বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা

পরশপাথর   

দ্বিতীয়ত, বাস্তব এবং আধুনিক চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যহীন অসুস্থ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। ধর্মভিত্তিক অন্য আর সব কিছুর মত এই ব্যবস্থাটিও যত দ্রুত বিদায় হবে ততই মঙ্গল। কিন্তু প্রথমত, সতের-আঠারো বছরের, বলতে গেলে একজন অবুঝ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে হঠা করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কোন ভদ্র সম্প্রদায়ের থাকতে পারেনা। যে ব্যক্তিবর্গ মিলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের (যাদের বাংলা ইংলিশ বিষয় দুটোতে এস,এস,সি এবং এইচ,এস,সিতে ৮০০ নাম্বর নেই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার অযোগ্য ঘোষণা করে ছিলেন তাদের সম্প্রদায় নির্ণয় করবার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। 

বিভিন্ন অনুষদের ডীন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখে থাকেন, তারা নির্বাচিত হন নৈকট্যের ভিত্তিতে। সেই নৈকট্য ছাত্রদের সাথে নয়, শিক্ষকদের সাথে নয়, বইয়ের সাথেও নয়, গবেষণার সাথেও নয়। সেই নৈকট্য ম্যাডামের সাথে কিংবা আপার সাথে। ম্যাডাম আপার পুত্রদের সাথে হলেতো আরও ভালো। এই দেশটির অসুস্থ রাজনীতি আর তার নোংরা চর্চা কোন কিছুকেইতো রেহাই দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়তো তার এক অভিজাত শিকারমাত্র। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যে সমস্ত ব্যক্তিগুলি ম্যাডাম আপাদের কৃপায় সিদ্ধান্ত নেবার সিংহাসনে বসে আছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা একটি সিদ্ধান্তের পরিণতি নিয়ে ভাববার সময় তাদের থাকবার কথা নয়। লাল নীল বেগুনি দল আর সেই দলের প্রধানদের পাচেটে নিজস্ব স্বপ্নগুলিকে লাল নীল বেগুনি করে নেবার ভাবনায় তারা বিভোর থাকবে, তেমুনটি ছারা তাদের কাছ থেকে আরা কি বা আশা করা যায়? 

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা চারশ নাম্বারের বাংলা না পড়ে আসলে যদি বাংলা ডিপার্টমেন্টের সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়ে যায়, তাদের মান নিচে নেমে গিয়ে একেবারে পাতালে ঠেকে যায়, চারশ নাম্বারের ইংলিশ না পড়ে আসলে হঠা করে যদি জার্নালিজম, ইকোনোমিকস ডিপার্টমেন্টের সকল কর্মকান্ড স্থবির হয়ে যায়, এগিয়ে চলা স্থগিত হয়ে যায়, তাহলে তাদের উচিত হতো দয়া করে আর দুটো বছর অপেক্ষা করে সেটা মাদ্রাসা বোর্ডকে এবং দেশবাসীকেও জানান দেয়া। দু-চারটে বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটেও বেশি কিছু নয়। বছর নষ্ট করার ক্ষেত্রে এরা ইতোমধ্যে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এরকম কত দু-চার বছর এরা সেশান জট দিয়ে খতম করে দেয়, হল নির্মানের জন্য নির্ধারিত স্থান - এরকম কত সাইনবোর্ড বছরের পর বছর এমনকি দশক ধরেও ঝুলতে থাকে, হল কিন্তু আর নির্মাণ করা হয়ে উঠেনা। অতএব, অপেক্ষা করার ক্ষেত্রে এরা বড়ই দক্ষ। সূতরাং, সিদ্ধান্তটার কথা দেশবাসীকে জানিয়ে, কয়েকটি বছর অপেক্ষা করে, তারপর বাস্তবায়ন করলে এই উদ্ভট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়না। 

তারা বলতে পারতো যে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যদি মহামূল্যবান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো মহামূল্যবান এই ডিপার্টমেন্টগুলোতে ভর্তি হতে চায় তাহলে তাদেরকে অতি অবশ্যই বেশি বেশি করে বাংলা ইংরেজি পড়ে আসতে হবে। কত কিছু নিয়েইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী এই ব্যক্তিবর্গ বিবৃতি দিয়ে আসে, লাল নীল বিবৃতি দিয়ে পত্রিকার পাতা ভরিয়ে ফেলে। এই ছোট্ট একটা ঘোষণা আগে দিয়ে দিলে খুব একটা ক্ষতি কখনোই হয়না আর এমন আপত্তিকর অবস্থারও সৃষ্টি হয়না, যার ফলে এক গোত্রপ্রধানকে বলতে হল আমরা আসলে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এত চিন্তা করে নিতে পারেনি। কি জানি সেই সময় হয়তো তিনি এফ এম ব্যান্ড এ টিউন করে তাদের ম্যাডাম কিংবা আপার বক্তৃতা শুনছিলেন। তাই আর চিন্তা করার তেমন সুযোগ পাননি। কতিপয় নাটকীয় এবং আপত্তিকর কিছু ঘটনা ঘটে যাবার পর চিন্তা করার একটু সুযোগ তিনি পেয়েছেন। 

যে প্রবঞ্চনা আর বৈষম্যের মধ্য দিয়ে এদেশের শিশুরা বেড়ে উঠে বিশ্ব আর কয়টা দেশে সেটা হয় জানিনা। শিক্ষার অধিকার শিশুর মৌলিক অধিকার, সেটা হয়তো শিশুরা নিজেরাও বুঝে। সেই জন্যই একই পথ দিয়ে এক শিশু যায় ইংলিশ নিডিয়াম স্কুলে, আরেকজন যায় বাংলা মিডিয়ামে, আরেকজন মাদ্রাসায়। বাড়িতে তারা যখন  তাদের পিতা মাতাকে কেন এমনটি হচ্ছে জিজ্ঞেস করে, তখন তাদের পিতা মাতা কি উত্তর দেয় আমার জানা নেই। শুধু এইটুকু জানি কোন মিডিয়ামে বা কোথায় লেখাপড়া করবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মাতা পিতা। ধর্মপ্রাণ এইদেশের জনসাধারণ ধর্মের সেবা করবার জন্য নিজের সন্তানকে বলি দেয়। তারা কোরবানীর শিক্ষায় শিক্ষিত। লেখাপড়াতো হবে, কিন্তু তার ভেতর দিয়ে যদি আবার ধর্মকর্মও হয় তাহলে মন্দ কি? লেখাপড়া কোন রকমে হলেও ধর্মকর্মতো ঠিকই হবে,অতএব মাদ্রাসাই শ্রেয়।তাদের কাছে হিসাব অতি সহজ, একের ভিতরে দুই। কিন্তু কে তাদের বলে বুঝাবে, দুটো জিনিস একসাথে করতে গেলে কোনটার দেখাই পাওয়া যায়না।  

পিতা মাতা বা অভিভাবকের ইচ্ছায় বলি হওয়া এই সমস্ত শিশুরা নিজের বিচার বিবেচনা দিয়ে একসময় হয়তো বেরিয়ে আসতে চায়। মাদ্রাসা মিডিয়ামেও উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তারা হয়তো বাস্তব বুঝতে শুরু করে। বুঝে ফেলে, পৃথিবী চলছে অন্য নিয়মে। নতুন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে এবার তারা হয়তো স্বপ্ন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার, খুঁজে মুক্তির পথ। একথা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই যে, যদি বিশ জন মাদ্রাসা ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তার মধ্যে আঠারো জনই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত হয়। বছরের পর বছর ধরে মনের ভেতর জমা হওয়া তাদের সেই সংস্কার স্বাভাবিকভাবেই সহজে যাবার নয়। চিন্তা চেতনায় তারা অন্যদের থেকে উল্ল্যেখ করার মত মাত্রায় পিছিয়ে থাকে, তবে মেধার দিক দিয়ে তারা কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু এওতো সত্য যে বিশজনের মধ্যে অন্তত দুই জন নিজের সঙ্কীর্ণতা দূর করে, ধর্মান্ধতাহীন, মুক্তচিন্তার বাস্তব পৃথিবীর সন্ধান পায়। সেই দুইজনের মূল্য কি দিয়ে নিরূপণ করা সম্ভব? সেই দুইজনের জন্য হলেও কি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা যেমন করেই হোক খোলা রাখা উচিত নয়?   

[email protected]

November 03, 2008