রনাঙ্গন ৭১:
অপারেশন পানিহাতা
মোঃ রহমতুল্লাহ
কোম্পানী কমান্ডার, ১১ নং সেক্টর ,১৯৭১।৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ৯ টায় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল রাও আমাদের ক্যম্পে এসে নির্দেশ দিলেন সন্ধা ৭টায় পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতা আক্রমন করতে হবে। তার নির্দেশ শুনে আমার কোম্পানির যুদ্ধারা কিছুটা ভড়ঁকে গেল । কারণ, কিছুদিন আগে উক্ত ঘাটি আক্রমন করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে ।
যা হোক, দেশ স্বাধিন করতেই হবে যে কোন মুল্যে, পিছঁপা হলে চলবে না । আমি সকলকে একত্র হতে আদেশ দিয়ে ব্রিফিং দিলাম । সবাই "জয় বাংলা " বলে অপারেশনে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করল ।সন্ধায় কর্নেল রাও এসে আমাদের প্রস্তত দেখে খুশি হলেন ।
শুরু হল আমাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললাম । আনুমানিক রাত ১১টায় পাকবাহিনীর ক্যম্পের অতি নিকটে পৌছলাম । আন্ধাররাতে কিছুই দেখা যাচিছল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচেছ হারিকেন এর প্রজ্জ্বলিত আলোয় ।
বেশ কিছুক্ষন কাদাযুক্ত ধাঙ্কক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর আদেশ দিলাম ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী সেল মারা শুরু করল । আর আমরা এল এম জি, এস এল আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল ।
ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করলাম। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনশিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায়। শত্রুমুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাশ।
সকালে বাংকারের ভিতরে দেখলাম সম্পুর্ন নগ্ন মা -বোনাদের । তাদের দেহে শক্তিবল কিছুই নেই , রক্তশুন্য ফ্যাকাঁসে ,একেকজন যেন জিন্দা লাশ । প্রশ্ন জাগে মনে "পাকিস্তানি সেনারা কি মুসলমান ", "তারা কি মানুষ নাকি নরপশু ", "তাদেরকে কুকুর এর চেয়ে নিকৃষ্ট জীব " । ১৭/১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলাম । আমাদের সাথে যে গামছা ছিল তা' দিয়ে তাদের লজ্জাঁ ঢাকার ব্যবস্থা হল । আশপাশের লোকজন এলে বীরঙ্গনাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছানোর জন্য তাদের হেফাজতে দিয়ে ক্যাম্পে চলে এলাম । সঙ্গে ছিল দুই সহযোদ্ধার লাশ ।
(লেখক পরিচিতি : জন্ম :১৯ ফেব্রু ১৯৪৩ ,শেরপুর । তিনি ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টম্বর শেরপুরে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রির্পোর্ট বাতিল আন্দোলনে সে সময়ের " শেরপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি" হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোদ্ধে বিশাল জনসমাবেশে গণন্দোলোনের ডাক দেবার জন্য গ্রেফতার ,চরম পুলিশী নির্যাতনের শিকার ও কারাজীবনশুরু এবং ১৯৬৩ সালের ১৫ মার্চ কারামুক্তি লাভ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু লাহোরে বাঙ্গালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষনা ও তার বাস্তবায়নের দাবি আন্দ্দোলনের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সহ সারাদেশে ব্যাপকহারে গ্রেফতার অভিযানের প্রেক্ষিতে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রহমতুল্লাহ পুনরায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থানে কারাবরন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন শেরপুর আওয়ামী লীগ এর যগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। উত্তাল মার্চ '৭১ এ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের দায়িত্বপালন এবং পরবর্তিতে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে ১১ নং সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনশিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রথমে গেরিলা , পরে সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশ নেন। উল্লেখযোগ্য হল :কামালপুর অপারেশন যেখানে সেক্টর কমান্ডার ক্যাঃ তাহের ও রহমতুল্লাহ কোম্পানিসহ মুক্তিবাহিনীর একাধিক কোম্পানি , মেজর জিয়া'র নেতৃত্বে জেড ফোর্স এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক সরকার তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেবার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। উল্লেখ্য, শেরপুর শত্রুমুক্ত হয় ডিসেম্বর ৬ তারিখে এবং যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল অরোরা কে মুক্তাঞ্চলে তিনি ই অভর্থনা জানান এবং নির্দেশ মোতাবেক পরদিন জামালপুর পাক হানাদার মুক্ত করার জন্য নান্দিনায় এম্বুস করেন । ১৯৭২ সানে ২২ ফেব্রুয়ারী তত্্কালীন মিত্রবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় অধিনায়ক জেনারেল নাগরাকে ময়মনসংহ সার্কিট হাউজে তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সংবর্ধনাদান করা হয়। ১৯৭২ সানে ২৮ ফেব্রুয়ারী তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি (সি এন সি) জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষরিত "স্বাধিনতা সংগ্রামের সনদপত্র" মুক্তিযোদ্ধাদের বিতরনপুর্বক নিজ নিজ কর্মে যোগদানের নির্দেশ দিয়ে ময়মনসংহ (খাগডর বি ডি আর )মাঠে ভাষনদান করেন। ১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীর নানা কর্মকান্ড ও অত্যাচার কে কেন্দ্র করে পার্টির সাথে মতবিরোধ এর প্রেক্ষিতে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করেন । )