বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও টেলিটক
নীলকন্ঠ
আমরা সবাই মোটামুটি এটুকু জানি যে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড একটি সরকারী টেলিযোগাযোগ কোম্পানি। বেসরকারী মোবাইল ফোন অপারেটরদের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, কলরেট কমানো ও সরকারের আয় বৃদ্ধির মৌলিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর যাত্রা হয়েছিল ২০০৫ সনের ৩১ মার্চ। আজ ২০০৮ সনের এপ্রিল মাস। এই তিন বছরে টেলিটকের অর্জন যেমন কম নয় তেমনি নানারকম দুর্নীতির কলঙ্কও কম নয়। টেলিটকের প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোঃ ওবায়দুল্লাহ সাহেবের নাম আপনারা দুর্নীতি দমন কমিশনের সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকায় পাবেন। কোনরকম বিজ্ঞপ্তি ছাড়া সরাসরি লোকনিয়োগ, অবৈধভাবে সিম বিক্রি থেকে শুরু করে তহবিল তসরুফের ঘটনা পযর্ন্ত রযেছে বলে শোনা যায়। আমরা দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের দু’একজন কর্মকর্তার দুর্নীতির জন্য পুরো টেলিটক পরিবার কেন অবহেলিত হবে?
বর্তমানে আমাদের দেশে টেলিটক ছাড়া আরো পাঁচটি মোবাইল ফোন অপারেটর রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই খুব প্রভাবশালী। গ্রামীনফোন, বাংলালিংক, একটেল, সিটিসেল এবং ওয়ারিদ। গ্রামীনফোনের ৬২ শতাংশ শেয়ার নরওয়ের কোম্পানি টেলেনরের হাতে; বাঁকী ৩৮ শতাংশ শেয়ার বাংলদেশের গ্রামীণ টেলিকম কর্পোরেশনের। ড. মুহম্মদ ইউনুসের খাতিরে বিনা পয়সায় লাইসেন্স নিয়ে আজ পযর্ন্ত দেশের কত হাজার কোটি টাকা যে এই কোম্পানির মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে গেছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া দুষ্কর। কারন এসব হিসাব-নিকাশ যারা করেন তাদেরকে অনেক উচ্চমূল্য দিয়ে গ্রামীনফোন সবসময় তুষ্ট রাখে।
বাংলালিংকের মালিক মিশরীয় বহুজাতিক কোম্পানি ওরাসকম টেলিকম। ২০০৫ সনের ফেব্রুয়ারিতে মার্কেটে এসে সুদক্ষ পরিচালনায় এটি এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপারেটরে পরিণত হয়েছে। এই কোম্পানির উপার্জিত অর্থের পুরোটাই বাইরে চলে যাচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়। একই কথা প্রযোজ্য দুবাইভিত্তিক আবুধাবী গ্রুপের ওয়ারিদ টেলিকমের ক্ষেত্রে।
দেশের তৃতীয় বৃহত্তম অপারেটর একটেলের ৭০ শতাংশের মালিক টি এম ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। টি এম মানে টেলিকম মালয়েশিয়া। বাঁকী ৩০ শতাংশ শেয়ার আমাদের দেশীয় কোম্পানি এ, কে, খান গ্রুপের। তাহলে এখানেও দেখা যাচ্ছে একটেলের আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
দেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেলের ৪৫ শতাংশ শেয়ার এখন রয়েছে সিংগাপুরভিত্তিক সিংটেল এশিয়া প্যাসিফিক ইনভেস্টমেন্টসের হাতে। এই কোম্পানির ৩১.৪৩ শতাংশের শেয়ারহোল্ডার প্যাসিফিক মটরস এবং বাঁকী ২৩.৫৭ শতাংশের শেয়ারহোল্ডার ফার ইস্ট টেলিকম লিমিটেড।
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের সিংহভাগ এবং আমি নিজেও টেলিটক তেমন ব্যবহার করি না। কেন করি না? সহজ উত্তর, নেটওয়ার্ক ভাল না। কথা বলতে বলতে লাইন কেটে যায়, কথা পরিষ্কার শোনা যায় না, ইকো হয় (নিজের কথা নিজে শুনি), নানারকম শব্দ হয় ইত্যাদি। তো নেটওয়ার্ক ভাল করার জন্য কী করা দরকার? পরিকল্পিতবাবে ভাল ভাল যন্ত্র বসানো দরকার, বেশি বেশি বি টি এস (সাধারন ভাষায়, টাওয়ার) বসানো দরকার এবং এগুলো রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে যোগ্য প্রকোশলীর সেবা দরকার। আর এ সবই করতে দরকার বিপুল পরিমাণ টাকা। সে পরিমান টাকা কি টেলিটকের নেই? আমি যতদূর জানি আছে; আর আজকাল ভেন্ডর কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নানারকম সুবিধা দিয়ে থাকে। যেমন, আমি একটা ভেন্ডর কোম্পানি। আপনি একটা মোবাইল অপারেটর। আপনি আমাকে শুধু কাজের অনুমতি দিন। আমি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করব, বসিয়ে দিব, প্রয়োজনে রক্ষণাবেক্ষণ করব। আপনি আমাকে আপনার আয় থেকে ধীরে ধীরে চুক্তিমাফিক পরিশোধ করবেন।
