কাদেরী কিবরিয়া: রবীন্দ্র সঙ্গীতের হল অব ফেম
মোহাম্মদ আলী বোখারী
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রেমী মানুষের কাছে অতি পরিচিত নাম - কাদেরী কিবরিয়া। মুক্তি যুদ্ধকালীণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সুর ও ধ্বনীর আবহে যারা প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, তাদেরও একজন তিনি। অন্যরা হচ্ছেন - আপেল মাহমুদ, আবদুল জব্বার ও সমর দাশ। এই চতুষ্ঠয়ের অনুরোধেই এই কেন্দ্রে যোগ দিয়েছেন সে সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত পূজারী অজিত রায়। আজ সে কথাটি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না গেলেও রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চাকে ঘিরে বাংলাদেশে বিদ্যমান দুই ধারার প্রবাহে এই শিল্পী নিজেকে অতি দূরে সরিয়ে নিয়েছেন; সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। তেমনি নিরবে চলে গেছেন কানাডার টরন্টোয় শাহজাহান কামাল এবং অষ্ট্রেলিয়ায় চঞ্চল খান ও সিরাজুস সালেকীন।
রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চায় কাদেরী কিবরিয়ার পরিচিতি কেবল গায়কী শিল্পত্বে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেখানে তার অনবদ্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যও যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে অনুশীলন ও শিক্ষায়। তার শিক্ষা গুরু রবীন্দ্র সঙ্গীতের দিকপাল শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস ও চিন্ময় চট্রোপাধ্যায়। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বানিজ্য বিভাগে মাষ্টার্স অর্জনসহ সঙ্গীতে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে মাষ্টার্স লাভ। সম্ভবতঃ সে কারনে তার গায়কী কন্ঠ ও উপস্থাপনা অপরাপর শিল্পীর তুলনায় ভিন্ন ঢং ও মেজাজের। এছাড়া সঙ্গীত ও পেশার ক্ষেত্রে তিনি সব সময়েই তার চিরায়ত ভারসাম্যটি রক্ষা করে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে একাউন্টিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনসহ রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপর বের করেছেন নিজের সিডি এ্যালবাম - ‘দিনের শেষে’ ও ‘হে নিরুপমা’। একই সাথে বের করেছেন আধুনিক বাংলা গানের সিডি - ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’। অন্যদিকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি হৃদয়ের অতি নিগূঢ়তা থেকে স্মৃতিচারণসহ প্রকাশ করেছেন - ‘আকাশ ভরা সূর্য তাঁরা’। নিঃসন্দেহে এ প্রেরণাগুলো তার চির সজীব একাগ্রতারই বহিঃপ্রকাশ।
কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর রচিত প্রায় ২,২৩০ টি রবীন্দ্র সঙ্গীত বাংলা সংস্কৃতির এক অমূল্য ভান্ডার। ভিন্ন মর্মার্থের এ গানগুলো বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় ইংরেজী সাহিত্য সম্রাট সেক্সপিয়ারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এটির প্রধান কারন হচ্ছে - রবীন্দ্র সঙ্গীত বাঙালী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রায় ৫০০ বছরের সময়কালকে একটি মূল্যবান সূত্রবন্ধনে আবদ্ধ করেছে। বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক ধন গোপাল মুখার্জী তার বই: ‘কাষ্ট এন্ড আউটকাষ্ট’-এ উল্লেখ করেছেন যে, These songs transcend the mundane to the aesthetic and express all ranges and categories of human emotion. The poet had given a voice to all - big or small, rich or poor. The poorest boatman on the Ganges as well as the rich landlord find expression for their emotional trials and tribulations in Tagore's songs. বস্তুতঃ সঙ্গীত চর্চায় রবীন্দ্র সঙ্গীত এক স্বাতন্ত্র্যসূচক অবস্থানেরই পরিচাযক। আর এ সঙ্গীত চর্চায় নিবেদিত শিল্পীরা সনাতনী ধারারই অনুকূলে আছেন, এমন ধারনাটির পক্ষে-বিপক্ষে কিছুটা যুক্তি-তর্ক আছে বটে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে। তথাপি বেথহোভেনের সুর-মূর্চ্ছণা কিংবা ওস্তাদ বেলায়েত খানের সেতার বাদনের মতো রবীন্দ্র সঙ্গীত শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত ও সংস্কৃতিপ্রবন শ্রোতাকেই কাছে টেনে নেয়। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কবি রবীন্দ্র নাথ স্বয়ং তার রচিত অধিকাংশ গানের সুর করেছেন - কখনো পাশ্চাত্যের ক্ল্যাসিকাল অথবা স্বদেশী ঐতিহ্যের অনুকরণে। চলচ্চিত্রের যে নিজস্ব একটি ভাষা হতে পারে, সে ধারনাটিরও প্রবক্তা রবীন্দ্র নাথ। ১৯২৯ সালে তিনি লিখেছেন, The beauty and grandeur of this form in motion has to be developed in such a way that it becomes self-sufficient without the use of words. সে কারনে ব্রিটিশ, ইউরোপিয়ান ও অষ্ট্রেলিয়ান চলচ্চিত্রের পাশাপশি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, নিতিন বোস, তপন সিনহা ও কুমার সাহানি-র চলচ্চিত্রে সে ধারাটি সৌন্দর্য ও ‘সিনেমেটিক মুড’-কে ধারন করেছে।
তাই বাঙালীর সংস্কৃতি ও সঙ্গীত জগতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের এই অমূল্য বিশাল অবদান ও প্রভাবকে তুলে ধরতে ধান ভান্তে শিবের গীত। তবে বাংলাদেশে যারা রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাদের কেবল স্বীকৃতি প্রদানে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; বরং তাদের কর্মের যথাযথ সংরক্ষণও হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য চাই সব সঙ্গীতের জন্য একটি সঙ্গীত মিউজিয়াম - যেখানে বাঙালীর হাজার বছরের গীতি আলেখ্য সাধারনের জন্য উন্ম ুক্ত থাকবে। আর সেখানে ‘রবীন্দ্র মিউজিক হল অব ফেম’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক কাদেরী কিবরিয়া-কে। একই সাথে সন্মানিত করা হোক - কলিম শরাফী (মরনোত্তর), সানজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক (মরনোত্তর), অজিত রায়, আনিসুর রহমান, শাহজাহান কামাল, পাপিয়া সরোয়ার, লিলি ইসলাম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সেলিনা মালেক, মিতা হক, সাদি মোহাম্মদ, ফজলে নিজামী (মরনোত্তর), হামিদা হক, আতিকুল ইসলাম, চঞ্চল খান, সিরাজুস সালেকীন, রাখি চক্রবর্তী, সালমা আকবর, তপন মাহমুদ, বুলবুল ইসলাম, মহাদেব সাহা প্রমুখকে।
মোহাম্মদ আলী বোখারী: কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক।
ই-মেইল: [email protected]