নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (৪)

পরশপাথর 

খুব ভোরবেলাতে মাঝবয়সী এক মহিলার উঁচুস্বরের কথাবার্তায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। কি বলছে সেটা বুঝতে পারছিনা। তবে আমার গৃহকর্তী যে পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে সেটি শুনছে; তাতে করে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি, আমার না শুনতে যাওয়াটা বড় রকমের অন্যায় হয়ে যাবে। ঘটনা সাংঘাতিক। এই বাড়িটিরই আরেকটি ঘরে গতরাতে চুরি হয়েছে, সিঁধ কেটে নিয়ে গেছে জিনিসপত্র। কিন্তু দন্তস্য এর উপর চন্দ্রবিন্দু দিয়ে তাতে হ্রস্ব ই-কার যোগ করে, তার পর মহাকষ্টে মহাপ্রাণ ‘ধ’ লাগানোর মানুষ নোয়াখালীবাসী নয়। তারা শর্টকাট এ বিশ্বাসী। সিঁধকাটাকে সহজ করে বলে দেয় ‘হিং দেয়া’। শব্দটা আমার এতটাই পছন্দ হয়েছে যে, আমি নিজেও সমানতালে হিং হিং বলে গেছি। 

যে ঘরে সিঁধকাটা হয়েছে সে ঘরের আশপাশে সকাল থেকে অনেক লোক সমাগম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকজনও বাড়তে থাকে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে,’নীল আর্মস্ট্রং এই পথ দিয়ে একটু পরেই চাঁদের দেশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসছে’। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন এই রোমাঞ্চকর ঘটনাটা নিজ চোখে না দেখলে তারা যেন মরেও শান্তি পাবেনা। এমন না যে, ছয় মাসে নয় মাসে একটা ঘটনা ঘটছে। বলতে গেলে প্রতিমাসে দু’তিন বার এরকম ঘটছে। তবুও তারা একচোখ জিজ্ঞাসা নিয়ে অবলোকন করে এই সমস্ত ভূতপূর্ব ঘটনাগুলি। হয়তো এর মধ্য দিয়েই পল্লীর মানুষগুলো তাদের গতবাঁধা জীবনে খুঁজে পায় একটুখানি বৈচিত্র্যের সন্ধান । 

সিঁধকাটা চোরেরা আসে মাটির তৈরী মেঝের ঘরে। রাত ধরে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ঘরে ঢোকার জন্য মোটামুটি রকমের একটা সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলে। গৃহস্থরাও আবার কম চালাক নন। কোনভাবে জানতে পারলে, তারা চুপটি করে বসে থাকেন দু’তিন জন এক হয়ে। যেই না চোর সুড়ঙ্গ দিয়ে মাথা ঢুকালো, অমনি সবাই মিলে জাপটে ধরেন। তারপরতো চিকার। কিন্তু সে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গৃহস্থের থেকে চোরের বুদ্ধি থাকে বেশি। মহামান্য চোর মহাশয় প্রথমে লাথির মাথায় কালো পাতিল লাগিয়ে আস্তে করে ঢুকিয়ে দেন সুড়ঙ্গ পথে। চোরের মাথা মনে করে গৃহস্থ যদি সেই পাতিল ধরতে যান, তাহলে খেলা সেখানেই শেষ। চোর গৃহস্থের এই খেলা বাংলার আদিম খেলা, এক আদিম ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে প্রায় সবসময়ই মহাশয়রা গায়ে ব্যাপক পরিমাণে তেল মেখে নেয়। যাতে করে দরকার পড়লে হাত পিছলে বের হয়ে যাওয়া যায়। 

কিন্তু খেলার আসল রেশটা যে আসে খেলার শেষে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। পাশের ঘরের নূরির মা এসে বলে,’আমনেরা এক্কা বেঁহোঁসের মত কেন্নে ঘুম জান? হারা গরেতুন জিনিস লই গেল, এক্কানা কইতেনও হাইত্তেন নয় বুজি?’(আপনারা এ রকম বেহুঁশের মত করে কিভাবে ঘুমান? সারা ঘর থেকে জিনিস নিয়ে গেল, একটু বলতেও পারবেন না বুঝি?) বাড়ীর বড় বউ এসে বলে,’আঙ্গো হ্যাতেন ত আয়ছে ম্যালা রাইচ্ছা, দেরী করি গুম গেছে, হ্যান্নে কইতো হাইত্তো নয়’।(আমাদের উনিতো আসছেন অনেক রাতে, দেরী করে ঘুমিয়েছেন, সে জন্য বলতে পারবে না।) বাড়ির ছোট কাজের ছেলে বলে,’আঁয় হারুইন্না চোরারে হোরুগাও দেইখছি বায়এর চাইরোফাসে গুরের, হেক্তেই আঁর সন্দ অইছিল’।(আমি হারুন চোরকে পরশুদিনও দেখেছি বাড়ির চারপাশে ঘুরছে, সে সময়ই আমার সন্দেহ হয়েছিল।) কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে চোর মহাশয় আরো যে একটা কাজ করে গিয়েছিলেন সেটা অন্য এলাকার চোরেরা করবে কিনা আমি জানিনা; পাতিলের সবটুকু মুরগীর মাংস আর অর্ধেক পরিমাণ ভাত উনি একাই শেষ করে গেছেন। সাহস বলবো না বোকামি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিনা। 

এতক্ষণ যে বাড়ীটার কাহিনী বলছি, এবার তার অবস্থানটা একটু বর্ণনা করা যাক। আগেই বলেছি এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান এবং অতীত থেকেই তা হয়ে আসছে। তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এলাকাগুলির নামেকরণের মধ্য দিয়েই। রাম আর মূসা এখানে পাশাপাশি অবস্থান করে। রামপুরের পাশেই মুছাপুর (মূসাপুর থেকে আসা)। অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্ব কাকাবাবু নামে খ্যাত কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমদ’র জন্মভূমি (মতান্তরে সন্দ্বীপ)এই মুছাপুর। মুছাপুরের এই বাড়িটিতে আমার এক আত্মীয় স্থানীয়া বৃদ্ধা বাস করেন। সে বাড়ীর কথাই লিখছি।  

এখানে আমি এসেছি বহুবার। এ এক স্বপ্নময় জগত। আমার আত্মীয়া মহিলা ভাত রান্না করেন মাটির চুলোতে। তার পর আগুন নিভিয়ে সেই চুলোর ছাঁইয়ের ভেতর রেখে দেন আলু। পোড়া লাল মরিচ আর সরিষার তেলে মাখানো আলুর ভর্তা। অমৃতের স্বাদ মনে হয় আমি পৃথিবীর এই একটা জায়গাতেই পেয়েছি।খাওয়া শেষ করে তিনি অনেক্ষণ ধরে পড়তেন নামাজ। সেই সুযোগে আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম দেখতাম তিনি বড়শি ফেলে পুকুর থেকে মাছ ধরছেন। আমি যে তার অতিথি, তাই রাতের খাবারের সুব্যবস্থা করতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা। 

বিদ্যুবিহীন এই বাড়িতে রাতের বেলা চাঁদের আলোতে বসে আমি কতবার যে এই মহিলার কাছ থেকে তার যৌবনের গল্প শুনেছি, জিজ্ঞেস করেছি তার বিয়ের লগন আর বউ হয়ে আসার সেই পুরোনো কাহিনীর কথা, তার হিসেব নেই। ‘আমাদের সময় ছিল শকুন, যে দেশে বিচার নাই ঐ দেশে শকুন থাকেনা, আমাদের সময় দেশে বিচার ছিল।’ ভদ্রমহিলা সবসময় এই বলে গল্প শুরু করতেন। তার উপর কি অবিচার করা হয়েছে, কে অবিচার করেছে  সেটা আর বুঝিয়ে বলতে পারতেন না। কে জানে, হয়তো চারপাশের অবিচার আরা অন্যায় দেখে তার মনে এই বোধের জন্ম হয়েছে।  

অনেক রাতে আমি যখন চলে যেতাম ঘুমোতে, তখনও তিঁনি থাকতেন বাইরে। পুকুরের সিঁড়িতে। মাথার উপর চালা তুলে। ঘুমোনোর সময় একটা দড়ি কোমরে বেঁধে, দড়ির অপর প্রান্ত পুকুরে ভেজানো ধানের বড় লাই বা পাত্রের(স্থানীয়রা বলে হাজারী) সাথে। চোরের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য, যাতে করে চোর ধান নিতে গেলে টান লেগে জেগে উঠতে পারেন। মহিলার সাথে ঘুমিয়ে থাকতো তার ছোট ছেলে; মায়ের সাথে পরম তৃপ্তিসহকারে ঘুমিয়ে থাকা। কিন্তু সকালে উঠে দেখা গেল, চোর দড়ির প্রান্ত একটা গাছের সাথে বেঁধে সব ধান নিয়ে চলে গেছে। রাতে কোমরে বাঁধা দড়ি যতবারি টানা হয়েছে ততবারই টান টান ছিল, তাই সন্দেহটুকুও হয়নি যে চুরি হয়ে যাচ্ছে। আগেই বলেছি, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গৃহস্থের থেকে চোরের বুদ্ধি বেশি। 

আমার এই বয়স্কা মহিলাটি আজো বেঁচে আছেন। আজও এই অঞ্চলে এলে আমি তাঁর বাড়ী যাই, আগেকার দিনের সেই একই রকমের আগ্রহ নিয়ে। প্রসংগক্রমে, একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। বিস্তারিত না বলে শুধু এইটুকু বলে রাখি, এই অসামান্য মহিলার যে ছোট ছেলেটি মায়ের সাথে পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে রাতে শুয়ে ধান পাহারা দিত, ঘুমিয়ে থাকত সারাটি রাত; সে আজ দেশের নাম করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার শুধু মনে হয়, জীবনকে তার চেয়ে ভালো করে আর কে চিনতে শিখেছে, কে বুঝতে শিখেছে? জীবনের অনেকগুলো অধ্যায়ই তার পড়ে থাকবার কথা। এই শিক্ষক আর তার মায়ের প্রতি থাকল আমাদের সন্মান আর শ্রদ্ধা।                     

[email protected]

February 22, 2008