বানভাসি মানুষ এবং প্রতিনিধিত্বহীন রাষ্ট্র
মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী



অষ্টাশিকে ছাড়িয়ে যাওয়া এবারের বন্যা মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকটাকারে তুলে ধরেছে। বানভাসি মানুষের সীমাহীন দুর্গতি, সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা, ক্ষুধা আর রোগব্যাধির ছোবলে বন্যা কবলিত জনপদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ দিনের পর দিন ঘরের চালে উদ্বাস্তু হয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে। অনাহারে অর্ধাহারে কেটেছে তাদের প্রহর। নিরাশায় ডুবে যাওয়া মানুষগুলো দশ দিন যাবত চোখে আশার আলো জ্বালিয়ে নিরাপদে থাকা মানুষদের কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশায় পথ চেয়ে বসেছিলো। কেউ আসে না সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। ক্ষুধায় নেতিয়ে পড়তে থাকে শিশু আর বৃদ্ধরা। প্রতিকূল প্রকৃতির সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়তে থাকে সমর্থ মানুষেরা। মানুষ আসে না ছুটে মানবতার হাহাকারে। বিরূপ প্রকৃতির এই বাংলাদেশের ইতিহাসে যা সম্পূর্ণ অচেনা দৃশ্য, অকল্পনীয় বাস্তবতা। এমন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাবে না যখন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দুর্যোগ কবলিত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে নি। কিন্তু এবার দেশের মানুষ দেখলো সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। যা ছিলো অনভিপ্রেত এবং বেদনাদায়ক।
প্রিয় সচেতন পাঠক, আপনারা হয়তো অনেকেই সহমর্মী ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বাঙালী জাতির এই অস্বাভাবিক আচরনের ব্যাপারে অবগত হয়েছেন। আধুনিক মিডিয়ার সুবাদে দেশ-বিদেশের সকল বাংলাভাষী মানুষ এই লজ্জাজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে সমর্থ হয়েছেন। আমরা সবাই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে জরুরী অবস্থার অজুহাত দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে তাদের পরিচিত ব্যবহার করে দুর্গত মানুষদের সাহায্য করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আত্মপরিচয় গোপন করে কারো ঘরের কড়ানাড়াও তো এক ধরণের অপরাধ বলে বিবেচিত হয় সভ্য সমাজে। তাহলে বন্যা কবলিত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসা উদ্যোক্তাদের পরিচয় দানে সমস্যাটা কোথায় ? সমস্যাটা ক্ষমতাসীন উপদেষ্টা সরকারের কুটিল রাজনীতিতে। জনপ্রতিনিধিত্বহীন এই সাময়িক সরকারের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য এমন ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তা হিসেবে কাজ করেছে বলে অনেক চিন্তাবিদ অভিমত প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ব্যবহার করে তাদের অবস্থান সংহত করে ফেলতে পারে-এমন আশংকা থেকে সরকার নেতিবাচক অবস্থান গ্রহন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসায় দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে আগ্রহী মানুষকে থমকে দাঁড়াতে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন মেশিনারীজ ব্যবহার করে উপদেষ্টারা, আমলারা এবং কিছু কিছু মুখচেনা ব্যক্তি বা দল যদি দুর্গত মানুষদের সাহায্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে রাষ্ট্রের অপরাপর নাগরিক সমাজ কেন তাদের পরিচয় ব্যবহার করতে পারবে না ?


রাষ্ট্রপক্ষের এমন উন্নাসিক আচরণের ফলে নাগরিক সমাজ থমকে দাঁড়ালে বানভাসি মানুষের মানবিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। অন্যদিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের অবস্থানকে কেন্দ্র করে চলে বিতর্ক। জাতীয় দুর্যোগে জাতি বিভাজিত হয়ে পড়লে ভিন্ন জাতির পক্ষে যথাযথ সাড়া দেয়া দৃরূহ হয়ে পড়ে। এতে জাতির ইমেজ ক্ষুন্ন হয়। দেখা গেলো রাষ্ট্রপক্ষের বালখিল্যতার কারণে দাতা সংস্থাগুলো বরাবরের মতো দুর্গত মানুষদের পক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলো না এবং তাদের সাহায্যপুষ্ট বেসরকারী সংস্থাগুলোও দুর্যোগকালীন কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে এলো না। এমতাবস্থায় দুর্যোগপীড়িত অসহায় মানুষদের দশদিন পর্যন্ত ঘরের চালে বসে থাকতে হলো এবং রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট এই প্রলম্বিত অসহায়ত্বের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না ভেবে এক প্রকার স্বস্তি বিরাজ করতে দেখা গেলো।


অবশেষে দেখা গেলো, মানুষের অসহায়ত্বের ছাপ পড়তে শুরু করেছে উপদেষ্টা সরকারের চোখেমুখে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠলে সরকারকে নমনীয়তার পর্যায়ে নেমে আসতে হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় বানভাসি মানুষ ঘরের চাল থেকে নেমে আসতে শুরু করে। বাঙালী জাতি তার সহমর্মিতার স্বঐতিহ্যে ফিরে আসে।


