নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (১)

পরশপাথর

 

ডগ এর বাচ্চারা! হ্যান্ড্‌ দিয়ে পিটিয়ে তোদের হ্যাড্‌ ভেঙ্গে দেব আত্মতৃপ্তি আর অহমিকার এক আরামপ্রদ ভাব মুখে ফুটিয়ে, ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলে গেলেন সহজাত ভঙ্গিমায়।আশপাশের বাড়ীর উৎসুক মহিলা আর তাদের সঙ্গে আসা বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো তিনি বলে গেলেন বরাবরের মত করে। কুটকুট করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায় বাচ্চাগুলো, এমন অদ্ভূত করে তাদের আর কেউ কখনো বকাঝকা করেনি। লন্ডনফেরত ভদ্রমহিলার অনর্গল ইংলিশ বলার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে মায়েরা ভেবে নেয়, ঠিক কেমন করে তারা বাড়ী ফিরে এমন মনোহর ঘটনার ধারাবর্ণনা করবে। 

বিদেশ ফেরত এরকম প্রচুর সংখ্যক জনগোষ্ঠী নোয়াখালী এলাকার কৃষ্টি কালচারকে প্রভাবিত করছেন ব্যাপকভাবে। এখানে প্রতিবাড়ীতে গড়ে কমপক্ষে দুজন করে লোক পাওয়া যাবে, যারা প্রবাসে অবস্থান তথা বসবাস করছেন। প্রতি দশ কিলোমিটারে অন্তত একটা করে বাড়ী পাওয়া যাবে, যার নাম জাপানী বাড়ী কিংবা লন্ডনী বাড়ী। প্রতিটি বাজারে অন্তত একটা করে হলেও কানাডা সুপার মার্কেট থাকবে। বেশিরভাগ মানুষই থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। তবে নর্থ আমেরিকা কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতেও কম থাকেন না। একজন আমেরিকান এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু নিউইয়র্ক সিটিতেই কোম্পানীগঞ্জের সদস্য আছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশী। অবশ্য এর মধ্যে নারী এবং শিশুরাও রয়েছেন। ভালো কথা, আমি যেখানটার কথা লিখছি সেটা কোম্পানীগঞ্জ থানার মূল আবস্থান বসুরহাট থেকে আট দশ কিলোমিটার দূরের একটি জায়গা । কোম্পানীগঞ্জ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সচিব উৎপাদন কারখানা হিসেবে পরিচিত বেগমগঞ্জ এর পাশের থানা। চিনতে সমস্যা হলে এখানকার লোকজন বলে থাকেন মওদুদ সাহেবের এরিয়া কিংবা ওবায়দুল কাদের সাহেবের এরিয়া। তারপরও না চিনলে কি বলেন সেটা আমার ঠিক জানা নেই। 

ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার আশীর্বাদে এক শক্তিশালী অর্থনীতির উপর ভর করে এগিয়ে চলছে এখানকার জীবনধারা। মানুষগুলোকে খুব আয়েশি বলে মনে হতে পারে। আবাদী জমিগুলো খালি পড়ে থাকে বছরের অনেক সময়। কোথাও হয়তো দেখবেন রিকশাওয়ালারা পায়ের উপর পা তুলে রাজনীতির আলাপ করছে, শেখমুজিব কোন কোন জায়গায় ভুল করেছিলো তার একটা লিস্ট তৈরি করার গুরুদায়িত্ব তারা পালন করে যাচ্ছে নিজ থেকে, তখন যত টাকাই আপনি দেন না কেন তারা আপনাকে রিক্সায় নিয়ে যাবেনা। কোথাওবা দেখবেন চায়ের দোকানদার খাতা কলম নিয়ে টাকা তুলে যাচ্ছেন ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের জন্য, যে দল জিতবে রাতে তার সমর্থকরা উৎসব করবে। কিছুটা আমুদে স্বভাবের লোকজন; স্যাটেলাইটের কল্যাণে আরো নিত্যনতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয় কি করে? মূলতঃ যৌথ পরিবারগুলোতে অন্যবস্ত্রের জোগাড় হয় পরিবারের প্রবাসী সদস্যদের পাঠানো টাকায়, সে টাকাতেই পূরণ হয় মৌলিক যৌগিক যত চাহিদাগুলো । 

