রেবেকা
১.
রোজ সকালে হোমটাস্কগুলো দেখে নিয়ে রেবেকা সোজা চলে যায় গোসলখানায়। স্কুলের শুরু হতে তখন আর বেশি সময় বাকী থাকেনা। ঠিক এই সময়টাতে মা তার ভাতের থালা হাতে নিয়ে বসে থাকবে খাটের কোণটাতে।
প্রতিদিনই এ মেয়েটি বলবে, ‘স্কুলের দেরী হয়ে যাবে, আজ আর খাব না মা।’
মা তখন থালা হাতে মেয়ের পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে উদগ্রীব হয়ে। মায়ের উদগ্রীব মুখখানি দেখতে এত ভালো লাগে যে, প্রতিদিন ইচ্ছে করেই রেবেকা ভাত না খাওয়ার ভান করে।
অবশ্য একটু পরেই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সে বলবে, ‘আমি খেতে পারবোনা, তুমি খাইয়ে দাও।’
তারপর মায়ের হাসিমাখা মুখ, ভাতের থালা সামনে নিয়ে আসা। তার পরের যে দৃশ্য, সেটা প্রকাশ করবার মত ভাষা পৃথিবীতে আজও সৃষ্টি হয়নি।
মা-মেয়ে, এ দুটি মানুষের সংসার। আরো ভালো করে বলতে গেলে টানাটানির সংসার। বুদ্ধি হবার পর রেবেকা সর্বপ্রথম যে কঠিন সত্যটি জেনেছে তা হলো, পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা মাকে ফেলে রেখে চলে গেছে। নতুন সংসার পেতেছে। মাঝে মাঝে বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে রেবেকার। কিন্তু সাথে সাথে আবার এও বুঝতে পারে যে সৃষ্টিকর্তা খুব বেশি রকমের জেদি একটা মেয়ে করে বানিয়েছে তাকে। তাই বাবাকে দেখবার ইচ্ছা সরে গিয়ে তার মানসপটে এখন জেগে উঠে অভিমান, তীব্র সেই অভিমান আর জেদ।
রেবেকার মা খুব বুদ্ধিমতী মহিলা নয়। কি করে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় সেটা জানা নেই ভালো করে। রেবেকা এই বয়সেও বুঝতে পারে, এ জগৎ সংসারে কত বড় বোকা তার এই নিজের মা’টি; আর কল্পনা করতে থাকে তাকে বড় করেতে কত কষ্টই না সইতে হয়েছে এই বোকা মহিলাটার। রেবেকা আজ দশম শ্রেণীর ছাত্রী। মা বোকা হলেও এইটুকু সে বুঝে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে চালাক মা’টি তার সন্তানকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, তার এই বোকা মায়ের ভালোবাসা তার থেকে এক তিল পরিমাণও কম নয়।
মা এত কষ্ট করে সংসার চালান সেটা ভেবে মায়ের জন্য খুব দুঃখ হয় রেবেকার। প্রতিদিন শুধু মেয়ের যাওয়া আসার রিক্সাভাড়াটা হাতে দিতে গিয়ে মা মুখ কালো করে রাখে। হয়তো আরো বেশি দিতে চায়, পারে না। সেটা দেখে রেবেকারও মুখ ভারী হয়ে আসে। এস, এস, সি পরীক্ষাটা শেষ হলে নিজে কিছু একটা করবে বলে ঠিক করে রেখেছে রেবেকা। যাতে অন্তত নিজের খরচটা নিজে চালাতে পারে।
মা’ই এ মেয়েটার পৃথিবী। মায়ের জন্য সব করতে পারে সে। তার বোকাসোকা মায়ের দিকে তাকিয়ে কতবার যে এই মেয়েটি নীরবে কেঁদেছে তার হিসেব নেই। প্রকৃতির নিয়মে কৈশোরের অজানা ভালোলাগা তাকেও ছুঁয়েছে। সাথের আর আট দশটা মেয়ের মত করে ক্লাসের বাবরি চুলের ছেলেটার সাথে কথা বলতে যে তারও ইচ্ছে করেনি এমনটি নয়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন মায়ের মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠে, তখন পৃথিবীর অন্য সবকিছু যেন মিথ্যা হয়ে যায়। এই মেয়েটির সমস্ত ভালোবাসাই যেন হতে পারে শুধু তার মায়ের জন্য। সেখানে আর কারো কোনো অধিকার নেই, থাকতে পারেনা।
২.
অন্য আর সব দিনের মত রেবেকার মা আজ ভাতের থালা হাতে বসে নেই। প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় ছটফট করছে। মাঝরাত্রি থেকে মায়ের শিয়রে জেগে বসে আছে রেবেকা। অনেক কিছু করে দেখেছে, কোনভাবেই মাথাব্যাথা কমছে না। সকালে মা’কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, ঔষধ কিনতে হবে। কিন্তু হাতেতো জমানো টাকা নেই। প্রতিবেশীদের কাছে হাত পাতা কোনোভাবেই সম্ভব নয় রেবেকার পক্ষে। অতএব সকালে প্রথমে যেতে হবে রামপুরা, মামার বাসায়।
এই মামাটিকে একদমই ভালো লাগেনা রেবেকার। বাসায় গেলে খুবই বাজে ব্যবহার করে। মামী নানাভাবে কায়দা করে শুনিয়ে দিবে, তার বাবা চলে যাওয়ার পিছনে তার মায়ের দোষই বেশী। মায়ের পাপের ফল ভোগ করতে হচ্ছে রেবেকাকে। মামাতো ভাই-বোন’রাও খুব একটা কথা বলেনা তার সাথে। ঐ বাসায় গেলে খুব লজ্জা করে রেবেকার। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। তবুও এই শহরে আপন বলতে এই একটি মামাই আছেন। তার কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।
ঢাকার রাস্তায় সকালে গাড়ী চলতে শুরু করবার একটু পরেই রেবেকা বেরিয়ে পড়ে। হাতে স্কুলে যাবার আসবার সেই ভাড়াটুকু আছে মাত্র। সি,এন,জি এমনকি রিক্সায় করে যাবার টাকাও সাথে নেই। বাসে প্রচন্ড ভীড় থাকবে, তারপরও বাসে চড়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্য সব দিক ভেবেচিন্তে,আস্তে আস্তে হেঁটে এসে রেবেকা দাঁড়িয়ে থাকে মৌচাকের মোড়ে। এখানটাতে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
৩.
গুলিস্তানের মোড়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা দশ নাম্বার গাড়ী আসার সাথে সাথেই হুড়মুড় করে ভেতরে উঠতে যায়। কার গায়ের উপর দিয়ে গিয়ে কে কার আগে উঠবে তার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রাণপণ চেষ্টায় সবাই যখন বিজয়ীর হাসি হেসে সীটে গিয়ে বসে, তখন দেখা যায় বাসের অর্ধেক সীটই ফাঁকা।
বিরক্তমুখে সাদা দাঁড়িওয়ালা মুরুব্বী বলে ওঠেন, ‘বাঙ্গালীর স্বভাব আর ভালো হইতো না। কাড়াকাড়ি করন ছাড়া তারা আর কিছুই করতো পারে না।’
অন্য যাত্রীরা সবাই একটু নড়েচড়ে বসেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোকটি মুখে বুদ্ধিজীবিসুলভ ভাব নিয়ে বলেন, ‘এটা বাঙ্গালীর জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ঠিক হইব না।’
আরেকজন যোগ করেন, ‘এল্লাইগাইতো দেশটার আইজ এই অবস্থা।’
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার তাদের কথা শুরু হয় কাকরাইলের মোড়ে। আধঘণ্টা ধরে গাড়ী জ্যামে আটকা পড়ে আছে। এতক্ষণ চুপ করে থাকা একজন এবার আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, ‘সামান্য জামটা ঠিক করতে পারেনা, এই সরকার দেশ ঠিক করবো ক্যামনে।’
আরেকজন বলেন, ‘খালিতো সব দোষ খালেদার আর হাসিনার। কই এখনতো তারা নাই। এখন তোরা দেশ চালা। তেলের দাম কমাইতে পারস না কেন?’
‘অই মিয়া, না বুইজ্যা কতা কন ক্যান? তেলের দাম কি হেগো হাতে নি?’ পিছনের জন দূর থেকে যোগ করলো।
এর পর আবার গাড়ী চলতে শুরু করলে সবার কথা একটু থামে। প্রচণ্ড ভীড়। দাঁড়ানোর জায়গাও নেই বললেই চলে। মৌচাকের মোড়ে আসতে দেখা গেল গাড়ী থেকে নামবে তিনজন। উঠবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে চারজন। তিনজন পুরুষের সাথে অনেক কষ্টে মেয়েটিও উঠে দাঁড়ালো গাড়ীতে।
প্রথমেই একজন বলে ফেলে, ‘এই কন্টেক্টার, তুই দ্যাখস না গাড়ীত জায়গা নাই, তুই মাইয়্যা মানুষ উঠাইবার গেলি ক্যান?’
কন্ডাক্টর বলে, ‘আমি উঠাইছি নি, হেয়তো উঠলো।’
আরেকজন বলে, ‘হেইবা ক্যামন মাইয়্যা মানুষ, দ্যাখতাছে গাড়ীত জায়গা নাই, তাও ঠেইল্যা উইঠা গেল।’
তারপর শুরু হয় একেরপর এক, কেউ জোরে, কেউ ফিসফিস করে।
‘মাইয়্যামানুষ কি আর দেশে মাইয়্যামানুষ আছে।’
‘দ্যাশে কি এমনি এমনি গজব নাইম্যা আসে।’
এইসব কথা সহ্য করবার মত দৃঢ়তা নিয়ে রেবেকা বড় হয়ে উঠেনি। তার দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা।
এবার মুরুব্বী বলেন, ‘ব্যাডা মাইনসের চিপার ভেতর না ঢুকলেতো হ্যাগো শান্তি অয়না।’
এবার হেসে উঠে সবাই।কেউ মুচকি হাসে, কেউ জোরে হাসে।
প্রচণ্ড লজ্জায় রেবেকার ইচ্ছে করে মাটির সাথে মিশে যেতে। ইচ্ছে করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে। ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে নিজের সমস্ত শরীর।নিজের চারপাশটা নোংরা মনে হতে থাকে। ঘেন্না ধরে যায়। সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা।
সামনে রেলক্রসিং। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়ী। আস্তে আস্তে গাড়ী থেকে নেমে পড়ে রেবেকা।রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় রেল লাইনের ঠিক মাঝখানটাতে। ট্রেন আসতে থাকে। ট্রেনের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে রেবেকার কান্না। কাছে চলে আসে ট্রেন। হুইসল এর পর হুইসল বাজতে থাকে। এক দৃষ্টিতে রেবেকা সেদিকে তাকিয়ে থাকে নির্জীব, অসাড় হয়ে। চারপাশের কোন শব্দই তার কানে আসে না। ঠিক তখনি কোথা থেকে যেন চোখের সামনে ভেসে উঠে মায়ের মুখখানি। তার বোকা মা ভাতের থালা নিয়ে তার পিছন পিছন আসছে। ... মায়ের কথা ভেবে সেদিন কি বাঁচতে পেরেছিল রেবেকা?
জুলাই ২১, ২০০৮