একাত্তরের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ
মোহাম্মদ আলী বোখারী
জেল হত্যা দিবসের ওপর ৪ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তারা যুদ্ধ অপরাধী, রাজাকার ও আলবদরদের জরুরি আইনে বিচার দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় বিচারপতি কে এম সোবাহান প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ না হলে দেশ স্বাধীন হলো কি করে? বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ করা হয়েছিল, যা সংবিধানে আছে। তাই যারা বলছে মুক্তিযুদ্ধই হয়নি এটা সংবিধান লঙ্ঘন। এ অপরাধেই তাদের বিচার দাবি করছি’ (যায়যায়দিন: ৫ নভেম্বর, ২০০৭)।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মহুতি, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমহানি, লাঞ্ছনা এবং নিরস্ত্র মানুষের উপর পরিচালিত অবর্ণনীয় হত্যাকান্ড, নিষ্পেষন ও লুণ্ঠনের ঘটনা - আমাদের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বোচ্চ এবং মহত্তম অবদান। এ নিয়ে গত ২৫ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশের মিডিয়া জগত যথেষ্ঠ সরব হয়ে ওঠেছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
৬ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় মোড়ল নজরুল ইসলামের ‘সে সময় যুদ্ধাপরাধীরা যেভাবে রক্ষা পায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রকাশ - অভিযুক্তদের পক্ষে বলা হচ্ছে, দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করে গেছেন। অন্যদিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের শক্তির অভিমত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু সাধারণ যুদ্ধবন্দীদের সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ- এই চার শ্রেণীর যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করেননি। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে মুক্তি পায় ৩০ সহস্রাধিক কারাবন্দি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমদ ইত্তেফাককে জানান, বঙ্গবন্ধু চার শ্রেণীর যুদ্ধাপরাধীদের কোনভাবেই ক্ষমা করেননি। ৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক দালাল আইন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু কখনই এই চার শ্রেণীর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেননি। বরং ঐ সময় এসব অপরাধের অভিযোগে অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়াধীন ছিল। তবে জামায়াতের মহাসচিব বিএনপি জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মো. মুজাহিদ ইত্তেফাককে গতকাল বলেছেন, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করে যান। খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জামায়াতের কেউ জড়িত ছিল না। ফলে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পরও ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালেও জামায়াতের কোন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এমনকি পরবর্তীতে মরহুম জিয়াউর রহমান দালাল আইন প্রত্যাহার করার ফলে কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের সঙ্গে জড়িত জামায়াতের কোন নেতা ছিলেন না। . . . . . .এছাড়া প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ১৯৭২ সালে সম্পাদিত ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তির প্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীও ক্ষমা পেয়ে যান। পরে তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। অথচ তৎকালীন সরকার ১৯৫ জন পাক সেনা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ঐ সময় প্রশ্ন উঠে এমনকি কারণ ঘটেছিল যাতে তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লীতে পাক যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার সমাঝোতায় স্বাক্ষর করেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সিমলা চুক্তির প্রেক্ষিতে দিল্লীতে ১৯৫ জন পাকসেনা যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ।
তথাপি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা কেন করেনি অথবা কেন রাষ্ট্রক্ষমতা পাবার উদগ্রীব আকাঙ্খায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে ঐক্য গড়ে রাজনীতি এবং আন্দোলন করেছে অথবা কুখ্যাত রাজাকারের মালিকানাধীন পত্রিকা ও তার সম্পাদকের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে - একটু বিশ্লেষণ করলে আওয়ামী লীগের মুখে সেই বিচার দাবি নতুন করে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রলুব্ধতা ছাড়া আর কি মনে হতে পারে? তার অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়াটা অযৌক্তিক। অবশ্যই যৌক্তিক এবং সে জন্য আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে যে ব্যর্থতা আছে, তা অকপটে স্বীকার করে নেয়াটা হবে উৎসর্গীকৃত শহীদ ও অপমানিত নারীর প্রতি সময়ের অবগাহনে যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শনমূলক এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমান করাটাও একান্ত করণীয় কর্তব্য।