প্রাকৃতিক এই দুর্যোগকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে যে দুঃখজনক দৃশ্যের অবতারণা হলো তাকে আমরা কোন অভিধায় অবিহিত করতে পারি ? মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেয়ে বড়ো মানবিকতা আর কিছু হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ যে কোন বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকেই মূল ভুমিকা পালন করতে হয়। রাষ্ট্র জনগণের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয়। জনগণের মাধ্যমে প্রাপ্ত সকল রাষ্ট্রীয় মেশিনারীজকে সেই বির্পযয় মোকাবিলায় ব্যবহার করা যেমন অত্যাবশ্যকীয় তেমনি রাষ্ট্রের নাগরিক সমাজকে সেই উদ্যোগে সামিল করানো অবশ্য করণীয় কর্তব্য। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি রাষ্ট্রীয় মেশিনারীজ যেমন ব্যবহার করেছে সীমিতাকারে তেমনি নাগরিক সমাজকেও বিপর্যয় মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে অনভিপ্রেত প্রতিবন্ধকতা। রাষ্ট্র তরফের এই সংকীর্ণতার ব্যাপারে আমি নিবন্ধের শুরতে উল্লেখ করেছি। সেটি আরেকটু বিশদ ভাবে তুলে ধরেই আজকের কিস্তি শেষ করবো।


আমরা সবাই জানি যে, বিগত জামাত-বিএনপি জোট সরকার পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার লক্ষ্যে বশংবদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিযুক্ত করেছিলো দলীয় রাষ্ট্রপতিকে ডবল ডেকার বানিয়ে। যা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা মেনে নেয় নি এবং রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়ে ও ঘোষিত ২২শে জানুয়ারীর নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে দেশে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষাপটে জোট সরকারের পলিসি মেকাররা নানান প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে এবং পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখার জন্যে একের পর জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে। এতে দেশ দ্রুত এক গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হতে থাকে। তখন সামরিক আমলাদের সহযোগিতায় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় এবং জরুরী অবস্থা জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। নেপথ্যে থাকা সামরিকচক্র দ্রুত গতিতে ক্ষমতা বলয়ের কেন্দ্রে চলে আসে। বেসামরিক লেবেলযুক্ত কিছু আমলা ও সুবিধাসন্ধানী ব্যক্তিবর্গকে সরকারে স্থান দিয়ে সামরিক নেতৃত্ব নিজেদের কর্তৃত্ব সংহত করার জন্যে প্রশাসনের উপরিকাঠামোতে নিজেদের প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠিা করে নেয়। এরপরে তারা শুরু করে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সাঁড়াশী আক্রমণ। আক্রমণের শুরুটা জোট সরকারের লুটেরা মন্ত্রী ও নেতৃবৃন্দ হলেও ক্রমশঃ তা সর্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে। রাজনীতিকদের জঘন্য সব কুকর্মের ইতিবৃত্ত উলঙ্গভাবে জনসমক্ষে চলে আসে। ফলে রাজনীতিকরা মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয় এবং উপদেষ্টা সরকার জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর এর ওপর ভর করে উপদেষ্টা সরকারের মূল নিয়ন্ত্রক সামরিক আমলারা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতা ভোগ করার মানসে রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থানুকূলে নিয়ে আসার জন্যে রাজনীতির ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ তারা নিজেদের পরিকল্পনাকে কাটসাঁট করে ”মাইনাস টু” ফর্মূলা বাদ দিয়ে জামাত-বিএনপি জোট সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের দিকে সমস্ত আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করে। এটি এখন মানুষের কাছে জলবৎ তরলং পরিষ্কার হয়ে গেছে।


গত সংখ্যার ’বিদেশ বাংলা’য় আমি ”দু’মুখো সাপ বনাম গণতন্ত্রের কুসুমগন্ধ” নিবন্ধে সরকারের বর্তমান নীতির ব্যাপারে আলোকপাত করেছি। সরকারের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে গেছে জামাত-বিএনপি জোট সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। তাদের প্রতিহত করার জন্যে এ মুহূর্তে জামাত-বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে পরিকল্পনা মাফিক। কিন্তু এতে পরিণাম হলো কি ? জনপ্রতিনিধিত্বহীন একটি ”সাময়িক সরকার” জাতির বিপদকালীন সময়েও জাতিকে বিভক্ত করে রাখলো। জাতির দুর্ভোগকে দীর্ঘায়িত করে, নাগরিক সমাজের ভুমিকাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বানভাসি মানুষের মনে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করা হলো। বন্যাকবলিত লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখলো তাদের কোন জনপ্রতিনিধি নেই। যারা যে কোন বিপদ আপদে মানুষের কাছে এসে দাঁড়ায় তারা সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর উর্দিপরা কিছু মানুষ তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সব সময় দেখা যায় কেন্দ্র থেকে সাহায্য আসার আগেই দুর্যোগ কবলিত মানুষ তাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সাহায্য সহায়তা পেয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি নিরাপদে থাকা নাগরিক সমাজও যথাসাধ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এবার তারা দশদিন ধরে ঘরের চালে খেয়ে না খেয়ে বসে আছে অথচ কেউ আসে নি। মানুষকে দুঃসময়ে মানুষের সাহায্য পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেয়ে বড়ো অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। তেমনি দেশের মানুষের তাদের নিজস্ব জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের শপথ নিয়ে উপদেষ্টা সরকার দায়িত্ব নিয়েছেন। সেই দায়িত্ব কতটুকু সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে তা এখুনি মানুষ বুঝতে শুরু করেছে।


আগস্ট ১৯, ২০০৭ ইংরেজী।