নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (৩)

পরশপাথর

পৌষের পড়ন্ত বিকেলে, বড় বাড়ীর বৌ-ঝিয়েরা যখন অলস ভঙ্গিতে মাথায় চিরুনি বুলিয়ে ঝিমোতে থাকে, ঠিক তখনটাতে তাদের সে আলস্যমাখা সুখানুভূতির ব্যাঘাত ঘটাতেই হয়তো, দূর থেকে আসা মৃদু গুঞ্জন বাড়তে থাকে একটু একটু করে। উঠোনের মাঝে খেলতে থাকা দুধের শিশুকে এক টানে কোলে তুলে নিয়ে, মায়েরা গিয়ে উঁকি মারে বাড়ীর পূর্বদিকটায়, আমাগাছটা যেখানে আড়াল করে রাখে তাদের দাঁড়ানোর জায়গা। পালকি যায়, মেঠো পথ ধরে। একদিন ঠিক এমনি করে পালকিতে চড়ে, তারা প্রথম এসেছিলো স্বামীর বাড়ীতে, নতুন বউ হয়ে। যৌবনের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে তাদের চোখের কোণগুলো কেমন যেন ভারী হয়ে আসে। কিন্তু এখনকার এই দিনে, নতুন বউরাতো আর পালকিতে চড়ে শ্বশুর বাড়ী যাবেনা। তবে কে যায়?  

অমন করে হাঁটিওনা বিবি, মাটিয়ে গোস্‌সা করে- মনে কি পড়ে সেই লালসালুর কথা? মজিদ আর মোদাচ্ছের পীরের সেই মহব্বতনগর গ্রামের কথা? এই কালজয়ী  উপন্যাসের কোথাও একটিবারের জন্যও নোয়াখালী শব্দটি লেখা নেই। তবু মনের গভীরের কোন এক অজানা বোধশক্তি আমাদের জানিয়ে দেয় লালাসালুর বর্ণিত চিত্র নোয়াখালী অঞ্চলের। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মেঠো পথ ধরে আজও এখানে পালকিতে চড়ে হুজুর যায়, স্থানীয়রা যাকে ডাকে জৈনপুরী হুজুর নামে। পরম ভক্তি সহকারে, ফিসফিস করে, পথচারীরা একে অপরকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, কোন জন? মাইজ্জা(মেজো) হুজুর না সাইজ্জা(সেজো) হুজুর? পরিবারতন্ত্র আছে এখানেও। এক ঘরমে দো পীর নয়, একেবারে চার চারটে পীর। এরা আসে শীতের সময়ে, পাখীর মত অতিথি হয়ে; কিংবা বলা যায়  সুসময়ে, যখন পথঘাট শুকনো থাকে, আসে বন্ধু হয়ে, সুসময়ে বন্ধু হয়ে। দু’মাসের জন্য আসলে কি হবে, বার মাস ধরেই তাদের জন্য ঘর প্রস্তুত থাকে পরম যত্ন সহকারে। তারা যখন খুশি আসবেন, যখন খুশি যাবেন। শত শত লোক ধন্য হবেন তাদের আশীর্বাদ পেয়ে। যুগ যুগ ধরে বাড়ীর সবচেয়ে বড় মুরগীটা, পুকুরের সবচেয়ে বড় মাছ, বিদেশ থেকে আসা ওয়ান ম্যান শো এখানকার মুরীদরা যত্ন করে রেখে দেন তাদের জন্য। 