এটা ভাবতে কষ্ট হয় যে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় পাঁচ বছরের মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়া সত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির কর্মকান্ডকে এক প্রকার পঙ্গু করে ফেলে, যা পরে আর মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। সে সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সূচিত এবং বেগম সুফিয়া কামালের ঘোষিত যুদ্ধাপরাধীদের ও অধ্যাপক শাহরিয়ার কবীরের সকল প্রয়াস-প্রচেষ্টা নি¯প্রভতায় নিপতিত হয়, যা জনসাধারণের দৃষ্টি এড়ায়নি। আওয়ামী লীগের এই সুবিধাবাদি ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এবং মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তাদের সংগ্রাম, দাবি ও কর্মসূচি কতটা ব্যত্যয়পূর্ণ এবং কায়েমি স্বার্থে, সে প্রশ্ন ওঠাটাও অস্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে ৩০ অক্টোবর ২০০৭ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত প্রখ্যাত লেখক বদরুদ্দীন ওমর-এর ‘একাত্তরের যুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা কোনো বিতর্কের বিষয় নয়’ শীর্ষক লেখাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি শুরুর দিকে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যাবে, যা প্রকৃত সংবাদ নয় (নন-নিউজ) এমন সব বিষয়ই সংবাদপত্রের শতকরা ৬০, ৭০ ও ৮০ শতাংশই দখল করে রাখে। এ কারণে দেখা যায়, একজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির, এমনকি তারও নিু পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদেরও দুর্নীতি বা অন্য কোনো কারণে শাস্তি হলে তার খবর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে প্রথম খবর হিসেবেও ছাপা হয়ে থাকে। কোনো নেতা, এমনকি তার স্ত্রী চিকিৎসার জন্য বাইরে গেলে তারও সচিত্র রিপোর্ট বড় অক্ষরে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। আবার দেখা যায়, এ ধরনের নন-নিউজের এ অবস্থা হলেও জনগণের অনেক আন্দোলন ও সংগ্রামের খবর, দেশের বিভিন্ন সমস্যার ওপর আলোচনা বা বক্তৃতা-বিবৃতির রিপোর্ট সংবাদপত্র অফিসে পৌঁছালে নিউজ সেকশনের বাতিল কাগজের বাক্সে সেগুলোকে ফেলা হয়। এভাবে এসব খবর খুব পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়। এ কাজের জন্য সরকারের কোনো নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। সরকার যে স্বার্থে কাজ করে, এরাও সেই স্বার্থে কাজ করার কারণেই স্বার্থের ঐক্য তাদের একই রকম কাজের জন্য প্ররোচিত করে। এদিক দিয়ে বিচার করলে সংবাদপত্র শাসকশ্রেণীর পক্ষে এবং অনেক সময় সরাসরি সরকার বা কোনো শাসকচক্রের পক্ষেই কাজ করে। স্বার্থের ঐক্যের কারণে এ ধরনের কাজের জন্য যে কোনো সরকারি নির্দেশের প্রয়োজন হয় না।’ আর ঐ লেখার শেষটায় লেখক যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি লিখেছেন, তা হলো - ‘আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ও তার মতো দলকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার ইস্যুটিও এ রকমই এক ইস্যু। দেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির কাজ হলো, রাজনৈতিকভাবে জামায়াত ও তার মতো দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে পরাজিত করা। এভাবে তাদের বাস্তব রাজনীতি ক্ষেত্র এবং সেই সঙ্গে নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন করা যায় যদি এসব প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি জনগণের স্বার্থে ও প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করে। যে কাজে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্র পরিত্যাগ করে সংবাদপত্রের পাতায় এবং বক্তৃতা-বিবৃতির আশ্রয় নিয়ে তারা জামায়াতের সঙ্গে এক বাতিল ইস্যু নিয়ে দ্বদ্ধে ও বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছে। এভাবেই প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মীয় শক্তিগুলোকে তথাকথিত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দল ও ব্যক্তিরা, তাদের সহযোগী বুদ্ধিজীবীরা পুনর্বাসন ঘটিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিএনপি-র যথেষ্ঠ ভূমিকা থাকলেও তাদের পক্ষেও এ কাজ সম্ভব হতো না, যদি উপরোক্ত পদ্ধতিতে অন্যরা জামায়াতকে অন্ধকার থেকে আলোয় বের করে আনার ব্যাপারে নির্ধারক ভূমিকা না রাখত।’
