নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা (৮)
পরশপাথর
খুব ভোরেও আপনি যদি ঘুম থেকে উঠে চায়ের দোকানে চলে যান, দেখবেন ভীড় খুব একেবারে কম নয়। এখানকার লোকজন চা খায় খুব আয়েশ করে । সে সময় তাদের মুখের দিকে তাকালে আপনি খুব সহজেই বুঝে ফেলবেন এত দারিদ্র্য,এত অনিয়ম,এত বিপর্যয়ের মাঝখানেও কেন বাংলাদেশের মানুষগুলো এত সুখী। আপনি আগন্তুক হলে প্রথমে অবধারিতভাবে আপনার জন্য বকা খেতে হবে দোকানের ছোট্ট ছেলেটিকে। চেয়ার দিতে দেরি হচ্ছে দেখে তার এই বকা খাওয়া; যদিও আপনি দোকানে এসেছেন সবেমাত্র। এটা এখানকার আতিথেয়তারই একটা অংশ, আর ছেলেটিও বকা খেয়ে যেন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী বালকগুলোর একজনে পরিণত হয়ে যায়।
আপনার চা খাওয়া শুরু করতে না করতেই কোণার দিকে বসে থাকা মুরুব্বী টাইপের লোকটি আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কোন বাড়ীতে এসেছেন?’ ‘কার কাছে?’ প্রথম প্রশ্নটা করা মুরুব্বীদের এখতিয়ারে পড়ে, অন্যরা সে-সময় আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। বোধ করি, এ সন্মানটুকু পাওয়ার লোভেই ঘরে বানানো চায়ের স্বাদ উপেক্ষা করে বয়স্ক এই লোকগুলোও এসে উপস্থিত হয় সকালবেলার এই আড্ডায়। এর পরের প্রশ্নটি হচ্ছে- ‘আপনি কি করেন?’ কোনভাবে যদি চাকুরী করে থাকেন তাহলে কি করেন এর উত্তর দেয়ার সাথে সাথে বেতনটাও বলে দিতে পারেন। এর পরের প্রশ্ন যে সেটাই এ ব্যাপারে আপনি শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন।
এ-সবের কোন কিছুই সমস্যা নয়, আপনি বরং মজাই পাবেন। সমস্যা হচ্ছে কোনভাবে আপনি যে বাড়িতে উঠেছেন সে গৃহকর্তার যদি একটা বিবাহযোগ্য মেয়ে থেকে থাকে। তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাবে যে আপনি ঐ কারণেই এখানে এসেছেন এবং অত্যাধিক শরমিন্দা টাইপের লোক হবার কারণে মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারছেন না। মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করার জন্যই যে আপনি এ সাত-সকালে চায়ের দোকানে এসে উপস্থিত হয়েছেন অতটুকু বোঝার মত বুদ্ধি তাদের আছে। অতএব, যতই আপত্তি করেন না কেন উক্ত বালিকার দশ বছর বয়স থেকে কোন কোন ছেলের সাথে চলাফেরা ছিল তার একটা পরিসংখ্যান আপনাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। সব কিছু ঠিক থাকার পরও মেয়ের চরিত্রে সামান্য সমস্যা থাকার কারণে আপনার মতন ভদ্রলোকের এ জায়গায় বিয়ে করার আর কোন উপায় থাকলোনা দেখে তাদের আফসোসের আর সীমা থাকবেনা। এ পর্বটা যত তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলবেন ততই ভালো। কোন রকমে যদি বুঝিয়ে দিতে পারেন এ জায়গায় বিয়ে করার আর কোন ইচ্ছাই আপনার নেই, এ হতেই পারেনা, তাহলে আর পায় কে। শুরু হবে হরেক রকমের গল্প। এক ঘণ্টার আলাপে আপনি হয়ে যাবেন তাদের একেবারে আত্মার আত্মীয়। আপন করে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এখানকার লোকগুলি।
সারা জীবন দেখে আসলাম দেশ নিয়ে আলোচনার পর সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর উপর। আর বিদেশ নিয়ে আলোচনা হলে অতি অবশ্যই সি,আই,এ’র উপর। এ-দেশের বুদ্ধিজীবিরাতো ফসলের মাঠে পোকার আক্রমণ দেখা দিলেও তার পেছনে সি,আই,এ’র একটা হাত দেখতে পায়, একেবারে পাঁচ আঙ্গুলওয়ালা কালো হাত। কিন্তু যে-সকালটাতে আমি কথা বলছিলাম তখন তাদের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়লো বেচারা ‘আবহাওয়া অফিস’ এর উপর। আমার কখনো মনেই হয়নি এ নিরপরাধ অফিসটা এত বড় একটা অন্যায় করে বসে থাকতে পারে। এই লোকগুলি খুব যে উচ্চ শিক্ষিত তা নয়। তারা জানে কম, কিন্তু যেটুকু জানে গভীরভাবে জানে বা জানার চেষ্টা করে।
আবহাওয়া অফিস নাকি সংবাদ পরিবেশনের সময় বলে, “আগামী চব্বিশ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় ঘণ্টায় এত এত মাইল বেগে জোরো হাওয়া বয়ে যেতে পারে, সে সঙ্গে হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বৃষ্টি কিংবা বজ্রসহ ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে, এছাড়া দেশের অন্যত্র আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকবে।” - তাদের প্রশ্ন হচ্ছে ছয়টি বিভাগ ছাড়া এই অন্যত্র জায়গাগুলি কোথায় অবস্থিত? আর জোরো হাওয়া বইতে থাকবে, কিংবা বৃষ্টি হবে অথবা বজ্রসহ ভারী বৃষ্টিপাত হবে, নয়তো শুষ্ক থাকবে। এ-ছাড়া আরতো কিছু হবার নেই। এ-দেশেতো আর তুষারপাত হয়না। তাহলে এ সংবাদ পরিবেশনের মানে কি? এদের প্রশ্নগুলি শুনে সাত সকালে হিমেল বাতাসের মাঝখানেও আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। এমনও নয় যে তারা প্রশ্নগুলি আমাকে করছে। তারা একে আরেকজনের সাথে আলাপ করে যাচ্ছে। আমার কিছু বলতে যাওয়া উচিৎ কিনা বুঝতে পারছি না। তাছাড়া আমার বলারইবা আছে কি?
