নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (পরিশিষ্ট) (১০)
পরশপাথর
*** বিভিন্ন পর্বে যে সমস্ত লাইনগুলি আমি বাদ দিয়েছি সেগুলি তুলে দিলাম। বাদ দেওয়া অংশগুলি ইটালিক ফন্ট করে দেয়া হল। অন্যদিকে, এই সিরিজ লেখার সময় বিভিন্ন সময়ে যারা ফোরামে এবং মেইল করে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তাদের সবার প্রতি রইল আমার কৃতজ্ঞতা। সবাই ভালো থাকুন আর ভালো থাকুক আমার শব্দগুলি, অন্তর্জালের মহাসমুদ্রে আজ থেকে যারা সম্পূর্ণ একা।
১ম পর্বঃ (২য় প্যারা)
বিদেশ ফেরত এরকম প্রচুর সংখ্যক জনগোষ্ঠী নোয়াখালী এলাকার কৃষ্টি কালচারকে প্রভাবিত করছেন ব্যাপকভাবে। এখানে প্রতিবাড়ীতে গড়ে কমপক্ষে দুজন করে লোক পাওয়া যাবে, যারা প্রবাসে অবস্থান তথা বসবাস করছেন। প্রতি দশ কিলোমিটারে অন্তত একটা করে বাড়ী পাওয়া যাবে, যার নাম জাপানী বাড়ী কিংবা লন্ডনী বাড়ী। প্রতিটি বাজারে অন্তত একটা করে হলেও কানাডা সুপার মার্কেট থাকবে। বেশিরভাগ মানুষই থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। তবে নর্থ আমেরিকা কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতেও কম থাকেন না। একজন আমেরিকান এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু নিউইয়র্ক সিটিতেই কোম্পানীগঞ্জের সদস্য আছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশী। অবশ্য এর মধ্যে নারী এবং শিশুরাও রয়েছেন। কিন্তু সবকিছুকে পিছনে ফেলে জাপান এগিয়ে গেছে আরেকটা কারণে। আমি এখানে এসে একজন শিক্ষক পেয়েছি যিনি পুরো এলাকায় সবার কাছে পরিচিত ‘জাপানী স্যার’ নামে। নামকরণের কথাই যখন আসলো তখন আরো একটু বলে ফেলি। এখানে বাবারা তাদের সন্তানের নাম রাখেন চেয়ারম্যান, কেউ রাখেন এমএসসি, কেউ রাখেন ডাক্তার এবং কোনধরণের ডিগ্রি ছাড়াই তারা দিব্যি সেই টাইটেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এখানকার লোকজন শব্দ নিয়ে যেন কিছুটা হেয়ালিই করে। শুধু বাংলা নয় ইংলিশ বহু শব্দের আছে নোয়াখালী সংস্করণ। এইরকম একটি শব্দ হচ্ছে ‘চিটিং’(cheating)। কেউ যখন চিট্ করে তখন তারা তাকে ‘চিটার’ বলেনা; তারা বলে ‘চিটিং’। এখানেই শেষ নয় চিটিং শব্দকে সবাই উচ্চারণ করে ‘সিটিং’ বলে। তারা বলে ‘আপনি একটা সিটিং’।আর এখানে এসে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এমন একজন মাস্টারকে যিনি কোথাও শিক্ষকতা করেন বলে জানতে পারিনি, কিন্তু পুরো এলাকায় পরিচিত ‘সিটিং মাস্টার’ হিসেবে। যিনি সিটিং তিনিই মাস্টার, সিটিং মাস্টার। এই ধরণের বহু অদ্ভুত উপনাম আর উপাধির ছড়াছড়ি এখানে। ভালো কথা, আমি যেখানটার কথা লিখছি সেটা কোম্পানীগঞ্জ থানার মূল আবস্থান বসুরহাট থেকে আট দশ কিলোমিটার দূরের একটি জায়গা । কোম্পানীগঞ্জ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সচিব উৎপাদন কারখানা হিসেবে পরিচিত বেগমগঞ্জ এর পাশের থানা। চিনতে সমস্যা হলে এখানকার লোকজন বলে থাকেন মওদুদ সাহেবের এরিয়া কিংবা ওবায়দুল কাদের সাহেবের এরিয়া। তারপরও না চিনলে কি বলেন সেটা আমার ঠিক জানা নেই।
বাদ দেয়ার কারণঃ এই উপাধি বা উপনামে যাদের ডাকা হচ্ছে তারা ব্যক্তিগতভাবে নামগুলো পছন্দ করেন না বিধায় অংশটি বাদ দিয়েছিলাম।
৫ম পর্বঃ (৫ম প্যারা)
