জগন্নাথ হল ট্রাজেডী: মানুষের মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা
মোহাম্মদ আলী বোখারী


অক্টোবর এলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশির দশকে পড়–য়া প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রাণে জগন্নাথ হল ট্রেজেডীর কথা অনুরণিত হয়। ঠিক বাইশ বছর আগের কথা। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাত পৌণে নয়টায় দূর্গাপূজার ছুটিতে পরদিন বাড়ী যাবে এমন ৩৯ জন ছাত্র, দর্শনার্থী এবং কর্মচারীকে এখানে প্রাণ হারাতে হয়। সেই সাথে আহত হয় আরও ৩০০ জন। তারা সে সময় তদাণীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের পরিত্যক্ত প্রাদেশিক সংসদ, অর্থাৎ জগন্নাথ হলের অডিটরিয়ামে বসে অন্যান্যের সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ দেখছিলেন। নিজেদেরই এক সতীর্থ মনন অধিকারীর অভিনয় দেখবেন সে প্রত্যাশায় অডিটরিয়ামটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ ভয়ংকর শব্দ; সেই সাথে সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে এক নারকীয় অবস্থা। গগনবিদারী চিৎকারে চতুষ্পার্শ্ব ততক্ষণে এক ধ্বংস স্তুপ। বৃষ্টির জলে ৬৪ বছরের পুরনো চুণ-সুড়কীর ছাদ ভেঙ্গে গেছে। ইট, টাইল, লোহা ও কাঠের গরাদসহ চুণ-সুড়কীর স্তুপে চাপা পড়েছে সকলে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এই ট্রেজেডীর সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সে সময় জগন্নাথ হলে কোন ছাত্র সংসদ না থাকলেও দ্রুতই উদ্ধার কর্মে এগিয়ে আসেন তদাণীন্তন ডাকসু-র ভিপি আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অন্যান্য হলের ছাত্র-ছাত্রীরা। ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মনসুরও দলের কর্মীদের নিয়ে এগিয়ে আসেন। হলের প্রভোষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ললিত মোহন নাথ চট্রগ্রামে থাকলেও পরদিন ছুটে এসেছেন। এমনকি তৎকালীণ স্বৈরশাসক হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ নাইরোবীতে কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনে থাকলেও তড়িঘড়ি ছুটে এসেছেন এবং পরে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লক্ষ টাকা করে প্রদান করাসহ পাঁচ তলা ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’ নির্মাণের জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন।

তবে ঐ মর্মান্তিক ঘটনার সাথে সাথেই সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত তৈরী করেছিল দমকল বাহিনী, পথচারী মানুষ, রিক্সাওয়ালা, প্রতিবেশী ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরাসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার মানুষ। তারা কেবল উৎসুক্যতা নিয়েই ছুটে আসেনি, বরং এসেছিল নিজেদের রক্ত দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে। আজ এতো বছর পর এ কথা বলাটা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৬ বছরের ইতিহাসে এমন সতত মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং একই সাথে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার ক্ষেত্রে এক আদর্শিক দীক্ষার সামিল।

জগন্নাথ হল ট্রেজেডীর পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছরই ১৫ অক্টোবর পালিত হয় ‘শোক দিবস’ হিসেবে। এ উপলক্ষে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে অক্টোবর স্মৃতি ভবনে শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শোক যাত্রা করে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। এছাড়া প্রদর্শনী, আলোচনা অনুষ্ঠান এবং রক্ত দান কর্মসূচীও থাকে। তথাপি যা পরিতাপপূর্ণ তা হচ্ছে, এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো হল গুলোর সূর্য সেন, ফজলুল হক ও কার্জন হলে বিরাজ করছে ঝুকিপূর্ণ অবস্থা। এ দুরাবস্থা সহসাই কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত এবং রুটিনমাফিক যথোপযুক্ত সংস্কার হওয়া দরকার। আমরা চাই না, আর কখনও জগন্নাথ হল ট্রেজেডীর মতো অন্য কোন দূর্ঘটনায় কোন ছাত্র বা ছাত্রীর প্রাণহানি ঘটুক।

আসছে ১৫ অক্টোবর আমরা জগন্নাথ হল ট্রেজেডীর শিকার সেই ৩৯ জন নিহতের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপশি তাদের শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকেও স্মরণ করছি। তবে তাদের আত্মত্যাগ সে সময়ে আমাদের প্রাণে যে মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বোধ জাগিয়ে তুলেছিল, তা যেন কখনও আমরা ভুলে না যাই। শুকতারা (ভেনাস) পৃথিবী নামের গ্রহের অতি নিকটতম এক গ্রহের নাম। আজ থেকে বাইশ বছর আগে যে শুকতারা নাটকের জন্য তাদের আত্মহুতি ঘটেছিল, সেই আত্মত্যাগের মহিমা যেন আমাদের জাতীয় জীবনের শ্বাশত সঙ্গী ও প্রেরণা হোক - এ কামনাই করছি।
মোহাম্মদ আলী বোখারী: কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক।