নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (৭)
পরশপাথর
কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। সবুর করিতে চাহিবার কোনো কারণও থাকিবার কথা নহে। বরের বিদেশ যাত্রা করিবার আর যে মাত্র বিশ দিন বাকী রহিয়াছে। এখনি ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ ঘরে তুলিতে না পারিলে বাপ হিসেবে সমাজে আর মুখ দেখানোর উপায় রহিবেনা। বহুকাল গত হইবার পর বিয়ে করিবার নিমিত্তে ছেলে সৌদি আরব হইতে অনেক আশা করিয়া দেশে আসিয়াছে। মাশাল্লাহ! অন্য আর পাঁচ সাতটা ছেলে হইতে তাহার সাংসারিক বিচার-বুদ্ধি ভালো, একটু বেশিই হবে। আসিবার সময় হবু বউয়ের জন্য বাইশ ক্যারেটের পাঁচ ভরি স্বর্ণ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। হরেক রকমের কসমেটিকস্ আর সুগন্ধি সাবানতো আছেই। এখনকার যুগে এহেন পাত্র পাওয়া যেকোনো মেয়ের জন্য অতীব সৌভাগ্যের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইবে।
প্রথম প্রথম ছেলের মা খালারা প্রাইভেট রিক্সা ভাড়া করিয়া, ইরানী কাপড়ের তৈরি বোরখা মাথায় দিয়া, পুত্রের দেয়া নোকিয়া মোবাইলে নেটওয়ার্ক লাগাইয়া এ বাড়ী ও বাড়ী যাইয়া পাত্রী দেখিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহাদের চাহিদা খুবই সামান্য। মেয়েকে একটু লম্বা, ফর্সা হইতে হইবে, চেহারায় একটু মায়া মায়া ভাব থাকিবে। মেয়ের বাপের টাকা-পয়সা, জায়গা-জমি মোটামুটি থকিতে হইবে, একেবারে জমিদার হইতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। মেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িবে, রান্না-বান্নায় থাকিবে ঝড়ের গতি; মাংস সিদ্ধ হইতে দেরী হইলে তাহাতে যে পেঁপে কাটিয়া দিতে হইবে কিংবা লবণ বেশি হইয়া গেলে কয়েক টুকরা আলু কাটিয়া দিতে হইবে এই সব তাহার জানা থাকিতে হইবে একেবারে ষোল আনা। স্বভাব চরিত্র হইতে হইবে শান্ত ধীর প্রকৃতির, যাহাতে করিয়া ছেলের ভবিষ্যত কোনভাবেই অশান্তিতে ভরিয়া না যায়।
কিন্তু সমস্ত তল্লাট খুঁজিয়া, এবাড়ী ওবাড়ী রুহআফজা শরবত পান করিয়া, চৌদ্দপুরুষের সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের সাহায্য নিয়াও এইরকম একটি মেয়ে খুঁজিয়া পাওয়া গেলনা। অগত্যা ছেলের বড় ভাবীর চাচাতো ননদের খালাতো বোনের শ্বশুরের দিকের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার মেয়েকে ঠিক করা হইল। মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। গায়ের রং ফর্সা নয়, ফর্সা কেন শ্যামলাও নয়, তাই বলিয়া কেউ একেবারে কালো যে কহিতে পারিবে তাহাও নয়। খাটো বলা যাইবে তবে একেবারে খাটো কেহ বলিতে পারিবেনা। সে বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে মেয়ের বয়স কম, সবে মাত্র মেট্রিক ক্লাসে পড়ে। ময়মুরুব্বিদের শ্রদ্ধাভক্তি করে। স্কুলে যাইবার পথে ভালো করিয়া ওড়না দিয়া মাথা ঢাকিয়া, নিচের দিকে চোখ নামাইয়া, রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটিতে থাকে। মেম্বার সাহেবতো বলিয়াই দিয়াছেন, এ রকম মেয়ে আজকাল হাজারে একটা মিলে, এখানে আর কোনো কথা থাকিতে পারেনা, যত দ্রুত সম্ভব ঘটনা ঘটাইয়া ফেলিতে হইবে। অতএব, বরের বাপ সবুর করিতে চাহিবেন এমনটি আশা করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।
ওদিকে কন্যার দিকের আত্মীয় স্বজনদেরর মধ্যে সবচেয়ে বেশী খুশি দাদী-নানীরা। তাহারা একটির পর একটি পান মুখে পুরিয়া দিয়া, নাতনীর দিকে চাহিয়া মিটিমিটি করিয়া হাসিতে লাগিল। মরিবার আগে নাতনীর বিয়ে দেখিয়া যাইতে পারিবার যে সর্বশেষ শখ তাহাদের অবশিষ্ট ছিল সেটাও পূরণ হইতে চলিল, এ কম কথা নয়। বাড়ীর বউ দিদিরা হিসাব করিয়া বলিয়া দিল এ মেয়ে জন্মিবার সময়ই সবাই বুঝিয়াছিল বড় ভাগ্যবতী হইবে। সেই মেয়ের কপাল ঠিকই আজ আসমানে ঠেকিয়াছে। তা না হইলে এত ভাল বর এমন করিয়া মিলিয়া যাইবে কেন। এহেন পরিস্থিতিতে কি করিতে হইবে ভাবিতে না পারিয়া কন্যা উপর্যুপরি লজ্জা পাইতে থাকিল। তাহার দিদিদের দেখিয়াছে এমন সময়ে বিয়ের কথা কেউ উঠাইলে মুখে আঁচল গুঁজিয়া এক দৌড়ে ভিতরের ঘরে চলিয়া যাইত। কন্যা এবার তাহার দিদিদের সেই কাণ্ডখানি একেবারে যেন নকল করিয়া ফেলিল। বিয়ের কন্যার এইরকম কাণ্ড দেখিয়া দাদী নানীরা চোখ টিপিয়া হাসিতে হাসিতে আরো কয়েকটি পান মুখের ভিতর চালান করিয়া দিলো।
ওদিকে কাছের দিককার আত্মীয় স্বজনরা বিয়ের জন্য একটুখানি প্রস্তুতও হইতে শুরু করিল। স্বামীরা অন্য আর কোন ব্যাপারে স্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করিবার প্রয়োজন বোধ না করিলেও, বিয়েতে নব বর-বধূদের কি উপহার দিতে হইবে উহা স্থির করিতে স্ত্রীদের সহিত ফিসফিস করিতে আরম্ভ করিল। স্বামী কহিল, যেহেতু সতের বছর পূর্বে মেয়ের বাপ তাহাদের বিয়েতে একটা জলজ্যান্ত গরু পাঠাইয়া দিয়াছিল তাহার মেয়ের বিয়েতে এখন গরু কিনিয়া পাঠাইয়া না দিলে কোনোরূপে উহা ভালো দেখাইবে না। স্ত্রী কহিল, এইটা কোন কথা হইলো না; কারণ তার আগের মেয়ের বিয়েতেও গরু কিনিয়া পাঠানো হইয়াছিলো, আরো তিনটি মেয়ে অবশিষ্ট রহিয়াছে; সকল মেয়ের বিয়েতে গরু দিলে চলিবে কেমনে? এমন করিয়া স্ত্রী বুঝাইয়া দিল উপহার দিবার ব্যাপারে স্বামী তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিয়া কি কাজের কাজটাই না করিয়াছে এবং অবশেষে স্থির হইল যে, বিয়ের দিন নতুন জামাই সালাম করিতে আসিলে তাহার গলায় চার আনা ওজনের স্বর্ণের চেইনাখানি পরাইয়া দেয়া হইবে।
