আমাদের আই,টি সেক্টরঃ স্বপ্ন দেখবো বলে আজ দু'হাত পেতেছি
কোন এক ছুটির দিনে রেডিসন কিংবা শেরাটনের মত ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে যদি উপস্থিত হয়ে থাকেন, তাহলে কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটু অবাকই হয়ে যাবেন। দেখতে পারেন একদল উজ্জ্বল মুখের কম বয়সী তরুণ-তরুণী কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ভীড় করছে? আপনার অবাক হবার পালা কিন্তু এখানেই শেষ নয়; একটু পরে পরিচয় পাবার পরইতো প্রকৃত অবাক হবার সময়। শুধু তাই নয়, এই হতদরিদ্র দেশটাতে এখনও যে গর্ব করার মত কিছু জিনিস এখনো যে অবশিষ্ট আছে সেটা আপনি টের পাবেন সেখানে বসেই। সোজা বাংলায় বলতে গেলে এরা সবাই কারিগর; দেশ গড়ার কারিগর। কেউ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কোয়ালিটি এসিওরেন্স ইঞ্জিনিয়ার; টোটাল একটা শব্দ দিয়ে বললে বলতে হবে সবাই আই,টি প্রফেশনাল। এরা এসেছে ইন্টারভিউ দিতে।
তার আগে একটু বলে রাখা যাক। আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা বাংলার, যেই সেই নয় একেবারে সোনার বাংলার। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সেই যে তারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর জেগে ওঠা হয়নি। তাই বলে সবাইকে ঘুমিয়ে থাকলেতো আর চলে না। নীরবে একটা বিপ্লব ঠিকই হয়ে গেছে এদেশে। কেউ দেখেনি, কেউ শোনেনি, কেউ বলেনি, কেউ জানেনি। ‘তোমাদের খুঁজছে বাংলাদেশ’ বলে চ্যানেলে চ্যানেলে সেই বিপ্লবীদের মুখগুলোও দেখানো হয়নি। নামকরা পত্রিকার বিনোদন পাতায় কোনদিন বড় করে তাদের ছবিও ছাপা হয়নি। কিন্তু এ এমন এক এক জিনিস যার প্রকাশের জন্য সম্ভবত পত্রিকার পাতা দরকার হয়না, দরকার হয়না চ্যানেলের, দরকার হয়না মিডিয়ার। মানুষের মেধা; নিজস্ব মহিমায় প্রোজ্জ্বল হয়ে মেধা ফুটে উঠবেই; হয়তো আজ নয়তো আগামীকাল- এতটুকুই তফাৎ।
পিছন ফিরে একটু মনে করবেন কি আমাদের ইতিহাস। একদিন কিসের তরে বিদেশী বেনিয়ার দল ছুটে এসেছিল আমার আপনার মাতৃভূমিতে? কিসের লোভে? স্বার্থ, সম্পদ আর ঐশ্বর্যের লোভে নয় কি? এসেছে আর নিয়ে গেছে লুণ্ঠন করে। সহায় সম্ভ্রমহীন করে রেখে গেছে আমার আপনার জননী জন্মভূমিকে। মিষ্টি হাসির মুখোশ লাগিয়ে আজও তারা আসে। শুধু পরিবর্তন করে রূপ। রঙ্গিন জীবনের স্বপ্ন দেখাতে আজ তারা আসে মেধার খোঁজে, মেধার লোভে। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরাও কি শিক্ষা গ্রহণ করিনি? আমরাও কি নিজেদের প্রস্তুত করনি যুগের সাথে? দিন যে বদলে গেছে, সেই দিন যে আর নেই। আমরাও যে যোগ-বিয়োগ করতে শিখেছি। বিদেশীদের কাজ আমরা করব কিন্তু আগে আমাকে হিসাব করতে হবে তাতে আমার দেশের কি লাভ হচ্ছে, কতটুকু লাভ হচ্ছে। কোন উপায়ে রক্ষা পাবে আমার দেশের এতটুকু পরিমাণ স্বার্থ। এর সবগুলোই নতুন প্রজন্মের এই সব তরুণ-তরুণীদের মুখের কথা, মনের কথা। কি অনিন্দ্য যুক্তি আর অপরিসীম দরদ দিয়ে বাংলার এই নতুন প্রজন্ম কথা বলে, কি স্বচ্ছ তাদের চিন্তা ভাবনা, কি অপূর্ব তাদের দেশপ্রেম - শুনলে এক অপার আনন্দে আপনার প্রাণটাই ভরে যাবে।
আমি সৌভাগ্যবান যে তাদের সাথে কথা বলার বা মিশবার সুযোগ আমার হয়েছিলো। তারা বলতে থাকে, আমি শুনি। কেরোসিনের নিভু নিভু প্রদীপের নীচে বসে, শীতের রাতে কেঁপে কেঁপে, আমরাই কি বই নিয়ে বসে থাকিনি? বর্ষায় হাঁটুজলে ডুবে কি যায়নি আমাদেরই স্কুলঘর ? কাগজের অভাবে আমরাই কি একই পৃষ্ঠায় পেন্সিল, তার উপরে কালো কালি, তারও পরে লাল কালি দিয়ে লিখিনি? দরিদ্র দেশ, দরিদ্র পরিবার, দরিদ্র স্কুল, দরিদ্র কলেজ, দরিদ্র বিশ্ববিদ্যালয়, দরিদ্র সরকার। কিন্তু তারপরও কি আমরা টিকে থাকিনি? বিশ্বের কাছে আমরাই কি প্রমাণ করিনি নিজেদের? প্রমাণ করেছি, টিকে থেকেছি; কারণ মেধার দিক থেকে আমরাতো দরিদ্র নয়, আমরাতো নিঃস্ব নয়। কিন্তু এত কষ্টে টিকে থেকেছি কি স্টেটস্ অব আমেরিকাকে সার্ভিস দেয়ার জন্য? ইউনাইটেড কিংডম আর কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য? মোটেই নয়, কখনোই নয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কিংবা শেখবার জন্য জানবার জন্য সেখানে আমাদের যেতে হয় বা যেতে হবে। কিন্তু পিছনে যে আমাদের পিছুটান। আমাদেরই সহপাঠী, যে আমাদের সাথেই হয়তো উঠে আসার কথা ছিলো, এই পৃথিবীতে তারও অধিকার ছিল নিউটনের তৃতীয় সূত্র জানবার। কিন্তু তারা আসতে পারেনি, তাদের যে পিছনে রেখে এসেছি। আমাদের শোলক বলা কাজলা দিদি, আমাদের রসুলপুরের আসমানী, পদ্মা নদীর কুবের তাদের কথা কে ভাববে? আমাদেরই কি ভাবতে হবেনা? অতএব যেখানেই যাইনা কেন, যেখানেই থাকিনা কেন, যাই করি না কেন, আমি কি করে ভুলে থাকব আমার মাতৃভূমির কথা, জন্মভূমির কথা? কি করে আমি জলাঞ্জলি দিব জন্মভূমির স্বার্থের?-এসব আমার কথা নয়। যে তরুণ-তরুণীদের নিয়ে লিখছি তাদের কথা, তাদের কথার মর্মার্থ।
প্রচুর সংখ্যক বিদেশি সফটওয়্যার ফার্ম এখন বাংলাদেশে তাদের ডেভেলপ্মেন্ট সেন্টার খুলেছে। কনাডা, ইউএসএ, জাপান, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ইউকে এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের অনেক দেশের একাধিক ফার্ম এখন বাংলাদেশে। তাদেরই কোন একটির রিক্রুটমেন্ট উপলক্ষে এই মেধাবী তরুণ-তরুণীদের ইন্টারভিউ দিতে আসা। এখানে নতুন করে প্রবেশ করতে চাইছে আরো অনেক বিদেশি ফার্ম। আপনাকে দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবেনা, সেট হতে হবেনা, সংসার করতে হবেনা। ইন্টারনেটের কল্যাণে ঘরে বসেই সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করা যায়। খুব সহজেই আসতে পারে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা। বিশ্বখ্যাত নামীদামী সব প্রতিষ্ঠানের কাজ এখন হরহামেশাই হচ্ছে বাংলাদেশে। মাইক্রোসফট, আইবিএম'র কাজতো দুধ-ভাত। এমন অনেক কাজও এখানে হচ্ছে যেটা অন্য দেশ পারবেনা বলে নিতে চায়নি। কিন্তু আমরাতো দূর্যোগের দেশের মানুষ। প্রকৃতিই হয়তো আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে শেখায়। তাই আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। নীরবে তারা কাজ করে, নীরবেই তারা মোকাবেলা করে চ্যালেঞ্জ। সুনামের সাথে কাজ করে যায়, নিজেদের জন্য, নিজের দেশের জন্য। পত্রিকার পাতায় সে খবর আসেনা, চ্যানেলগুলো সে খবর রাখেনা।
বাংলাদেশে সফটয়্যার ফার্মগুলোতে এই মুহূর্তে স্টার্টিং স্যালারী সাধারণত পনের থেকে ত্রিশ হাজার টাকার ঘরে। নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে দুই বছরের মাথায় ফিফটি এবং পাঁচ বছরে লাখ এর আশপাশে। কিন্তু কারা কাজ করছে এই সমস্ত জায়গাগুলোতে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও প্রচুর সংখ্যক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট কাজ করে যাচ্ছে যথেষ্ট সুনামের সাথে। বিভিন্ন ইন্সটিটিউট, এমনকি পাশের দেশ ইন্ডিয়া থেকে পড়াশোনা করে আসা প্রফেশনালরাও রয়েছেন। কিছুদিন আগেও যেখানে পশ্চিমা দেশ থেকে পড়াশোনা করে এসে সবার প্রথম পছন্দ থাকোতো শিক্ষকতা, এখন সেটা পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুততার সাথে। কারণ নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। ফার্মগুলোতে এখন কাজ করছে বাইরের ডিগ্রিধারী এ দেশেরই মেধাবী তরুণ-তরুণীরা। তারা তাদের শিখে আসা জিনিস কাজে লাগাতে পারছেন, প্রয়োগ করতে পারছেন। এই ফার্মগুলো চমৎকারভাবে সেই সুযোগটি করে দিয়েছে।
কিন্তু যে কারণে এ লেখা। আমাদের দেশের প্রচুর সংখ্যক লোকজন দেশের বাইরে খুব ভালো অবস্থানে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। আছে নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও। বিশ্বখ্যাত কোম্পানীগুলোতে রয়েছে আমাদেরই লোকজন। বিশ্বে এখন আর এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যাদের আই,টি বিভাগ নেই বা থাকবেনা। একটু নজর দিলে বা চেষ্টা করলে হয়তো সম্ভব হবে তাদের সেই কাজগুলো আমাদের নিজের দেশে পাঠানো। একক ভাবে না হলে সম্মিলিতভাবে বা সাংগঠনিক উদ্যেগের মাধ্যমে হলেও সম্ভব। সম্ভব না হলেও অন্তত চেষ্টাটুকু করা সম্ভব। বাংলাদেশে আই,টি প্রফেশনালদের খুবই সক্রিয় একটি গ্রুপ এড্রেস হচ্ছে- [email protected]। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সি,এস,ই বিভাগের গ্রুপ এড্রেস-cse-udhaka@yahoogroups.com। বুয়েটের সি,এস,ই বিভাগের গ্রুপ এড্রেস-csebuet@yahoogroups.com। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ক্লাবের গ্রুপ এড্রেস-nsucc@yahoogroups.com । তাছাড়া অন্য সব বি,আই,টি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের এড্রেসও খুব সহজে নেট থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশান এ-সমস্ত গ্রুপগুলোতে দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। আর আমার দেখা থেকে আমি শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আমাদের ছেলেমেয়েদের মেধা বা যোগ্যতা কোন অংশে কারো থেকে কম নয়। তারা পারবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে। এখন আমাদের প্রয়োজন সবাই মিলে এই খাতটির দিকে নজর দেয়া। এরকমতো বহু শুনি ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে এটা সেটা কত কি? এরকম একটা দিন কি আসতে পারেনা যখন কাউকে বলতে শুনবো এদেশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে সফটওয়্যার ফার্ম। যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে যাবে নিশ্চিতভাবে।
সোনার বাংলার স্বপ্ন আমরা আজও দেখি। তবে আমাদের সেই স্বপ্ন উচ্চাভিলাসীতো নয়। আমরাতো লেক্সাস, লিমুজিনের স্বপ্ন দেখিনা। ঝাড়বাতি আর লন্ঠনের আলোয় উদ্ভাসিত ড্রয়িংরুম কিংবা ইরান দেশের কার্পেটে মোড়ানো বাগানবাড়িতে শুয়ে মত্ত থাকার স্বপ্নওতো আমরা দেখিনা। আমাদের সোনার বাংলার স্বপ্নতো খুবই সাধারণ, খুবই সরল। 'এদেশের পনের কোটি মানুষ দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পারবে'-এক লাইনের এই একটিইতো স্বপ্ন আমাদের। আস্তে আস্তে কিন্তু আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। কি, সেই পথে আপনি কি থাকবেন না আমাদের সাথে? সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশীদার হয়ে?
June 16, 2008