ত্রিবেনী আর পুজির নষ্ট সঙ্গমে কিংবা স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে লুটিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু
নুরুজ্জামান মানিক
(সন্ধ্যা থেকে ঢাকায় চায়ের কাপে ঝড় তুলা হচ্ছে পরদিন ঢাবি সমাবর্তন নিয়ে । আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি অবশ্য ভারতের দিকে স্বাধীনতা দিবসে ইন্দিরার ভাষন কে কেন্দ্র করে সেখানে খুব অস্থির সময় যাচ্ছে ইন্দিরার মতে জরুরী অবস্থার মত । একই সময় ওয়াশিংটনে বসেছে চার্চ কমিটির সভা , বের হয়ে আসছে সি আই এ নামক দানবের কর্মকান্ডের নানা হদিশ । এদিকে ঢাকাস্থ মার্কিন দুতাবাসে তিন দিন আগেই ১৫ আগষ্ট তালিকা বহির্ভুত ছুটি ঘোষিত হয়েছে কিন্তু সি আই এ ষ্টেশন চিফ চেরীসহ দুতাবাসের কর্মকর্তাদের সারা রাত অফিস করতে হবে , পাঠাতে হবে আপডেট বার্তা যার জন্য অধির হয়ে থাকবেন যুক্তরাস্ট্রস্থ হেনরী কিসিঞ্জার , আথারটন প্রমুখ । ওদিকে কুমিল্লার বার্ড থেকে ২ দিন আগে গা ঢাকা দিয়েছেন মাহবুবুল আলম চাষী ! রাতের অন্ধকারে ক্যান্টনমেন্ট বেড়িয়ে পড়ল মেজর রশিদ এর কামান আর মেজর ফারুকের ট্যাঙ্ক বাহিনী । এয়ারপৌর্টে মেজর (পরে কর্নেল) ফারুকের ব্রিফিং শেষে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে গেল মেজররা তাদের অপারেশনে , আসুন এবার আমরা চলে যাই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে । )
চাঁদ ডুবে গেছে , বিশাখাও চলে গেছে । অনুরাধা এসেছে লক্ষ কোটি তারার মিটিমিটি রহস্য নিয়ে । ধানমন্ডীর স্বচ্ছ লেকের জলে তখন শেষ রজনীর জ্বলজ্বল লক্ষনগুলো শিহরিত । ৩২ নং সড়কের সবুজ আকাশ প্রদীপ জ্বালা বাড়িটির মাথা বাড়িয়ে বেতস পাতার কচি কচি ডগাও তখন দুলছে । অদুর থেকে ভেসে আসছে মোয়াজ্জিনের আহ্বান-আস সালাতু খায়রুম মিনান্নাউম , আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ....বঙ্গবন্ধু যথারীতি ওজু সেরে ফজর নামাজ আদায় করে পড়নের পাঞ্জাবী খুলে জানালায় দাড়িয়ে দেখছেন বিউগলার মিষ্টি সুরে অধিনায়ক পতাকা ওড়াচ্ছেন । গুরুম গুরুম ! লুটিয়ে পড়লেন বিউগলার আর অধিনায়ক । চারদিক থেকে গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে আততায়ীর দল । দরজা খুলে দেখলেন সিড়িতে দন্ডায়মান মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা সহ সশস্ত্র সৈনিকদের ।
: কি চাস তোরা?
