খোরপোশ পাবে কর্মহীন কিংবা অসুস্থ স্বামী
মিল্লাত হোসাইন
দম্পতির মধ্যে তালাক, পৃথকাবাস (সেপারেশন) কিংবা এধরনের ঘটনায় আমরা স্বামী কর্তৃক স্ত্রী কিংবা সন্তানকে ভরণপোষণ বাবদ মাসোহারা প্রদান কিংবা এ জাতীয় কিছু আইনি ব্যবস্থার কথা আমরা সচরাচর শুনে আসছি। স্ত্রী স্বামীকে খোরপোশ দেবে এমন একটা বিষয় আমাদের দেশে প্রায় ভাবনার অতীত, অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাগ্রসর আইনব্যবস্থায় এটি একটি সাধারণ ব্যাপার। এমনকি আমাদের পড়শি দেশ ভারতেও এটি একটি আইন দ্বারা স্বীকৃত বিষয়।
গত ৬ এপ্রিল কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শুভঙ্কর ভট্টাচার্য, একটি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় এ রকম একটি রায় দেন। বিচারক হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী সুচিত্রা দাস (৪৮) নামক এক জন চাকুরিজীবী নারীকে তার পঞ্চাশোর্ধ বয়েসী স্বামী মদন মোহন দাসকে মাসিক ২০০০ রুপি করে খোরপোশ এবং মামলার খরচ বাবদ আরো ১০০০ রুপি দেবার আদেশ দেন। এ সময় বিচারক মন্তব্য করেন যে, আইন একপেশে হতে পারে না। যদি কর্র্মহীন স্ত্রীরা তাদের কর্মজীবী স্বামীদের কাছ থেকে ভরণপোষণ পেতে পারে, তবে অসুস্থ ও কর্মক্ষম নয় এমন স্বামীরাও তাদের উপার্জনশীল স্ত্রীদের কাছ থেকে খোরপোশ পাওয়ার অধিকারী। তিনি আরো বলেন, হিন্দু বিবাহ আইন -১৯৫৫ এর ২৪ ধারায় সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে যে, স্বামী যদি অসুস্থ কিংবা উপার্জনক্ষম না হয়ে থাকে তবে স্ত্রী তাকে খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবে।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, মামলার বাদী সুচিত্রা দাস ডাক বিভাগের একজন কর্মচারী। তার স্বামী মদন মোহন দাস একটি স্টেশনারি দোকান চালাতেন। তিনি তার বিধবা মাকে নিয়ে স্ত্রীর কোয়ার্টারে বসবাস করতেন। স্ত্রী সুচিত্রা প্রায়শই স্বামী এবং শাশুড়ির সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন। এমনকি লোকজনের সামনেও তাকে নানা ভাবে অপমান করতো। যা তার ব্যবসায় খারাপ প্রভাব ফেলে। ২০০৩ সালে মদন মোহন তার মাকে নিয়ে তার ভাইয়ের বাসায় চলে যায়।
পরের বছর সুচিত্রা তার বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করেন। মদন মোহন আদালতে এই মর্মে দাবি করেন যে, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তার স্ত্রী তার সাথে অন্যায় আচরণের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। তদুপরি তার ব্যবসার সুনাম নষ্ট করেছেন, যা তার উপার্জনের একমাত্র উপায় ছিলো। তাছাড়া মামলার খরচ চালাতে গিয়েও তাকে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে এবং ক্রনিক অ্যাজমার রোগী হওয়ার কারণে তার পক্ষে কায়িক শ্রম করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় তিনি তার এবং তার ওপর নির্ভরশীল তার বিধবা মায়ের জীবনধারণের জন্য আদালতের কাছে তার স্ত্রী নিকট হতে ভরণপোষণ পাওয়ার আবেদন জানায়। বিচারক ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে তার পক্ষে রায় দেন।
ইতোপূর্বে, ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর উড়িষ্যা হাইকোর্ট একটি মামলায় জ্যেৎস্না দাস নামের এক বেসরকারি স্কুল শিক্ষককে তার স্বামী শুভেন্দু সারাঙ্গীকে মাসিক ৫০০ রুপি এবং একই সালের ১৮ নভেম্বর উত্তর প্রদেশ হাইকোর্ট কল্পনা গুপ্তা নামক এক ব্যাংকারকে তার কর্মহীন স্বামী সন্তোষ কুমার গুপ্তাকে মাসিক ২০০০ রুপি খোরপোশ বাবদ দেয়ার নির্দেশ দেয়।
আদালতের এই সব রায়ের মাধ্যমে যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তা হলো- এটা কি নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সমতা বিধানের পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ? এর পক্ষে যেসব যুক্তিগুলো তুলে ধরা হচ্ছে সেগুলো হলো- আইনগুলো নারীদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। এর ফলে তাদের হাতেও যে কখনো কখনো স্বামীরা নির্যাতিত হতে পারে, তা কারো মাথায় থাকে না। কিংবা, বিয়ে যেহেতু চুক্তি তাই কোন একপক্ষ যদি তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তবে অন্যপক্ষ যেন বিপন্ন অবস্থায় না পড়ে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে, আজকাল প্রচুর নারী ভালো উপার্জন করেন- তাই তাদেরও দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে নারীনেত্রী ও লক্ষ্মৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রূপরেখা ভার্মার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- আর্থিকভাবে সচ্ছল নারীদের ক্ষেত্রে এতে আমি কোন সমস্যা দেখি না। এতে কারো কারো ভ্রু কুঁচকে উঠতে পারে, তবে এর জন্য আমাদের সমাজ কাঠামোই মূলত দায়ী। কারণ আমরা এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত নই। স্বামী বেকার এবং খোরপোশ দাবি করছে এধরনের ঘটনা বা মামলা খুবই কম দেখা যায়। যদিও এরকম পরিবারের সংখ্যা অগুনতি যেখানে নারীরাই একমাত্র উপার্জনকারী।
তবে তিনিও এ রায়কে সমতার সমস্যার একটা মহাসমাধান বলে মানতে নারাজ। তার মতে এক্ষেত্রে আরো অনেক কাজ করতে হবে।
অপর নারী অধিকার নেত্রী সুভাষিনী আলি সেহগাল চান সর্বাগ্রে চান নারীদের সমস্যাগুলোর সমাধান। কেন না উপমহাদেশে নারীরা পুরুষদের তুলনায় এখনো অনেক বেশি বিপন্ন অসহায়। আদালতে এরকম অসংখ্যা মামলা এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে যেখানে রোজগারহীন হাজারো নারী তাদের প্রাক্তন স্বামীদের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাচ্ছে না। তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। আদালতকে আগে সেগুলোর মীমাংসা হওয়া করতে হবে।
ভরণপোষণের বিবেচনায় ১৯৫৫ সালের ভারতীয় হিন্দু বিবাহ আইনটি অত্যন্ত অগ্রসর এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, এতে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক পরিচয়কে বড় করে না দেখে দেখা হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কে বেশি দুর্দশায় পতিত হবে সেই বিষয়টিকে এবং এটাই ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়। কেন না যখনই কোন আইন প্রণয়ন করা হয় তখনই এর পেছনে যে মূল উদ্দেশ্য থাকে তা হচ্ছে দুর্গতকে রক্ষা করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে নারী যে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি দুর্গত সে সত্যিটা যেন চাপা পরে না যায়।
লেখক: আইন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী।