর বছর আগে মারা গেছে। কইলজাত ব্যরাম আছিলো।
ঢাকা কেনো আসলি-
কাকার কাছে। মা পাঠাইছে। ট্যাকা পামু।
পাইছস্ ?
না ।
টাকা না নিয়া যাচ্ছিস যে।
মা কইয়া দিছে আইজকা ফিরা যাইতে। মা ইষ্টিশানে থাকবো।
চোখে ভেসে উঠলো আকুল করা এক স্নেহময়ী মা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে এক সন্তানের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। এক বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চল শিশু মা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এক বিশাল অভয়ারণ্যে।
ততক্ষণে ট্রেন ষ্টেশান ছেড়ে এগুতে লাগলো। মানিব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার একটা নতুন নোট বের করে নয়নের চোখের সামনে ধরলাম। খুব লজ্জা আর ইত:স্তত হাতে টাকাটা পেয়ে খুশিতে আটখানা। টাকায় নতুনের গন্ধ এখনো লেগে আছে। টাকাটা উল্টেপাল্টে দেখে নাকে লাগিয়ে গন্ধটা নিলো। কৃতজ্ঞতায় চোখটা যেনো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
বল্লাম- কিছু কিনে খাইস।
না, যাইয়া মারে দিমু । নতুন ট্যাকা, মা খুশি হইবো।
ডান হাতটা তুলে আমাকে একটা সালাম ঠুকে দিলো। হাত তুলতেই দেখি একটা কালো মোটা সূতা হাতের কব্জিতে বাঁধা। আমি ওদিকে সপ্রশ্ন তাকাতেই বল্ল,
মা বাঁইধা দিছে। মুখ দোষের। কোনো ক্ষতি যেন না হয়। হারাইয়া যেনো না যাই।
বাংলার এ এক সনাতন সংস্কৃতি। স্নেহময়ী মা তার সন্তানের আসু অকল্যান থেকে মুক্ত রাখার জন্য কালো সূতা বেঁধে দেয়।
ট্রেন ততক্ষণে বিমান বন্দর পেরিয়ে টঙ্গির দিকে জোর গতিতে এগুচ্ছে। নয়ন বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে এতোক্ষণ ট্রেনের সাথে সাথে দুলছিলো।
স্যার একটু সামনের থাইক্য আসি ।
আর দাঁড়ালো না । অনেকটা দ্রুতই চলে গেল সামনে। বাইরে হালকা কুয়াশার চাদর এখনও কাটেনি । শীতের হালকা রোদ কুয়াশা ভেঙে কিছুতেই যেন বেরিয়ে আসতে পারছেনা ।

শীত-ভোরের আরামের ঘুম ছেড়ে আসতে হোল । তার রেশ এখনো লেগে আছে চোখে । একটু ঝিমুনি এলো । সময় কতক্ষণ গেল মনে নেই। হঠাৎ বিকট শব্দ আর প্রচন্ড ধাক্কায় কামরার লোকজন সব ছিটকে পড়লো। এ ওর গাযের উপর পড়ে এক বিভৎস অবস্থা। চারদিকে হৈ চৈ শোরগোল। আমাকে আবিষ্কার করলাম কামরার এক কোনে উপুর আবস্থায়। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলাম। আহত নারী পুরুষের আহাযারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। আমাদের কামরা একেবারে উল্টে না গেলেও লাইন থেকে পড়ে কাত হয়ে আছে। কামরা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামলাম। চর্তুদিক থেকে গ্রামের লোকজন ছুটে আসছে। মৃত্যুর এক বিভীষিকা যেন নেমে এলো শান্ত স্নিগ্ধ পুবাইল গ্রামে। দু’ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ। সামনের কামরাগুলো সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ। হঠাৎ মনে হলো নয়ন তো সামনে গেল। বুকটা অজানা আশংকায় হু হু করে উঠলো । প্রচন্ড ভীড়, আহত আর নিহতদের রক্তাক্ত দেহ। না, নয়নকে তো কোথাও দেখছিনা। আকাশ বাতাস কাপিঁয়ে নয়ন নয়ন বলে চিৎকার করে ডাকতে গেলাম।

একটা দুমড়ানো মুচড়ানো কামরার সামনে দেখলাম প্রচন্ড ভীড়। কয়জন লোক বহু চেষ্টা করেও একটা কামরাকে কিছুতেই সরাতে পারছেনা। ভীড় ঠেলে কামরার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । লোহার ভারী কামরার নীচে চাপা পড়ে আছে একটি ছোট্ট নিথর নিস্তেজ দেহ। শুধু মুষ্টি বদ্ধ একটা তুলতুলে হাত কুয়াশার হিমেল চাদর জড়িয়ে উর্দ্ধমূখী হয়ে আছে। শত শত উৎসুক দৃষ্টি দেখছে হাতের মুঠিতে একটি কচকচে পাঁচ টাকার নোট আর কব্জিতে বাঁধা রয়েছে একটি কালো সুতা।