কেন তাহলে টেলিটক পিছিয়ে পড়ল? যে কৌতূহল ও উদ্দীপনার জন্ম দিয়ে সে বাজারে এসেছিল কেন তার আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট রইল না? অবশ্যই টেলিটকের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল; আছে এবং এই ত্রুটির দায় অবশ্যই কোন বোর্ড মেম্বার এড়াতে পারেন না।
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, টেলিটকের যে বোর্ড অব ডিরেক্টরস রয়েছে তার চেয়ারম্যান হচ্ছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মণ্ত্রনালয়ের মাননীয় সচিব মহোদয়। এছাড়া আর যারা আছেন তারা হচ্ছেন ঐ মণ্ত্রনালয়েরই একজন যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থ মণ্ত্রনালয়ের একজন যুগ্মসচিব, বাণিজ্য মণ্ত্রনালয়ের একজন যুগ্মসচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মণ্ত্রনালয়ের একজন যুগ্মসচিব এবং বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের বিভিন্ন বিভাগের আরো কয়েকজন সম্মানিত সদস্য। আমি যতদূর জানি, এই আসনগুলো পদাধিকারবলে স্থির।
সম্মানিত পাঠক,আপনারা নিশ্চয় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় পত্রিকায় পড়ে থাকবেন, টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারন ও উন্নয়নের জন্য প্রায় ৫৪১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত একটা প্রজেক্ট বোর্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন পড়ে আছে। কখনো শোনা যায়, বোর্ড নীতিগতভাবে প্রজেক্ট অনুমোদন দিয়েছেন; আবার শোনা যায়, এত বড় প্রজেক্ট বর্তমান বোর্ড দিতে নারাজ। কিন্তু কেন? কোন যুক্তিতে বোর্ড এই প্রজেক্ট অনুমোদন করছে না একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমার দেশের মানুষের ঘাম ঝরানো পয়সা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের চটকদার বিজ্ঞাপন আর নানারকম চতুর প্রলোভনের মাধ্যমে যে দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে সেটা কি কারো চোখে পড়ে না? আমরা ছাত্রসমাজ যে দৈনিকটাকে আদর্শ পত্রিকা বলে এখনো মানি সেই পত্রিকাটিতেও কখনো এসবের আলোচনা দেখি না। বড় দুঃখ হয়। দেশের জন্য কি আমরা এসব বিত্তধর কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের লোভ একটু সামাল দিতে পারি না?
জনাব ওবায়দুল্লাহর পরে এই প্রথমবারের মত আবার টেলিটকে একজন পূর্ণাঙ্গ এম ডি এসেছেন। বিটিটিবির ট্রান্সমিশনের জি এম মজিবর রহমান টেলিটকের এম ডি হিসেবে সম্প্রতি যোগদান করেছেন। তার কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা সেটা যেন তিনি বুঝতে পারেন।
আমরা সবাই টেলিটক ব্যবহার করতে চাই; দেশের টাকা দেশে রাখতে চাই। তাই মাননীয় বোর্ড মেম্বারদের কাছে অনুরোধ, আপনারা ছোটখাটো ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে হলেও একমাত্র ১০০ শতাংশ দেশীয় টেলিকম কোম্পানি টেলিটকের উন্নয়নের জন্য কাজ করুন।
পরিশেষে পাঠকদের জানাত চাই, এ লেখায় আমি খুবই সচেতনভাবে অনেকগুলো কথা এড়িয়ে গেছি। কারন আমি বিশ্বাস করি না অন্তত এ সরকারের আমলে একজন মাননীয় সচিব কোন একটা বিশেষ কোম্পানি বা গোষ্ঠীর পকেটে চলে যেতে পারেন।