আমার কিছু বলার দরকারও হ’লো না। যুবক বয়সী এক লোক চায়ের দোকানে প্রবেশ করতে না করতেই ভিতর থেকে একজন বলে উঠলো, কিরে বাকশাইল্লা(আওয়ামীপন্থী) খবর কি? তার পরবর্তী অংশ সরাসরি তুলে দিলাম।
--খবর বালা, বাকশাইল্লা অনঅ বালা, তোগো মতো ত আর বাঙ্গা সুটকাইস লই গত্তুন বারোই, চুরি করি আইজ কুটি কুটি টেঁয়ার মালিক অই নয়।
(খবর ভালো। বাকশালী হওয়াও ভালো। তোদের মততো আর ভাঙ্গা স্যুটকেস নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে, চুরি করে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক হইনি)
--কাআ? দিনে দুরফে যেন ব্যাঙ্ক ডাকাইতি কইচ্ছিলা হেটা কি বুলি গেসোনি? অতার বউরে যেন গত্তুন উডাই লই চলি গেসোগোই হেটাও বুযি বুলি গেসো?
(কেন? দিন-দুপুরে যে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছিলে সেটা ভুলে গিয়েছ নাকি? ওর বউকে যে ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছ সেটাও বুঝি ভুলে গিয়েছ?)
--কার বউরে উডাই নিসি?
(কার বউকে উঠিয়ে নিয়েছি?)
--ওরই! হ্যাতে এবঅ কইতো হাইত্তো নয়।
(ওহ! সে এখনো বলতে পারবে না।)
--উডাই নিসি বালা কইচ্ছি। তোগো মততো আর রাইচ্ছার কালে অতার লগে হাবা খাইতাম যাই নয়। কিয়া কয় হেটারে, লং ডাইব নি?
(উঠিয়ে নিয়েছি ভালো করেছি। তোদের মততো আর রাতের বেলা ওর সাথে হাওয়া খেতে যাইনি। কি যেন বলে ওটাকে, লং ড্রাইভ না?)
--ওওহ! তুইতো ড্রাইভার আছিলি হে গাঁয়র। তুয়ি কইতি হাইরবি। আর তোগো হেতিয়ে যে জামাই হিডে হেটা কইতি হাইত্তি নয়?
(ওহ! তুইতো ড্রাইভার ছিলি অই গাড়ীর। তুই বলতে পারবি। আর তোদের ওযে জামাই পিটায় সেটা কি বলতে পারবিনা?)
এ সমস্ত রঙ্গিণ সব তথ্য এরা কোথা থেকে পায় জানিনা। সেই সূত্র খুঁজে বের করে আনার আগেই আমাকে থামতে হচ্ছে এবং সাথে সাথে উঠতে হচ্ছে চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে। বড় হিংসে হয় এ মানুষগুলোকে দেখে। কি সুখেই না তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবনের অলিগলিতে। হয়তো নেই কোনো আগামীর চিন্তা। তাদের জীবনে বিশ্বাস আছে বিজ্ঞান নেই, তথ্য আছে সূত্র নেই, বর্তমান আছে ভবিষ্যত নেই। কেউ তাদেরকে হয়তো মুখস্ত করিয়ে দেয়নি ‘ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ’। তাই তারা ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেনি, তারা জ্ঞানী হয়ে উঠেনি, বর্তমান নিয়েই হয়ে উঠেছে সুখী। আড্ডা দেবার তীব্র আকাঙ্খাকে পিছনে ফেলে আমাদের উঠে যেতে হয় চায়ের দোকান ছেড়ে। ফিরে যেতে হয় হিসেব করা জীবনে। সোনালী এক ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হ’য়ে আমরা এগিয়ে যাই, আমরা উপরে যাই। আর এভাবেই হয়তো হতে থাকবে আমাদের ‘ঊর্ধ্বপতন’।
April 27 , 2008