জালাল সাহেবের বিশ্বাসের মূল্য 
নৃপেন্দ্র নাথ সরকার

 

  

লোকে বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর। নিজে ঘটনার সাথে জড়িত থেকে বস্তু মিলতে দেখেছি। মিরাকোলের মত পর পর কতগুলো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু কিভাবে বলি এগুলো বিশ্বাসের জন্যই হয়েছে? পরিসংখ্যানের ভাসায় র‌্যান্ডম অকারেঞ্চ ছাড়া আর কি? তবে বার বার ঘটলে তার মধ্যে এক রকম উত্তেজনা আর সুখানুভূতির সৃষ্টি হয়। ঘটনাপ্রবাহ কখনো-সখনো আবার মহা আত্মতৃপ্তির কারনও হয়।

 

বাংলাদেশে জালাল সাহেব নামে এক অতি সাধারন মানুষকে ঘিরে পর পর এরকম তিনটি ঘটনা ঘটে। আমেরিকাতে আসার পর ঘটে দুটো। এদুটো মোটেই গুরুত্বপূর্ন নয়। তবে জালাল সাহেবের গল্পের সাথে জুড়ে দেওয়ার মত। ক্ষুদ্র ঘটনা দুটোই আগে বলছি।  

 

এক

নানথিয়া ও সমকিড দুইবোন। থাইল্যান্ড থেকে টেক্সাস এ এন্ড এমে পড়তে আসে একই সাথে। নানথিয়া কৃষিপ্রকৌশলে পিএইচডি করার সময় সতীর্থ ড: যেফকে বিয়ে করে ফেলে। আর সমকিড বিয়ে করে রসায়নে মাস্টার্স করার সময় সতীর্থ ডঃ এরিক ক্লার্ককে। ফলে সত্যজিৎ রায়ের ছবি হীরক রাজার দুই জামাইয়ের মত আমাদের এই যেফ আর এরিক হয়ে যায় দুই ভায়রা–ভাই। এরিক-সমকিডের ছেলেমেয়ে এক এক দুইখান, নানথিয়া-যেফের নেই কোন পুলাপান।      

 

সমকিডের সাথে আমাদের ভাবটা হয় একটু বেশীই। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ব্রায়ানে ওরা থাকত নিজের বাড়িতে আর আমরা থাকতাম টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের এপারটমেন্টে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬। সমকিড প্রতি সপ্তাহে বার কয়েক আমাদের বাসায় যাতায়াত করত। একটি মাত্র বিছানায় আমাদের ছোট দুই ছেলেমেয়েরা শোয়। আর আমরা সোফাটাকে টেনে বিছানা বানাই প্রতিদিন। একদিন আমাদের এহেন দৈন্য দশা দেখে সমকিডের চিত্তে কষ্ট হয়। আর তারই পরদিন বিকেলে একটা সাদা ট্রাক এসে দাঁড়ায় আমাদের এপারটমেন্টের সামনে, ঘাস চত্বরের ওপারে। ট্রাকের দুপাশ থেকে দুই বিশাল দেহী আমেরিকান বেরিয়ে আসে। এরা আর কেউ নয়। সেই দুই ভায়রা-ভাই, যার কোন কাজ নাই, একজনের আছে পুলাপান এক এক দুই খান। সমকিডের আদেশে দোকান থেকে কিং সাইজ বিছানা নিয়ে এসেছে। বিছানার অংশগুলো দুই ভায়রা-ভাই কাঁধে করে আমাদের ঘরে প্রবেশ। তারপর  বিছানাটাকে ঠিক মত সাজিয়ে প্রস্থান। এই হল সমকিডের পাগলামি। ওর পাগলামীর শেষ নেই কোন দিনই।

 

সমকিডের বাপ-দাদারা থাইল্যান্ডে সফল ব্যবসায়ী।  ভাবল, চাকুরী করা আর গোলামী করা একই জিনিষ। তাই নিজের বাড়ী থেকেই ব্যবসা করবে। থাইল্যান্ড কাঠের দেশ। সেখান থেকে কাঠের মেঝে এদেশে সরবরাহ করবে। যে কথা, সেই কাজ। নানান ধরনের নমুনা চলে এল থাইল্যান্ড থেকে। ব্যবসার জন্য একটি ম্যাকিন্টস কম্পিউটারও কিনে ফেলল। ম্যাকিন্টস কম্পিউটার দেখে সবে বিল গেইটসের মাথায় উইন্ডোস এর ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারছে। আর সেই সময় সমকিড-এরিকের বাড়িতে বাজার ফিরতি খুচরো পয়সা গুলো লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। হাইডি আর ভিক্ট্র তখন হাটি-হাটি পা পা। যা পায় তাই নিয়ে খেলে। পেনি থেকে শুরু করে কোয়ার্টার, যখন যেটা জুটে, ডিস্কেট-ড্রাইভের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। একদিন সমকিড দেখল, কম্পিউটার আর কাজ করছে না। মনে পড়ল আমার কথা। আমিতো ইঞ্জিনীয়ার। আমার তো সব কিছুই ঠিক করতে পারার কথা। তলব হলো। এক সময় যেয়ে তার কম্পিউটারটি ঠিক করে দিয়ে আসতে হবে। সমকিডের কাজে লাগার সুযোগ পেয়ে চিত্ত পুলকিত হল। কিন্তু হায়! কম্পিউটার ভাল করার বিদ্যেটুকু যদি আজ জানা থাকত, তাহলে কত ভালই না হত!     

  

ভাবলাম, একবার যাওয়া উচিত। যেয়ে ঘন্টা খানেক পরিশ্রম করে, গা থেকে এক বিন্দু ঘামও যদি বের করতে পারি, সমকিড নিশ্চয় ভাববে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কম্পিউটারটি ঠিক করার মত অবস্থায় থাকলে আর কেউ না পারুক সরকার নিশ্চয় করতে পারত। গেলাম এক বিকেলে। সমকিড দুতলায় কম্পিউটারের ঘরে আমাকে নিয়ে গেল। কম্পিউটারটি থেকে গজ দুই দূরে দাঁড়িয়ে বললাম, পাওয়ার কেবলটি দেওয়ালের সকেটে ঢোকাও। সমকিড তাইই করল। তারপর সমকিড অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা কি সরকার? আমি বললাম, তোমার ব্যাপার জানার দরকার নেই। আমি ইটিভি বাংলা চ্যানেলের মুশকিল আসান। মুশকিল হলেই আমাকে স্মরণ করিও।

 

২ 

ডঃ ভবরঞ্জন সরকার লুজিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৯১ এর স্প্রিং ব্রেকে বেড়াতে যাই। বৌদি বললেন, আমার ক্যাসেট প্লেয়ারটি কাজ করছে না অনেক দিন। আপনি আসবেন শুনে ফেলে দিইনি, রেখে দিয়েছি। এটিকে আগে ঠিক করে দিন তো। বৌদি ছাড়া দুনিয়ার সবাই বুঝবে, ক্যাসেট প্লেয়ার ঠিক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এত আস্থা, এত বিশ্বাস! এর তো একটা মূল্য আছে! বৌদির এতদিনের অপেক্ষাকে উপেক্ষা করি কি করে!

 

কে জানত আমার ভাগ্য এত প্রসন্ন্। প্লেয়ারটি খুলেই দেখি, ড্রাইভ বেলটি পুলি থেকে বেরিয়ে আছে। আস্থা আর বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পারার অনাবিল আনন্দে চিত্ত মুহুর্তে পুলকিত হয়ে উঠল।

 

দুই

বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞানের অধ্যাপক কামাল সাহেবের মাধ্যমে কৃষি অর্থনীতি অনুষদের নিবন্ধকার, হৃদেশ রঞ্জন হালদারের সাথে পরিচয় ঘটে ১৯৭৮ সালে। সেই থেকে হৃদ্যতা চলে বহুদিন ১৯৮৯ সালে আমেরিকা চলে আসা পর্যন্ত। স্বল্পভাসী এই লোকটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে এক জী-টাইপের দুতলাতে থাকতেন। তাঁরই নীচতলায় থাকতেন আমাদের জালাল সাহেব। জালাল সাহেব অতি সাধারন মানুষ, হালদার দার মতই। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মত, মাঝারী গরণ। ভদ্র, শান্ত, বিনয়ী, এবং স্বল্পভাষী সুখী একজন মানুষ। বিধাতা যেন অতিরিক্ত কথা বলা বারণ করে দিয়েছেন তাঁকে। 

 

জালাল সাহেব কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের গবেষনাগার বিশেষজ্ঞ। ১৯৬৭ থেকেই দেখে এসেছি একই পদে। ধরাধরি ছাড়া কোন কাজ হয়না। কিন্তু এই কাজটি তিনি কখনোই পছন্দ করতেন না বা করতে পারতেন না। তাই পদোন্নতিও হয়নি। তারজন্য কোন দিন আক্ষেপ করেছেন এ কথাটি কেউ বলতে পারবে না। জালাল সাহেব প্রতিদিন সকালে বাজারে যান। তারপর নয়টা-পাঁচটা অফিস। অফিস থেকে এসে নীচতলা বাসার সামনে যে এক চিলতে জায়গা, সেইখানটাতেই ছেলেপুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, মানুষের যাওয়া-আসা দেখেন। দুই পা ফেলে রাস্তাটাতে কখনো এসে দাঁড়াতে দেখেনি। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেন আমরা প্রায়ই হালদার দার বাসায় বেড়াতে যাই। হালদার দার কাছ থেকেই নিশ্চয় শুনেছেন, আমি একজন ইঞ্জিনীয়ার। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়াই আর ইঞ্জিনীয়ার তৈরী করি। জীবনে যেন এই প্রথম একজন ইঞ্জিনীয়ারকে অত্যন্ত নিক্ট থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ইঞ্জিনীয়ার মানেই এক অতি মানব। স্বর্গের ইঞ্জিনীয়ার বিশ্বকর্মা যেমন সব কিছু করতে পারেন, মর্তের বিশ্বকর্মারাও তেমনি সব কিছু করতে পারে। রিক্সা থেকে নেমে হালদার দার বাসার দিকে পা বাড়ানোর সময় প্রতিবারই এই অতীব সুন্দর ও মধুর মানুষটি বিনয় প্রকাশ করতেন,  “আদাব দাদা, ভাল আছেন?” মাত্র একটা দিনের জন্যও তাঁর আগে এই বিনয়টি আমি প্রকাশ করার সুযোগ পাইনি।   

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকান্ড দীঘির দক্ষিন পাশে ই-টাইপের তিন তলাতে আমরা থাকতাম। একদিন সন্ধ্যাবেলা। বিদ্যুৎ নেই। হাতে একটি বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি নিয়ে হাই স্কুলে পড়ুয়া এক ছেলে এসে উপস্থিত। চাচা, আমি জালাল সাহেবের ছেলে। এই ইস্ত্রিটা কাজ করছে না। আব্বা আপনাকে ঠিক করে দিতে বলেছেন। বললাম, এখন অন্ধকার, কাল এসে নিয়ে যেও।    

 

বছর দুই পরে, ছেলেটি আবার একদিন উপস্থিত। এবারে হাতে একটি ক্যাসেট প্লেয়ার, আব্বা পাঠিয়েছেন। আপনাকে ঠিক করে দিতে বলেছেন। আশ্চর্য! কী করে বুঝাই, আমি ক্যাসেট প্লেয়ারের ভিতরের কলকব্জার মাথা কি মুন্ডু কিছুই জানিনা। আদ্দিকালের বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি ঠিক করতে পেরেছিলাম কারন ওর ভিতরে একটি মাত্র ইলেক্ট্রিক কয়েল ছিল। ওটি ঠিক করায় কোন বাহাদুরী নেই। ইস্ত্রিতে আজকাল থার্মৌস্ট্যাট থাকে, জল বাস্প করার ব্যবস্থা থাকে। থাকে একই ইস্ত্রি দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাপড় ইস্ত্রি করার নানান ব্যবস্থা। আমি এখন এই সব ইস্ত্রিও ঠিক করতে পারব না। ক্যাসেট প্লেয়ার ঠিক করার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা। জালাল সাহেবের কাছে আমি তো যে সে মানুষ নই। আমি ইঞ্জিনীয়ার, আমি স্বর্গের বিশ্বকর্মা। আমার জন্য তো অসাধ্য কোন জিনিষই নেই। ছেলেকে বললাম, রেখে যাও, কাল এস। আমারও কপাল বটে। প্লেয়ারের পেছনটা খুলতেই দেখি, একটা ছোট তার ঝালা থেকে ছুটে আলাদা হয়ে আছে। আমি তো ঝালা করতে পারিনা। অগত্যা একটা সুতো দিয়ে বেঁধে দিলাম। ঠিক হয়ে গেল।  

 

হালদার দার বাসায় যাই, আসি। জালাল সাহেবের সাথে দেখা হয় একই স্থানে, একই ভাবে। বলেন, “আদাব, দাদা, ভাল আছেন?” কিন্তু কখনো ইস্ত্রি বা ক্যাসেট প্লেয়ার ভাল করার জন্য ধন্যবাদ শূচক কোন বিনয় প্রকাশ করেন না। ধন্যবাদের কিইবা আছে। এসব ঠিকঠাক করা আমার জন্য কিচ্ছু জটিল ব্যাপার নয়। আমি তো ইঞ্জিনীয়ার। একটা ফোঁস মন্তর ফোঁ দিলেই সব ঠিক হয়ে যায়। এর মধ্যে ধন্যবাদের তো কিছু নেই।

    

ভয়ে ভয়ে থাকি, এর পর কখন কী নিয়ে আসে ছেলেটি। অথবা, হালদার দার বাসায় ঢোকার সময় কোন দিন জালাল সাহেব বলবেন, “আদাব দাদা, ভাল আছেন? আমার টেলিভিসনটি পুরোনো হয়ে গেছে। শব্দ আসে, কিন্তু ছবি আসে না। একটু ঠিক করে দিয়ে যান, দাদা।“ আমার ভেল্কিবাজী তো আর সব সময় কাজ করবে না। একদিন না একদিন ধরা পড়বেই। তখন জালাল সাহেবের বিশ্বাস হাঁটুতে এসে ঠেকবে। বলবে, আজ ইঞ্জিনীয়ারের হলটা কি? সামান্য টেলিভিসনটা ঠিক করতে পারল না। অথবা ভাববে, দাদা বোধ হয় আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে গেছে। 

 

বছর তিনেক হয়ে গেছে। ছেলেটি আর আসেনি। ভেল্কিবাজী ধরা পড়েনি এখনও। একদিন অবাক হয়ে দেখি স্বয়ং জালাল সাহেব আমার বাসায় এসে হাজির। বিষন্ন বদন। হাতে কিছু কাগজপত্র। মুখে কথা নেই অনেকক্ষন। জিজ্ঞাসা করলাম, জালাল সাহেব, কী হয়েছে আমাকে খুলে বলুন। জালাল সাহেবের শ্যালিকার বরের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন ভাল মন্দ খাওয়াতে। আর পনের দিন টিকে কিনা সন্দেহ। বাসায় কান্নার রোল উঠেছে। সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে আমার কাছে ছুটে এসেছেন।

 

জালাল সাহেবের বয়স হয়তো ষাট হবে তখন। আমার কাছে মনে হল একটি নিরীহ অসহায় বালক নীরব ভাষায় আমার কাছে একটি জীবন ভিক্ষা করছে। আমি এই অসহায় বালকের কাছে নিরুপায় শিশু হয়ে গেলাম। আমি তাঁকে কী ভাবে শান্ত্বনা দেব!   

  

সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত লোক থাকতে আমার কাছে এসেছেন। বেতনভূক কয়েকজন ডাক্তারও আছেন। অথচ, এই বিপর্যয়ের মুহুর্তে একটু আশা, একটু ভরশার জন্য আমাকে ছাড়া আর কারো কথা মনে পড়েনি। আমার নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হলো। হাতের কাগজগুলো প্যাথোলোজিক্যাল রিপোর্ট আর ডাক্তারী প্রেস্ক্রিপ্সন। স্পস্ট করে লেখা, carcinoma – কান্সার। কতক্ষন চুপ করে থাকা যায়! আমার কাছে তখন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপটার বড়ই দরকার। বললাম, জালাল সাহেব, বাংলাদেশের ডাক্তার তো! হয়তো গুরুত্ব দিয়ে কিছু দেখেনি। কাল আপনি অন্য আর এক ডাক্তার দেখান। জালাল সাহেব চলে গেলেন। পরদিন তাইই করলেন। নতুন রিপোর্ট বেরোল। রোগটা আদৌ ক্যান্সার নয়।  

 

হায়রে বাংলাদেশের ডাক্তার! একটা জীবন্ত মানুষের হাতে মৃত্যুর সনদ ধরিয়ে দিতে দুবারও চিন্তা করলো না! জন্ম হয়েছে, মৃত্যু তো হবেই। তাই বলে একজন ডাক্তার যে কেউকে বলে দেবে, কাল তোমার মৃত্যুর দিন! ডাক্তারের মৃত্যু সনদ হাতে নিয়ে জালাল সাহেবের আত্মীয় প্রতিদিন মৃত্যু ভয় নিয়ে বেঁচে থাকবেন। তারপর, পরিনত  বয়সে একদিন শৈবলিনীর মত মরিয়া প্রমান করবেন তিনি মরেন নাই। সেই আসল মৃত্যুর পরে পত্রিকায় হয়তো প্রকাশ পাবে, “অত্যাশ্চর্য ঘটনা, বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সার রোগী চল্লিশ বছর বেঁচে গেলেন।“   

 

জালাল সাহেব তাঁর বিশ্বাসের মূল্য পেলেন। তাঁর ভায়রা পেলেন স্বাভাবিক সুস্থ জ়ীবন। আমার কোন ভূমিকা নেই এখানে। আমি শুধুই উপলক্ষ মাত্র। তবু ভাবতেই হয়, একই রক্ম ঘটনা কী ভাবে ঘটে! একই লোককে কেন্দ্র করে পর পর ঘটে যাওয়াটা অস্বাভাবিক ঘটনা গূলো আমার কাছে সত্যই অদ্ভুত বলে মনে হয়। 

  

২০০৭ সালের গ্রীষ্মকালীন অবকাশে বাংলাদেশে যাই। দীর্ঘ উনিশ বছর পরে ১৮ মে তারিখে মাত্র একদিনের জন্য বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যলয়ে অবস্থান করি। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অনেকেই মারা গেছেন। জালাল সাহেবও মারা গেছেন বয়স জনিত কারনে। আর হালদার দা মারা গেছেন হৃদ্ রোগে আক্রান্ত হয়ে। দুজনই সাচ্চা মানুষ ছিলেন। যদি কেউ আমাকে কৃষিবিশ্ববিদ্যলয়ের পাঁচজন ভাল লোকের নাম বলতে বলেন, এই দুইজনের নামই আমার প্রথম মনে পড়বে। মৃত্যুর পরে স্বর্গ নামক কোন জায়গা থাকলে সেখানে আর কারও স্থান না হলেও এই দুইজনের অবশ্যই হবে।  

 

দক্ষিন কোরিয়ায় কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ারীং এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য অধ্যয়ন্রতা শার্লীর কাছ থেকে ইমেইল এলেই ওর বাবা হালদার দার মুখখানি স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে ভেসে আসে। অত্যন্ত পরিপাটি মানুষ ছিলেন। জীবনযাপ্ন ছিল অত্যন্ত সুশৃংখল। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য হেন ব্যায়াম নেই তিনি করতেন না। উনার লোহার মত শরীরে একশ্ত বছরেও একটু খানি আচরও লাগার কথা ছিল না। এই রক্ম একটি লোক মাত্র ষাট বছর বয়সে মারা যেতে পারে ভাবাই যায় না। ভাবি, শুধু শুধু কষ্ট করে শরীরের যত্ন নিয়ে লাভ কী!

 

সময় পেলে মাঝে মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়ি। মোড়কের পরে প্রথম পাতার খালি জায়গায় লেখা,

 

বৌদি,

“নববর্ষের আগমনে আপনার জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আনন্দ বয়ে আনুক।“

শুভেচ্ছান্তে ---

ফরিদা

১ লা বৈশাখ, ১৩৯১।।

 

ফরিদা জালাল সাহেবের ছোট শ্যালিকা। আমার সহধর্মিনী, মিনুর সাথে খুবই সখ্যতা ছিল। বইটি দেখলেই ফরিদার কথা মনে পড়ে। তার চেয়েও বেশী মনে পড়ে আর একটি মুখ, আর কানের কাছে সারাক্ষন বাজতে থাকে, “আদাব দাদা, ভাল আছেন?”

 

৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৮