কিন্তু সে দিন কি আর আছে? দিন বদলে গেছে। আজ থেকে পাঁচ বছর পূর্বেও জৈনপুরী হুজুরের ওরশের দিন, দুই পাশে লাইন করে দাঁড় করিয়ে রাখা হত জবাই দেবার গরু। পরম ভক্তি সহকারে ধনবান মুরিদরা নিয়ে আসতো এক একটি গরু। সবাইকে তবারক(ওরশ উপলক্ষ্যে রান্না করা খাবার) দেবার জন্য জবাই দেবার পরও বাকী থাকত বেশ কয়েকটি। চাহিদার থেকে যোগান বেশী। কিন্তু সে সব কাহিনী আজ বড়জোর পুরোনো দিনের গল্প করার উৎসমাত্র। সর্বশেষ ওরশে গরু না আসায় মহিষ কিনে জবাই করে পূরণ করতে হয়েছে চাহিদা । শিক্ষা আর আধুনিকতার জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যত সব কুসংস্কার, অন্ধভক্তি আর পশ্চাদপদতা।  আধুনিকতা এখানে কোন পর্যায়ে, তার রূপ বর্ণনা কারার জন্য জায়গাটার একটু বর্ণনা দেয়াই যথেষ্ট হবে। 

আমি এখন যে জায়গাটির কথা লিখছি তার স্থানীয় নাম বামনী, গ্রাম রামপুর। বেশিরভাগ মানুষ প্রবল ধর্মপ্রবণ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নষ্ট হয়নি এতটুকু । বাংলায় বহু কৃষ্ণনগর শহিদনগর হয়ে গেছে, বহু শিবগঞ্জ আলিগঞ্জ হয়ে গেছে। কিন্তু রামপুর আছে তার আদি নাম নিয়ে, দ্বিতীয় আরব নামে খ্যাত (স্থানীয়রা তাই বলেন) এলাকাটির নামই রামের নামে। ‘ব্রাহ্মণি শব্দ থেকে উদ্ভূত বামনী’ এলাকা পুরো থানায় পরিচিত ভদ্রলোকের আবাসস্থল বলে। রাস্তাঘাট এতটাই পরিপাটি যে, থানা সদর থেকে নয় কিলোমিটার দূরত্বের এই জায়গাটিতে যাওয়ার জন্য কখনো মাটিতে পা লাগাতে হবেনা। সম্ভাব্য সবগুলো রাস্তাতে পিচ্‌ ঢালা। বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যখন বাজেটের অজুহাতে ঠিকভাবে টেক্সী চলারও অনুপযুক্ত, তখন এখানকার এমন কিছু রাস্তা, যেখানে বড়জোর দৈনিক দুইটা মটর সাইকেল চলে, কেন সেগুলোতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে পিচ্‌ ঢেলে রাখা হয়েছে, সেটা বুঝতে হলে আপনাকে প্রবেশ করতে হবে রাজনীতিতে। 

প্রায় সব সরকারের আমলে এখানকার লোকজন মন্ত্রী পেয়ে এসেছেএই সংসদীয় আসনটি দেশজুড়ে খ্যাত ভি,আই,পি আসন নামে। লোকজনের সাথে কথা বলে বঝা যায়, বর্তমান জামায়াত ইসলামের প্রার্থী এখানে বেশ জনপ্রিয়। ব্যক্তি হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। আওয়ামীলীগ এবং বি,এন,পি প্রার্থী থেকে বেশি না হলেও, খুব একটা কম নয়। কিন্তু বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন এখানকার মানুষগুলো ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ঠিক আগে আগে, সেটা যেন ভুলে যায় ইচ্ছে করেই। মন্ত্রী না পেলে এম,পি দিয়ে তারা করবেটা কি? তাদের সেই প্রশ্নের উত্তর হয়ে আসে সরকার, আসে মন্ত্রী। ফলস্বরূপ, গ্রামের সব কাঁচা রাস্তাগুলো ঢেকে যায় শক্ত ইট আর আলকাতরার কালো চাদরে।  

এখানকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কালভার্ট, হসপিটাল সব জায়গাতে অন্তত একটা জিনিস কমন দেখা যায়; ভিত্তিপ্রস্তর। নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর। ভিত্তিপ্রস্তরগুলোতে আবার আরেকটা জিনিস কমন; ওবায়দুল কাদের। আওয়ামীলীগ আমলে এই নতুন স্থাপনাগুলো তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এসে যায়, তাহলে ব্যারিস্টার মওদুদ কোথায়? সেটা জানতে হলে একটু বুদ্ধি খরচ করে জানতে হবে। সবকিছু ভূপৃষ্ঠে থাকেনা, যেতে হবে ভূনিম্নে। প্রকৃতি তার এক অপার মহিমা দিয়ে বাংলাদেশ নামক তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশটিকে দেখিয়েছে মমতা, জানিয়েছে ভালবাসা। তবে সে ভালবাসা গ্রহণ করতে জানতে হয়। বাংলাদেশের সবগুলো জেলা শহরে ঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ আছে কি না আমার জানা নেই, তবে এখানাকার মাটির নীচ দিয়ে চলে এসেছে প্রকৃতির সেই অপূর্ব উপহার ঠিক এই ব্যাপারটাতেই - গালভরা বাংলায় যাকে বলে টেকসই উন্নয়ণ, চলে আসবে ব্যারিস্টার মওদুদের নাম 

এই বামনী এলাকাটি আধুনিকতার পথে কতটুকু এগিয়ে গেছে, সেটা বলার জন্য অতশত উদাহরণ না দিয়ে, শুধু একটি কথাই হয়তো যথেষ্ট হয়ে যেত। আপনি কি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন, জেলা সদরতো দূরে থাক, থানা সদর থেকে নয় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত মফস্বলের এই বাজারে আছে যথেষ্ট মান সম্পন্ন একটি সুপার শপ? আদৌ কি একে মফস্বল বলা যাবে? কিছু না থেকে যদি শুধু তার নামটা হতো সুপার শপ, তাহলেইতো অবাক হয়ে যেতে হয়।  তবে এরকম সুপার শপগুলোর মালিক আর ক্রেতারা যখন ব্যস্ত থাকেন বিকিকিনি নিয়ে, সেই সময়টাতেই তাদের বাড়ী থেকে বউ-ঝিয়েরা বোরখা লাগিয়ে বেরিয়ে যায় রাস্তায়। এ বাড় থেকে সে বাড়ী। নতুন এক ধারা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে এখানে। এরা বাড়ী বাড়ী যায় তাবলীগে জামাতের কাজ করতে। ধর্মপ্রাণ এই এলাকার লোকগুলো ধর্মের সেবা করার কোন সুযোগ যেন হাতছাড়া করতে চায়না। কিন্তু আমি যদি বলি, যে ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের চারদেয়ালের মাঝে বন্দী করে রাখা হয়, সে ধর্মের দোহাই দিয়েই তারা বেরিয়ে আসে চারদেয়ালের  বাইরে।- তবে যেন রাগ করবেন না। এই একটি বাক্য লেখতে পারবার জন্য আমাকে অতিবাহিত করতে হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্ট করে হলেও তাদের সাথে কথা বলতে হয়েছে আগ্রহ সহকারে। কালে কালে তারা দেখে এসেছে, এই একটা অজুহাত তথা ধর্মের অজুহাত দেখালেই তাদের স্বামীরা আর চোখ রাঙিয়ে কথা বলেনা। ঠিক একই কারণে হুজুরের পালকি দেখার নাম করে বাড়ীর বউ ঝিয়েরা বেরিয়ে আসে বাড়ীর সীমানার বাইরে। মুক্ত হাওয়ার স্পর্শ পেতে, আলোকের ছোঁয়া পেতে, দিগন্তের সীমানায় তাকিয়ে থাকতে। তারা বুঝতেও পারে না, পালকির কথা শুনে কেন তারা পাগল হয়ে ছুটে যায়। কিন্তু বুঝতে পারে তাদের অবচেতন মন। পরপুরুষ দর্শনে তাদের স্বামীদের প্রবল আপত্তি থাকলেও, আপত্তি নেই পীরপুরুষ দর্শনে। তাই ধর্ম আরা পীরপুরুষই যেন তাদের জীবনে হয়ে এসেছে আশীর্বাদ হয়ে। 