বেশকিছুদিন এভাবে চলতে থাকার পর এবং সাথে সাথে ডাক্তারী ঔষধ সেবনের পরও কোনওরকমের কুলকিনারা হচ্ছিলো না। উল্লেখ্য, ইমাম সাহেব এবং মক্তব-মাদ্রাসার হুজুররা আগেই ব্যর্থ হয়েছেন এবং সমাধান স্বরূপ তারা বলে দিয়েছে এ এক সাংঘাতিক জ্বীন, নিজে না ছেড়ে গেলে আমাদের সাধ্য নেই। অন্যদিকে, এসময় মেয়েটির উপর জ্বীন ভর করে থাকলেও ঠিক কথা বলেনা। কিন্তু সারারাত জুড়ে মেয়েটি ঘুমোতে পারেনা। শুধু কাতর স্বরে আর্তনাদ করতে থাকে। বড় দুঃসহ সেই যন্ত্রণা। বাবা মায়ের জন্য, পরিবারের জন্য এক কষ্টকর অভিজ্ঞতা। সবচাইতে বিব্রতকর আর বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন প্রেমিক জ্বীনপুরুষ মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কি ভয়ানক আর দুর্বিষহ সেই অভিজ্ঞতা, কি-বোর্ডের অক্ষরে সেটাকে আর বিবৃত করে নিজেও কষ্ট পেতে চাইনা। কিন্তু একসময় সমাধান হয়েছিলো ঠিকই। এবার সেই সমাধানের গল্পটা একটু বলি।
বাদ দেয়ার কারণঃ কেন জানি বাদ দিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই।
৬ষ্ঠ পর্বঃ(১ম প্যারা)
‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি আমি নো’খালীর পথে/বঙ্গোপ সমুদ্র থেকে নিশিথের অন্ধকারে মেঘনা সাগরে।’ অতএব, বনলতা সেনদের দেখা যে আমি পাব তা আর নতুন ক’রে বলার কি? কিন্তু বনলতা সেন পেলে কি হবে, দু’দণ্ড শান্তি আর আমার পাওয়া হয়নি। তারা ‘পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে’ যেই না এক দণ্ড শান্তির অবতারণা করে অমনি আবার মুখ দিয়ে ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ বলতে গিয়ে সর্বনাশেরও গোড়াপত্তন করে। অনিন্দ্য সুন্দর এক রুপসীর চুলের দিকে চেয়ে আপনি যখন ভাবছেন চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, ঠিক তখনি রুপসী যদি তার ছোটভাইকে বলে, "খোকন খোকন ওদিকে যেওনা, ওদিকে গেলে তোমাকে হিম্বায় কামবায় দিব (পিঁপড়া কামড়ে দেবে)", সেক্ষেত্রে আপনি একটু দিশাহারা বোধ করতেই পারেন। তবে তাদের সেই বিচিত্র উচ্চারণের বৈচিত্র নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু একটু কারণ খুঁজতে চেষ্টা করেছি, আর সেই সঙ্গে অবাক হয়ে দেখেছি কি চমৎকারভাবে সেই স্থানীয় ভাষা দিয়ে তৈরী হয়ে গিয়েছে লোকসাহিত্য।
বাদ দেয়ার কারণঃ বাস্তবে বহুজনের দেখা আমি পেয়েছি যারা খুব চমৎকার বাচনভঙ্গিতে সুন্দর করে কথা বলেন। ঢালাওভাবে সবাইকে এক কাতারে ফেলে দিলে তাদের প্রতি অবিচার করা হয়।
৬ষ্ঠ পর্বঃ(৭ম প্যারা)
তবে শ্লোকের ব্যাপার বাদ দিয়েও যে আরেকটা জিনিস আছে, সেটা একটু বলতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ ভয়ঙ্কর সুন্দরের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সুন্দরের আরো একটা প্রকারভেদ মনে হয় আছে। অশ্লীল সুন্দর। কি বুদ্ধিদীপ্ত আর বিজ্ঞানসন্মত সেই অশ্লীলতা! দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে মেডিকেল সায়েন্সের 'গাইনিকলাজি' বিষয়ের সমস্ত প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস করিয়ে দেবে। মানব সন্তান জন্মাবার যে এতগুলো হতচ্ছাড়া উপায় থাকতে পারে সেটা আমার আদৌ জানা ছিলনা। ভাষায় প্রকাশ করে তার রেশটুকু নষ্ট করার মানে হয়না।
বাদ দেয়ার কারণঃ কেন জানি মনে হচ্ছিলো, সপ্তম শ্রেণীর একজন ছাত্র যদি এই লেখাটা পড়ে তাহলে সে লাইনগুলোর কি ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে? কিছুটা কি বিব্রত বোধ করবে না? সেটা ভেবেই বাদ দেয়া।
৮ম পর্বঃ(শেষ প্যারা)
মূলরূপঃ
আড্ডা আর কাকে বলে? নতুন লোক পেয়ে হয়তো তাদের উৎসাহ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। দেশ-বিদেশ, ক্রিকেট-ফুটবল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এর বাসভবন, ঐশ্বরিয়া রায়ের শাড়ী, আটলান্টিক মহাদেশের তলদেশ কোনকিছুই বাদ যায়না তাদের আড্ডা বিষয়বস্তু থেকে। তবে কিছু বাদ যাক আর না যাক একটা গল্প কিন্তু প্রতিদিনই অবধারিতভাবে থাকে বিষয়বস্তু হিসেবে। সেই রূপসীর গল্প। প্রতিদিনই তারা করে এই গল্প। কোন কোন লুটেরার দল এই রূপসীর রূপ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, কারা তার শ্লীলতাহানি করতে চাইছে, তারা সেটা বুঝতে পারে, বুঝতে পারে একেবারে নিখুঁতভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের থেকে এক তিল পরিমাণও কম বুঝেনা তারা। অন্তরের গভীরতম জায়গা থেকে বর্ষিত হতে থাকে তাদের ঘৃণা। হয়তো তখন সেই লুটেরা স্বার্থপরের দল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আয়েশের ঘুমে আচ্ছন্ন, এই নিন্দা আর ঘৃণার ছিঁটেফোঁটাও তাদের গায়ে গিয়ে লাগেনা। তাতে কি? তবুও এখানকার এই মানুষগুলো ঘৃণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে তাদের মর্মবেদনা আর সাথে সাথে স্বপ্ন দেখে নতুন কোনো দিনের। যে-দিন এই রূপসী আর স্বার্থবাজদের নোংরা, কুৎসিত আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবেনা, হারাতে থাকবেনা তার সম্ভ্রম। তারা খুঁজে ফেরে রাজপুরুষ। স্বপ্ন দেখে, একদিন নিশ্চয় আসবে কোনো রাজপুরুষ। হিসেব করতে থাকে, কোন সে রাজপুরুষ যে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসবে তাদের এই রূপসী বঙ্গমাতাকে। তাদের অনেক স্বপ্নের, অনেক ভালোবাসার এই দেশটাকে।
পরিবর্তিত রূপঃ
এ পর্যায়ে এসে আমাকে থামতেই হচ্ছে এবং সাথে সাথে উঠতে হচ্ছে চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে। বড় হিংসে হয় এ মানুষগুলোকে দেখে। কি সুখেই না তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবনের অলিগলিতে, হয়তো নেই কোনো আগামীর চিন্তা। তাদের জীবনে বিশ্বাস আছে বিজ্ঞান নেই, তথ্য আছে সূত্র নেই, বর্তমান আছে ভবিষ্যত নেই। কেউ তাদেরকে হয়তো মুখস্ত করিয়ে দেয়নি ‘ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ’। তাই তারা ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেনি, তারা জ্ঞানী হয়ে উঠেনি,বর্তমান দিয়েই হয়ে উঠেছে সুখী। আড্ডা দেবার তীব্র আকঙ্খাকে পিছনে ফেলে আমাদের উঠে যেতে হয় চায়ের দোকান ছেড়ে। ফিরে যেতে হয় হিসেব করা জীবনে। সোনালী এক ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হ’য়ে আমরা এগিয়ে যাই, আমরা উপরে যাই। আর এভাবেই হয়তো হতে থাকবে আমাদের ‘ঊর্ধ্বপতন’।
পরিবর্তনের কারণঃ এটাই পুরো সিরিজের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। আর সম্ভবত সবচেয়ে ছোট কারণেই এই বড় পরিবর্তনটি। ‘ঊর্ধ্বপতন’ শব্দটা আমার এত পছন্দের যে এই একট শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানোর জন্য আমি পুরো প্যারাটাই বাদ দিয়ে দিয়েছি।
(সমাপ্ত)
June 03, 2008