উপাসনা ধর্ম বনাম মানব ধর্ম

মাসুদ রানা

(২য় কিস্তি )

১ম কিস্তি এখানে

আগেই বলেছি যে, ধর্ম স্রস্টাগণ বিভিন্ন ধরনের মতবাদ প্রচার করেছেন-তাদের একান্ত নিজস্ব বিশ্বাস থেকে। যিনি মানুষের অনুভূতিতে সবচেয়ে বেশী আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, তিনি তত বেশী পরিচিতি লাভ করেছেন এবং বিখ্যাত হয়েছেন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বৈদিক যুগের আর্য ঋষিগণ, তাদের যে ধর্ম সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন, তা কালে কালে বিবর্তিত হয়ে আজ হিন্দু ধর্ম নাম নিয়েছে। গৌতম বুদ্ধ হিন্দু ধর্মের গন্ডী থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজ ধর্ম প্রচার করেছেন তার নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী। ডেভিড বা দাউদ ছিলেন সুমিষ্ট কন্ঠের অধিকারী। তিনি তার এই গুনটিকে কাজে লাগিয়ে নিজ ধর্ম প্রচার করেছেন। তার উত্তরসূরী মূসা বা মোজেস যখন তার ধর্ম প্রচার করেন, তখন ছিলো জাদু বিদ্যার যুগ। মূসা তার যাদু দ্বারা অন্যান্য জাদুকরদের পরাস্ত করে সাধারন মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেন এবং তার ধর্ম প্রচার করেন। অতঃপর জেসাস ক্রাইস্ট এবং এই ধারার সর্বশেষ সংযোজন নবী মুহাম্মাদ; যিনি ঐ সময়ের সাপেক্ষে যথেষ্ট অগ্রগামী মানুষ ছিলেন।  এভাবে অন্যান্য সবাই যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের সংস্কারমূলক মতবাদ প্রচার করেছেন। ধর্ম যেহেতু একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সমাজ ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত ছিলো বিধায়, কালে কালে তা পরিবর্তিত হয়ে নূতন মতাদর্শে পরিণত হয়েছে। সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধর্ম গুলোকে প্রভাবিত করেছে। সামাজিক অনাচার, বৈষম্য, দারিদ্রতা, অশিক্ষার অভিশাপ প্রভৃতি ছিলো এতগুলো ধর্ম সৃষ্টির মূল উপাদান। কালের প্রবাহে কিছু ধর্ম একটা সময় পর্যন্ত আধিপত্য বজায় রেখেছে, এরপর নতুন কোনো মতবাদ বা ধর্ম সৃষ্টির কারনে, সনাতন ধর্মটি হয় সম্পুর্ন বিনষ্ট হয়েছে নতুবা তার মূল সুরটিকে ঠিক রেখে বহিরাবরণ পরিবর্তিত হয়ে নতুন রুপ ধারন করেছে। কিছু লোক পুরনোটিকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছে, বাদ বাকি সবাই নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। পুরোনো ধ্যান-ধারনা, পুরোনো বিশ্বাস কে ঝেড়ে ফেলে, নতুন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মানুষের চিরন্তন অভ্যাস। তাই দেখা গেছে, নতুন কোনো ধর্মের প্রবর্তনের পর সাধারণ মানুষ তুলনা মূলক বিচার বিশ্লেষনের পর, পুরোনো ধর্ম ছেড়ে দলে দলে নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে। এ যেনো অনেকটা পুরোনো মডেলের গাড়ী কিংবা কম্পিউটার পরিবর্তন করার মত। খেয়াল করলে দেখা যায়, পোষাক-আষাক সহ অন্যান্য ধর্মীয় সিম্বল গুলোর ফ্যাশনও মানুষ একই সাথে পালটে ফেলেছে। এছাড়াও দেখা গেছে, রাজ্য জয়ের সুবাদে বিজেতা গোষ্ঠী স্বীয় ধর্ম বিজিত জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আবার সনাতন ধর্ম দ্বারা শোষিত জনগোষ্ঠীর একাংশ, নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন কল্পেও  নতুন ধর্ম গ্রহন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের একাংশ, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা লাঞ্ছনার শিকার এবং জাত-পাতে অতীষ্ঠ হয়ে,অপেক্ষাকৃত সাম্যবাদী জাত-পাতহীন ইসলাম কে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও কোনো ধর্ম মতই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ধর্ম প্রচারক হিসেবে জেসাস ক্রাইষ্ট এবং প্রফেট মুহাম্মদকে সবচেয়ে সফল বলা যায়। মোটামুটি আধুনিক সময়ে প্রবর্তিত বলে এ দুটো ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা বেশী। এবার আসা যাক প্রচলিত ধর্ম মতবাদ্গুলোর, বর্তমানের প্রেক্ষাপটে গ্রহনযোগ্যতা প্রসঙ্গে। ধর্ম প্রচারকগন তাদের সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে, তাদের নিজস্ব সংস্কার মুলক মনোভাব এবং প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করেছেন। কিন্তু কোনো মতবাদই পৃথিবীতে চিরস্থায়ী হয়না। তাকে জোর করে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।প্রতিটি ধর্মই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সময়োপযোগী ছিলো। কিন্তু সভ্যতার উত্তরনের সাথে সাথে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে আজ এতোখানি এগিয়ে গেছে যে, এসব মতবাদ গুলো এখন শিশুতোষ রুপকথায় পর্যবসিত হয়েছে। এখন কোনো পিচ্চিকে মহানবীর মিরাজের ঘটনা বললে সে একশো একটা বৈজ্ঞানিক ত্রুটি খুঁজে বের করে। আজকের পৃথিবীর বিজ্ঞান মনষ্ক এবং যুক্তিবাদী মানুষের মাঝে তাই ধর্মসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তীব্র ভাবে অনুভূত হচ্ছে। আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, ভগবান এর উপাসনাকারীরা আজ বিভ্রান্ত। পৃথিবীতে বিরাজ করছে চরম অশান্তি। মানুষে মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা নামক মানবীয় অনুভূতি গুলো আজ বিলুপ্তির পথে।

                                                                              (চলবে)