উপরের কথাগুলো সম্পূর্ণই আমার অভিজ্ঞতালব্ধ নিজস্ব মতামত। আপনি মানতে না চাইলে বা দ্বিমত প্রকাশ করলেও আমার কোনও অনুযোগ নেই। ঠিক যেমনটি অনুযোগ নেই আপনি যদি মানতে না চান, এখানকার সুবিখ্যাত ফ্যামিলি নাজির মিয়াদের ফসলের ক্ষেতে যে বিপুল পরিমাণ লোক কাজ করত, তাদের জন্য পান্তা ভাত তৈরী হত বাঁশ নির্মিত সুবিশাল পাত্রতে করে পুকুরে ডুবিয়ে রেখে। ঢেঁকি দিয়ে তৈরী করা হত শুটকির ভর্তা। এই পরিবারটির গৃহকর্তীর নাকি একবার শখ হল, উনি পরিবারের নিজস্ব খামারের মহিষগুলো দেখবেন। দেখবেন বলেছেনতো দেখবেন, কোন কিন্তু নয়। কিন্তু মহিষের খামার অনেক দূরে। মাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই ছেলেরা মায়ের জন্য দেখাতে নিয়ে এসেছিল দড়ি, যে দড়িগুলো দিয়ে বেঁধে রাখা হয় মহিষগুলোকেবিশাল বিশাল দুটি নৌকায় করে নিয়ে আসা হয়েছিল দেই মহিষ বাঁধার দড়ি। আপনি যদি আমার মত বেরসিক হন, তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয় আপনার মনে প্রশ্ন চলে এসেছে, যখন মহিষের দড়িগুলো নৌকায় করে নিয়ে আসা হয়, তখন মহিষগুলো কিসের সাথে বাঁধা ছিলো। আসলে এই মহিষগুলোর গলায় কোন দড়ি বাঁধা হয়না। ছেড়ে দেয়া হয় বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে। শুধু যখন বেঁধে রাখার দরকার হয়। তখন দুপায়ে কায়দা করে পরিয়ে দেয়া হয় দড়ি, যাতে করে আর চলতে না পারে। নাজির মিয়া এখন বেঁচে নে। আছে তার তৃতীয় পুরুষ। পুর্বপুরুষের সেই বর্ণাঢ্য দিনগুলোর কথা মনে করে আজও তারা স্বপ্নাতুর হয়ে উঠে।  

এই পরিবারটির কথা না বললে এখানকার কথা বলা সম্পূর্ণ হয়না। এটি এখানকার একটি ব্র্যান্ড নেইমএকদিন এদের যশ আর জৌলুস দূর-দূরান্ত থেকে টেনে এনেছিল শিক্ষিত আর অভিজাত পরিবারের সন্তাদের, তারা একে একে ঘরনী করে নিয়ে গেছে এই পরিবারের মেয়েদের; তবে সেই অভিজাত সম্প্রদায়ের সাথে সাথে তারা টেনে এনেছিলো আরও এক বিশেষ সম্প্রদায়কে, এখানকার মানুষদের হতচকিত করে প্রথমবারের মত এই অঞ্চলের এই বাড়িতেই এসেছিলো ডাকাতের দল। অনেক অনেক দিন আগের কথা। দুর্বল রাষ্ট্র, তদাপেক্ষা দূর্বল তার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, দিনের বেলা ঢাক ঢোল পিটিয়ে আসতো সেই ডাকাতের দল। অন্তত এখানকার মানুষ তাই বলেঅথচ আজ আমরা সভ্য হয়েছি। রেলগাড়িতে করে, এপোলোতে চড়ে সভ্যতা এসেছে আমাদের ঘরে ঘরে। আজ আর দিনদুপুরে লুটপাট করেনা সেই অসভ্য ডাকাতের দলশুধু ময়দানে ময়দানে তারিখ ঘোষণা করে, প্রকাশ্য দিবালোকে, মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলে অন্য আরেক মানুষকে। তাতে কি? তাতে করেতো আমরা আর সুসভ্য থেকে অসভ্য হয়ে যায়নি। এখনো আমরাই সষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাখলুকাত। সমস্ত সৃষ্টির মাঝে একমাত্র আমরাইতো পারি চাঁদে যেতে।             

[email protected]

January 29, 2008