ঠিক এভাবেই চলে আসে একটি বিয়ের লগ্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি বুঝতেও পারেনা, কিসের মাঝে তাকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। একদিন হঠাৎ করে সখীদের সাথে কানামাছি খেলা বন্ধ হয়ে যায়। বার বার মা বলে দেয় সবসময় শাড়ী পরে থাকতে, বেশী বেশী বাড়ীর বাইরে না যেতে এবং আগামী কয়েকদিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখতে। সামনের কোন একদিন থেকে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করা যাবে। কিন্তু সামনের সেই কোন একদিন তার জীবনে আর আসেনা। অন্যদিকে, ক্ষণিকের জন্য তার জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে উৎসব। বিয়ের উৎসব। চিরকাল ধরে উৎসবের মধ্য দিয়েই তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় এক অনিশ্চিৎ আগামীর দিকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই আগামীর ইতিহাস লাঞ্ছনার আর বঞ্চনার ইতিহাস। অবমাননা, অসন্মান আর অমর্যাদার ইতিহাস। ঘৃণা আর গ্লানির ইতিহাস। সেই প্রসংগে যাবার সুযোগ এখানে কম। তাছাড়া, সেতো নোয়াখালীর গল্প নয়, সমস্ত নারী জাতির গল্প। আমরা বরং সরাসরি চলে যাই এখাঙ্কার বিয়ের উৎসবে।
‘তেলাই’, যেটাকে সবাই বলি গায়ে হলুদ, হয় বিয়ের ঠিক আগের দিনটাতে। ছেলে এবং মেয়ের বাড়িতে পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত উঠোনের ঠিক মাঝখানটাতে ছেলেকে বসিয়ে দেয়া হয় জলচৌকিতে। তারপর নতুন কলসে করে পানি নিয়ে আসা হয় পুকুর থেকে, আনার সময় কলসের মুখ ঢেকে রাখা হয় ডিগ বরগ (কচি কলাপাতা) দিয়ে। তারপর লাগানো হয় হলুদ। চলে হাসি ঠাট্টা। এক জন আরেক জনকে পানিতে ভিজিয়ে দেয়া। নানা রকমের বাহারি আলাপ। সে এক মহা আনন্দের ক্ষণ। আশপাশের বাড়ীর মানুষজন এসে সেই আনন্দে শরীক হয় আপনা থেকেই।
তেলাইয়ের দিন থেকে বিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত ছেলে মেয়ের মা’কে আঁচলের কোণে বেঁধে রাখতে হয় ‘তেলাই’। স্বর্ণ, রুপা, হলুদ, সরিষার তেল আরো কিছু জিনিস একসাথ করে তৈরী হয় তেলাই। ‘তেলাই’ শব্দটা ঠিক কোথা থেকে এসেছে কিংবা প্রকৃত শব্দটা কি সেটা বের করা সম্ভব হয়নি। তবে এটা বের করা সম্ভব হয়েছে যে, মায়ের যদি একাধিক বিয়ে হয়ে থাকে তবে সেই মা আঁচলে তেলাই বাঁধতে পারবেনা। অমঙ্গল হবে ব’লে। অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবে বাবারও যদি একাধিক বিয়ে হয়ে থাকে তবে সেই মাও ‘তেলাই’ বাঁধতে পারবেনা। বাবার একাধিক বিয়ের অপরাধও যে মায়ের। এ আর নতুন কি, যুগ যুগ ধ’রে পুরুষদের পাপের শাস্তি কাদের ভোগ করতে হয়েছে সেতো আমাদের অজানা কিছু নয়।
‘তেলাই’য়ের দিন থেকেই আত্মীয় স্বজনরা একে একে আসতে শুরু করে বিয়ে বাড়ীতে । শুরু হয় বিয়ের আয়োজন। একদিকে প্রস্তুত হ’তে থাকে হলুদ, মরিচ, তেল-মশলা; প্রস্তুত হ’তে থাকে বিয়ের মেহেদী। অন্যদিকে প্রস্তুত হতে থাকে দুই নারী-পুরুষ, তাদের জীবনের সবচাইতে রোমাঞ্চকর অধ্যায়টির জন্য। অতীত জীবনের লাল নীল যতসব স্বপ্ন এক হয়ে তাদের উড়িয়ে নিতে চায় কোন এক অজানায়, কল্পনার স্বর্গরাজ্যে। সাথে সাথে প্রস্তুত হতে থাকে আরো একটি মানুষ, কাজী সাহেব। যার হাতে সম্পন্ন হবে আরো একটি ‘সামাজিক চুক্তি’; কবুল! কবুল!! কবুল!!! …
April 09 , 2008