তসলিমার জন্য খোলা চিঠি

তুমি ভালো থেকো প্রিয় তসলিমা

প্রিয়তি ভালবাসা

কেমন আছো তসলিমা? জানি তুমি ভাল নেইএকযুগ পেরিয়ে গেছে পরবাসী তুমিতোমার প্রিয়তম জন্মভূমি তোমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেবারো বছরের নির্বাসিত জীবন যাপন শেষে পান্ডবেরাও ঘরে ফেরেতোমার আর ফেরা হয়না 

তোমার প্রিয় ব্রম্মপুত্রের দুই পার জুড়ে এখনো শরতে ফোটে শুভ্রতম কাশফুলেরা বাতাসের দোলায় দোলেসেই বাতাস এসে উজানের ঢেউগুলো ছুঁয়ে যায়, তোমাকে ছুঁতে পারেনাতোমার শহরে আজো দুই বেণী দুলিয়ে হাঁটে কিশোরীরা, দলবেঁধে হুল্লোড়ে মাতে, স্বপ্ন দেখে, ভালবাসেমনে পড়ে তোমার, একদিন তুমিও ঠিক এইভাবে পুরোটা শহর জুড়ে এলোমেলো হেঁটে বেড়াতে আর লাল নীল স্বপ্নে ভাসতে?  

তোমার প্রিয় ফেব্রুয়ারী আজো ঘুরে ফিরে আসেতোমার স্বপ্নের বইমেলাতে চেনা অচেনা মানুষেরা ভিড় জমায়হাত ধরাধরি করে মেলায় হাঁটে তরুণ তরুণীকবিরা আড্ডা দেন গোল হয়ে বসেকবিতার উসব হয়চোখে চশমা এঁটে কবিরা তাঁদের কবিতা পড়েনসেইসব কবিতাগুচ্ছের মাঝ থেকে আর ভেসে আসেনা পরিচিত পক্তিগুলো, ”সাতসকালে খড় কুড়াতে গিয়ে আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে...” 

তুমি নেইকোথাও তুমি নেইযে নারীদের কথা লিখতে তুমি কলম ধরেছিলে, তাদের স্মৃতিতেও তুমি আজ নেইহারিয়ে গেছো, ফুরিয়ে গেছোমাঝে মাঝে একদুইজন প্রগতিশীলতার দাবীদার নারীরা তোমার জন্য লিখেসেই লেখায় থাকে দেশের কাছে তোমাকে ফিরিয়ে নেয়ার অনুনয়তারা বলে, দেশ তোমাকে আবার ফিরিয়ে নিক, আর তারপরে যদি তোমার কোন অপরাধ থাকে, তবে যেন দেশেই তোমার অপরাধের সাজা হয়ভাগ্য বটে তোমার তসলিমা! মানুষের কত করুণা তোমার জন্য! অপরাধ! কি অপরাধ তুমি করেছো তা কি তুমি জানো? তুমি কিন্তু আসলেই অনেক বড় অপরাধী!

স্পর্ধা কত তোমার মেয়ে বাংলাদেশে বসে তুমি ধর্ম নিয়ে কথা বলেছো, নারীর স্বাধীনতার জন্য কথা বলেছোবোকা মেয়ে তুমি, ভিষণ বোকাতুমি কি জানোনা যে এই দেশের নারীরাও আসলে সমতায় বিশ্বাস করেনা, স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনা শিক্ষিত মেয়েরাও মুখে যতই প্রগতির কথা বলুক, বিয়ের পবে সতর্ক থাকে, যেন যোগ্যতায় কোনভাবেই  তারা তাদের স্বামীকে ছাড়িয়ে না যায়কেউ কেউ স্বামীর ইচ্ছায়, কখনো বা স্বেচ্ছায় আপাদমস্তক নিজেকে কালো কাপড়ে মুড়িয়ে ফেলেকোন কোন প্রজাতি আছে, যারা স্বামীর কল্যাণের নামে মাথায় আর সিঁথিতে লাল রঙের সীসা মেখে সঙ সাজেআবার কোন কোন তথাকথিত প্রগতিশীল নারীরা নির্দ্বিধায় বলে বেড়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর কথা যে, ধর্মই সবচেয়ে বেশী সমতা দিয়েছে নারী আর পুরুষেরআজব এক দেশে বসে তুমি যুদ্ধে নেমেছিলে মেয়েতুমি একা একজন, আর তোমার প্রতিপক্ষ গোটা দেশ 

আচ্ছা, তুমি কি ভেবেছিলে যে তোমার চোখে কিংবা সমাজের চোখে যারা প্রগতিশীল, তারা তোমাকে ফিরিয়ে আনবে? হাসালে তুমি! এই দেশে সত্যিকারের প্রগতিশীল বলে আসলে কেউ নেই মেয়ে, কেউ নেইএকটি পর্যায়ে যেয়ে সব প্রগতিশীলেরাই থেমে যায়একটি সীমানার পরে সংস্কারের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গানোর স্পর্ধা আর কেউ দেখায় নাসত্যি বলতে কি, দেখাতেও চায়নাসমাজের প্রগতিশীল মানুষগুলোই আসলে যে সবচেয়ে বেশী ভণ্ড 

এই বিচিত্র দেশে, এই একদল ভন্ড মানুষের দেশে, আর কিছু ধর্মান্ধ উন্মাদ মানুষের দেশে তুমি তোমার হাঁড়ি কলসি উপুর করে যাবতীয় মানবিক সত্যগুলো ঢেলে দিয়েছিলেএবার তুমিই বলতো, এদের কাছে তুমি কি আদৌ ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য? এই দেশে নারীকে ধর্ষণ করে ক্ষমা পাওয়া যায়, সমাজকে ধর্ষণ করে ক্ষমা পাওয়া যায়, মানবতাকে ধর্ষণ করে ক্ষমা পায় মানব নামের দানবেরাকিন্তু এই দেশে ধর্ষিত নারী, ধর্র্ষিত সমাজ কিংবা ধর্ষিত মানবতার পাশে এসে দাঁড়ালে ক্ষমা পাওয়া যায়নাকিছু নোংরা আর উদ্ভট কথার সমন্বয়ে তৈরী যে ধর্মগ্রন্থগুলো, সেই ধর্মগ্রন্থের বিরূদ্ধে কথা বললে ক্ষমা পাওয়া যায়নাআর তাই তোমারও ক্ষমা নেই স্পর্ধিতা মেয়েএদেশের মানুষ কখনোই তোমাকে ফিরতে দেবেনা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নোংরামি আর ভন্ডামি দিয়ে সাজানো গোছানো একটি অন্ধকার দেশে একজন আলোকিত তসলিমার কোন স্থান নেই 

যদিও জানি, তোমার ভেতরের তুমিটা আজো প্রত্যেকটি সূর্যোদয়ের মুহুর্তে মনে মনে ব্রম্মপুত্রের জলে ভোরের আকাশ দেখে, এখনো খুঁজে বেড়ায় খড়কুটো স্বপ্নগুলো

ভাল থাকো মেয়ে তুমি তোমার ভূবনে 

২৩ শে অগ্রহায়ণ, ১৪১৪