পাহাড় নদীর অপূর্ব সমাবেশ এখানে নেই, তবু আছে বৈচিত্র্য। পৃথিবীর সব জনপদেই  থাকে কিছু না কিছু স্বাতন্ত্র্য, কিছু না কিছু স্বকীয়তা। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উল্ল্যেখ করার মত বৈচিত্র্য এখানকার মানুষগুলোতেও। বারো রকম নয় যেন বারশ রকমের মানুষ এখানে মিলেমিশে এক হয়ে আছে। মিনি স্কার্ট পরা কলেজ গার্ল এর সাথে আপাদমস্তক বোরখা পরিহিতা বান্ধবী, জিন্স-টিশার্ট আর সানগ্লাস পরা বন্ধুর সাথে টুপি-পাঞ্জাবীওয়ালা বন্ধু দেখবেন হরহামেশাই। তারা যখন জেলার বাইরে আসে তখনও এটি বজায় থাকে সমানভাবে, সমানতালে। কারন তাদের সবচেয়ে বড় মিল বা পরিচয় তাদের জন্মভূমি, তারা যে একই এলাকার। সন্মান করার মত এক পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক। 

কোন জনপদ সম্পর্কে জানার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে, সেই জনপদের কেরসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে চলা কোন এক চায়ের দোকান। সেখানটায় নিভৃতে এককোনে বসে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো। একেবারে নির্ভেজালভাবে আপনি বুঝে যাবেন সেখানকার বর্তমান চালচিত্র, কিংবা সাধারণ মানুষের ভাবনা চিন্তাগুলো। আজ থেকে কিছুবছর বা দশক পরে, বাংলায় যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে বেশী মিস্‌ করবো সেটা হচ্ছে, বিদ্যুতের আলোবিহীন কেরসিন বাতিতে চলতে থাকা গ্রামবাংলার এক পুরনো বাজার। অতএব মিস্‌ করার আগেই স্বভাবসুলভভাবে আমি উপস্থিত হয়ে যাই আমার অভীষ্ট জায়গায়।এবার সেখানটার কিছু বর্ণনা দেয়া যেতে পারে। 

আমি যেখানে বসে আছি তার পাশেই যুবক শ্রেণীর এক লোক ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে,  সাদ্দাম হোসেনকে মারার পিছনে কি করে মনমোহন সিং সুস্পষ্ট হাত হাত ছিল এবং সেটা যে মুসলমানদের প্রতি চলমান ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশবিশেষ সেটা প্রমাণ করে করে দিলো একেবারে জলের মত পরিষ্কার করে। এতো আত্মবিশ্বাস আর জোর দিয়ে সে কথাগুলো বলা যে আমিও এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে মনমোহন সিং ই ছিলো সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর আসল কারণ। 

তার ঠিক পাশেই আপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা বলে যাচ্ছে, কী কী কারণে পূর্ণিমা এবং শাবনূরের কাউকেই বিয়ে না করে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসের এক কমবয়সী মেয়েকে রিয়াজ বিয়ে করে ফেলল। এতে করে যে রিয়াজের কতটুকু পরিমাণ লাভ হল তার একটা হিসাব কষে তারা আবারো প্রমাণ করে দিলো রিয়াজ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে চাল্লু নায়ক। অবশ্য এর আগে তারা সেটা কীভাবে প্রমাণ করেছে সেটা জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। 

এরপর আমি কথা বলছিলাম একজন স্থানীয় বি,এন,পিপন্থী রাজনৈতিক নেতার সাথে। কথাপ্রসঙ্গে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্থানীয় বি,এন,পি দলীয় সাংসদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের দলত্যাগ এবং প্রায় সব সরকারের আমলে মন্ত্রী থাকা নিয়ে। উল্লেখ্য, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের দলত্যাগ প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়ায় (জানুয়ারী ২৬, ২০০৮) লেখা আছে,

 

” Moudud is blamed for changing his alliance to any party who is in government and is known as "Digbaji Moudud", which in English loosely means "Mr. Flip Flop Moudud". He has served in every government since Bangladesh's independence excepting 1996-2001 Awami League regimes.” 

ভদ্রলোক একটা ভাব নিয়ে কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা গণতন্ত্রের অর্থটা কী আমাকে একটু বুঝান দেখি।  তারপর নিজ থেকেই বললেন, ভালো হোক আরা মন্দ হোক আপনি যদি এক দলেই থাকবেন  তাহলে সেটা গণতন্ত্র হল কি করে? সেটাতো একদলীয়তন্ত্র হয়ে গেলো। আপনি যদি দলের মধ্যে অন্যায় দেখেন, অবিচার দেখেন তাহলেও কি আপনি সেখানে থাকবেন? মওদুদ সাহেব দল পরিবর্তন না করলে, তার মত একজন যোগ্যজনের সার্ভিস থেকে দেশ বঞ্চিত হত। দল পরিবর্তন করে উনি দেশসেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তার জন্য তাকে নোবেল প্রাইজ দেয়া উচিৎ। অবিলম্বে গণতন্ত্রে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করে সেটা সবার আগে কাকে দেয়া ঊচিৎ সে ব্যাপারে একমত পোষণ করে সেদিনের মত উঠে পড়লাম।

                                             …

[email protected]

January 26, 2008