প্রথমে মহিউদ্দিন -হুদা বংবন্ধুর প্রবল ব্যক্তিত্ত্বের কাছে নতজানু হয়ে গেলেও ( মহিউদ্দিনের পিস্তল হাত থেকে পরে যায় ) পরে তারা সামলে নিয়ে শুরু করলেন বাদানুবাদ । ইতিমধ্যে শেখ কামাল তাদের হাতে নিহত হয়েছে । যা হোক বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে যেতে রাজি হলেন । রেডি হবার জন্য রুমের ভিতর গেলেন । আলাপ হল তোফায়েলের সাথে । সেনা প্রধানকেও বললেন যে তার বাড়ী আর্মী আক্রান্ত । সেনা প্রধান আশ্বাস দিলেন তিনি কিছু করবেন । ডি জি এফ আই প্রধান কর্নেল জামিল কে ফোন করলেন , জামিল বলল আমি আসছি স্যার ( উল্লেখ্য , একমাত্র পাক প্রত্যাগত আর্মী অফিসার কর্নেল জামিলই বঙ্গবন্ধুকে বাচাতে এসে নিজের জীবন উত্সর্গ করেছিলেন ) ।
গায়ে পাঞ্জাবী পড়ে হাতে পাইপ নিয়ে বেড়িয়ে এলেন সিড়ির মুখে , তার একটু পেছনে মেজর মহিউদ্দিন প্রমুখ ।( নানা সুত্রে জানা যায় ) ঠিক ঐ সময় নিচে দন্ডায়মান মেজর নুর বীর উত্তম -Stop. This bustard has no right to live . Get aside চিত্কার করে তার স্টেনগান বঙ্গবন্ধুর বুকে তাক করে মাত্র ৭ ফুট দুরত্ব থেকে ১৮টি গুলি বর্ষন করলেন ।
"ইয়া আল্লাহ বাংলাদেশকে রক্ষা করো"-বলেই সিড়ির উপর লুটিয়ে পড়লেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা , স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ১৫ ই আগষ্ট ১৯৭৫ রোজ শুক্রবার , আনুমানিক সময়-ভোর ৫:৫৫-৬:০৫ ।
বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের কেউই রেহাই পায়নি হায়েনাদের হাত থেকে । শুধু শেখ হাসিনা আর রেহানা তখন বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এ থাকায় বেচে যান ।
( বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে খুব্ধ, ব্যথিত , মর্মাহত হবার সুযো্গ আছে কিন্তু বিস্মিত হবার কিছুই নেই বরং চরম আন্তর্জাতিক ও দেশী ষড়যন্ত্রের মধ্যেও যে সাড়ে তিন বছর তিনি বেচেছিলেন তাই আশ্চর্যজনক । স্মর্তব্য , ভারতের স্বাধীনতার মাস কয়েক পরে প্রান হারান মহাত্মা গান্ধী আর স্বাধীনতার আগেই বার্মার আওংসান , পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীও মারা যান আততায়ির গুলিতে , শ্রীলংকায় বন্দরনায়েক । পার্থক্য শুধু বঙ্গবন্ধু নিহত হন সপরিবারে । সেক্সপিয়ারের ভাষায় -Men wives and children stare, cry out and run. As it were dooms day.'' রাশিয়ার আশির্বাদপুস্ট সরকার প্রধানের বিকল্প নেতা দাড় করানো মার্কিন কৌশল কিন্তু জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর স্থান নেবে এমন নেতা কই ? তাই বাংলাদেশেও ঘটল চিলির ইতিহাসের পুনারাবৃত্তি )
ইতিমধ্যে হত্যা মিশনের গ্রুপ কমান্ডার মেজর ডালিম বীর উত্তম শেখ সেরনিয়াবতের বাসায় অপারেশন শেষ করে রেডিও সেন্টারে এসে নিজ উদ্যোগে ঘোষনা দিলেন " আমি মেজর ডালিম বলছি , স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে ।'
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল (অবঃ) তাহের, কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেন, মেজর (অবঃ) শাহজাহান ওমর, ক্যাপ্টেন (অবঃ) মাজেদ প্রমুখ হাজির হলেন রেডিও বাংলাদেশে। এরপর মেজর ডালিম সেনাসদরে গিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দোকার, নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন রেডিও বাংলাদেশে। মেজর (পরে কনেল ) রশিদ ফিরে এলেন জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে। মেজর আমিন ফিরে এলেন তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল আবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে। বিডিআর প্রধানকেও ডেকে আনা হল। মোশতাক আহমদ রেডিওতে জাতির প্রতি তার ভাষণ দিলেন তখন তার পাশে ছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী , তাহেরউদ্দিন ঠাকুর । (এই তিনজন মিলেই মার্কিনপন্থী "ত্রিবেনী" যারা একাত্তরে মোশতাক ত্রয়ী হিসেবে পরিচিতি পায় তাদের মার্কিন কানেকশন আর ষড়যন্ত্র ফাস হয়ে গেলে , এদের জাতিসংঘে যাওয়া আটকানো হয় ,স্বাধীনতার পরপর মোশতাককে ছাড়তে পররাস্ট্র মন্ত্রালয় আর চাষী সচিবালয় থেকে কুমিল্লার বার্ডে । ১৫ আগস্টই এরা প্রকাশ্যে আবার মিলিত হলেন ) । প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানরা সবাই রাষ্ট্রপ্রধান খন্দোকার মোশতাক আহমদের আনুগত্য প্রকাশ করে অভুত্থানের স্বপক্ষে ভাষণ দিলেন রেডিওতে। ঐ দিনই জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। অস্থায়ী বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। একই দিন উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন জনাব মাহ্মুদুল্লাহ। মন্ত্রী পরিষদও গঠিত হয় সেদিনই।
মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ:
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী
ফনিভূষণ মজুমদার
মোঃ সোহরাব হোসেন
আব্দুল মান্নান
মনরঞ্জন ধর
আব্দুল মোমেন
আসাদুজ্জামান খান
ডঃ এ আর মল্লিক
ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী
প্রতিমন্ত্রীঃ
শাহ মোয়াজ্জম হোসেন
দেওয়ান ফরিদ গাজী
তাহের উদ্দিন ঠাকুর
অধ্যাপক নূরুল ইসলাম
নূরুল ইসলাম মঞ্জুর
কে এম ওবায়দুর রহমান
মোসলেম উদ্দিন খান
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
ক্ষিতিশচন্দ্র মন্ডল
সৈয়দ আলতাফ হোসেন
মোমিন উদ্দিন আহমদ
নতুন ডিফেন্স কাঠামো ছিল নিম্নরুপ ঃ
ডিফেন্স উপদেস্টা -বংবীর জেনারেল ওসমানি
চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ- জেনরেল খলিলুর রহমান
সেনা প্রধান -জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম
বিমান প্রধান -এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব
নৌ প্রধান -এম এইচ খান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের লাশ তখনো তার বাসভবনের সিড়িতেই পড়ে রইল , তার কথা সবাই ভুলেই গেছে । বঙ্গভবনে চলছে আনন্দ উল্লাস , খানাপিনা ! যিশু হত্যার পাপ আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ইহুদিদের । যে নেতা জীবনের বেশি সময় কাটিয়েছেন কারাগারে স্বাধিকার আর মুক্তির জন্য সেই জাতির এই পাপের প্রায়শ্চিত্য কি করতে হবে না ।
দোহাইঃ
1. Additioinal Paper Books of Death Reference No. 30 of 1998 (Arising out of Sessions Case No. 319 of 1997)Judgement Passed by Mr. Kazi Golam Rasul District & Sessions Judge, Dhaka.
2. Bangladesh: A Legacy of Blood, by Anthony Mascarenhas, Hodder and Stoughton, 1986
3. Memoir written in 2005 by Lawrence Lifschultz
4.Bangladesh: The Unfinished Revolution by Lawrence Lifschultz, London: Zed Press, 1979
5. World in Action , ITV , Granda Television , August 1976
6. বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড : ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস , অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
7. পচাত্তরের পনেরই আগষ্ট , মেজর মো মুখলেছুুর রহমান , আহমদ পাবলিশিং হাউজ ,ঢাকা ১৯৯৬
8। মুজিব হত্যায় সি আই এ , দেলোয়ার হোসেন , এশিয়া পাবলিকেশন , ঢাকা ১৯৯৬
9। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর , কর্নেল শাফায়াত জামিল , সাহিত্য প্রকাশ , এপ্রিল ২০০০
10। তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা , লে কর্নেল এম এ হামিদ , মোহনা প্রকাশনি , ১৯৯৫
11। ভোরের কাগজ , ১৫ আগষ্ট ১৯৯৩
12। বাংলাবার্তা , ১২ আগষ্ট ১৯৮৮
13. সমকাল ১৩-১৪ আগষ্ট ২০০৮
১৫ মিজানুর রহমান চৌধুরি , রাজনিতির তিনকাল