দেখা গেছে, একুশে টিভির ৪ নভেম্বর ২০০৭ রাতে সম্প্রচারিত ‘একুশে সময়’ অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের উপস্থিতিতে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সর্ম্পকিত বিষয়ে অনুরোধ জানানো হয়। উত্থাপিত বিভিন্ন যৌক্তিক প্রশ্ন সত্বেও উত্তরে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, প্রথম কথা হলো আপনাকে বুঝতে হবে যে, বর্তমান সরকার কি অঙ্গীকার এবং কি দায়িত্ব পালনের জন্যে এসেছে। অতএব যতই মর্মান্তিক হোক, যতই কঠিন হোক এটা আমাদের কাছে কঠিন প্রমাণিত হতো না বা আমি কঠিন মনে করতাম না যদি সময় মতো আমাদের মতো লোকদের সুযোগ দেয়া হতো। এখন আমরা যে সংকট উত্তরণের কথা চিন্তা করছি সেটা হলো দেশে সুশাসনের কথা। আমার মনে হয় এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছ থেকে খোঁজা উচিত যারা ৩৬ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তারা কেন কিছু করেননি। আমরা তো একটা সীমিত দায়িত্ব নিয়ে এসেছি এবং এটা সীমিত সময়ের সরকার। আমাদের দায়িত্ব হলো সুশাসন সর্ম্পকিত দায়িত্ব যে ভবিষ্যতে দেশে একটা সুশাসন প্রতিষ্ঠার। আমরা যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি এটাও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অংশ। আজকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরন করেছি এটা সুশাসনের অংশ হিসেবে করছি। অতএব আমাদের ওপর যে কঠিন দায়িত্ব পড়েছে সেই কঠিন দায়িত্ব নিয়েই আমরা ব্যস্ত আছি। অতীতের কঠিন দায়িত্বের কথা কেন তারা পালন করেনি এ প্রশ্নতো তাদেরকেই করা উচিত। আমি সেই অবস্থায় থাকলে উত্তর দিতাম। যেহেতু আমি একটা সরকারের অংশ, সরকার যে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে সেই দায়িত্ব যাতে আমরা সমাধা করতে পারি, কঠিন দায়িত্ব সমাধা করতে পারি সেটা নিয়ে আমরা ব্যস্ত।
আইন উপদেষ্টার উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায়োরিটিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠাকেই একান্ত গুরুত্ব দিয়েছে বা দিচ্ছে, অতীতের কোন কঠিন ও মর্মান্তিক বিচার সম্পন্ন করাকে নয়; যদিও ৩১ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ফখরুদ্দীন আহমদ জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সেটা আমার কাছেও অনভিপ্রেত। তবে কে যুদ্ধাপরাধী সেটা নির্ধারণ করা একটি আইনি বিষয়। এ ব্যাপারে উৎসাহী ও সংক্ষুব্ধ যে-কোনও নাগরিকই আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
তা হলে একাত্তরের গণহত্যা ও এ সংক্রান্ত য়ুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি কি আবারও ভেস্তে যাবে? না, সেটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, স্বাধীনতা, সংবিধান ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী কোন মানুষই আর চাইবে না ও সহ্য করবে না। তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধ প্রমান করার জন্য ব্যক্তিবিশেষ বা সংগঠনের নিরাপত্তাপূর্ণ সাক্ষ্য প্রদানসহ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগটি যে একান্ত জরুরী, সে দাবীটি প্রকারান্তরে সকলের। সে কথা মুক্তিযুদ্ধের সকল সেক্টর কমান্ডারসহ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির সভাপতি ডক্টর এম. হাসান ও অমিততেজ মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (অব.) বীর প্রতীকও দাবী করেছেন। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট চালিয়েছে; গণহত্যার পরিকল্পনা করেছে বা নির্দেশ দিয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হয়ে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে; যারা হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে জড়িত ছিল অথবা এসব অপকর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে তাদের প্রত্যেককেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে। সে সময়ের দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের যেমন দেশের বিরাজমান আইনেই বিচার করা সম্ভব তেমনি যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী রাজনীতিক ও সেনাপতিদের বিচার হতে পারে আন্তর্জাতিক আদালতে; কেননা জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র যে কোনো গণহত্যার বিচার প্রতিপালনে অনুগত অথবা সঙ্গতিপূর্ণ আইন প্রণয়নে বাধ্য। এমনকি প্রবাসে আমরা যারা আছি, সম্ভব হলে আমাদের স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে সংশ্লিষ্ট দেশের সাংসদ বা আইনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব আইনসভায় বা সংসদে একাত্তরের গণহত্যার ওপর বিবৃতি প্রদান বা বিল উত্থাপনে সচেষ্ট ও উৎসাহিত হতে পারি। যেমনটি ২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর ফ্রান্সের পার্লামেন্টে আর্মেনিয়ানরা অটোমান টার্কির বিরুদ্ধে গণহত্যার ওপর এক বিল পাশে সক্ষম হয়। ঐ বিল কতৃক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থাৎ ১৯১৫-১৯১৭ সালে অটোমান টার্করা যে পনের লক্ষ আর্মেনীয়কে হত্যা করেছে, সেই গণহত্যাকে অস্বীকার করা হচ্ছে অপরাধের শামিল। তাই প্রয়োজন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অতি প্রতীক্ষিত নির্বাচনে প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে জাতির কাছে রাজনৈতিক ইশতেহারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ঘোষনা দেয়া যে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে একাত্তরের গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিচার করবেন-ই করবেন; তাতে কোন ত্র“টি বা প্রতিশ্র“তির বরখেলাপ হবে না। একই সাথে ভুললে চলবে না - ‘উত্তেজনা ও শক্তি এক জিনিষ নয়’।
কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক। ই-মেইল: [email protected]