জীবন ও মূল্যবোধ
মোহাম্মদ রাহীম উদ্দিন
মানুষের কি মূল্যবোধ আছে? যদি থেকে থাকে, তাহলে মূল্য ও নিশ্চয় আছে। কত?
আমরা কি পরাধীন? নাকি অদৃশ্য কোন শৃঙ্খলে বন্ধি? সমাজ, রাষ্ট্র, ভাগ্য বিধাতা কিংবা জীবন ব্যবস্থার এত ভিন্ন রুপ কেন!? একেক জায়গায় তাদের একেক নিয়ম ব্যবস্থা।
মায়ের গর্ভ থেকে যে শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই মাকে হারায় (বাবা তো তার পালিয়েছে অনেক আগেই) কিংবা যে সৃষ্টির সেরা জীব খেচরের মত বুকে ভর দিয়ে জীবন চালায়, ভীক্ষা করে তাদের প্রতি জীবন ব্যবস্থা বা ভাগ্য বিধাতার সংজ্ঞা আমার জান্ ানেই। তবে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ হতে পারে বর্ণিত।
ও ছেলেটি কার?
যার মা গেছে মরে,
বাবা যার পঙ্গু হয়ে
থাকে বসে ঘরে !
(২)
To eat it, you have to earn a million a month...!‘‘আমি দেখেছি অনেক গগণ চুম্বি অট্রালিকার সারি
তার ছায়াতে দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী...।”
আমি ও দেখেছি চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে অবস্থিত ডাস্টবিনটির পাশ দিয়ে প্রবাহমান নালা থেকে টিনের কৌটা দিয়ে দূষিত, আবর্জনা মিশ্রিত পানি পান করতে। না, কোন চতুষ্পদ জন্তু নয়। দু’পেয়ে জন্তু (!?)। কি অবিচল, কি শান্ত, যেন এক্কেবারে ছোট্ট বেলার পাঠশালার বন্ধূর বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার পর ভাল হজমের আসায় এক গ্লাস কোক খেল। যদিও আমি তাকে দেখেছি প্রথমে সে ওই ডাষ্টবিন থেকে পঁচা অবশিষ্টাংশ কুড়িয়ে খেয়েছে। আমার তখন মনে হচ্ছিল ঔই এলিটদের ভবনের প্রতিটি ইট ও বালূকণা উপহাসের হাসি খিলখিলিয়ে হাসছিল আর কুড়িয়ে খাওয়া ঔই অভদ্র লোকটির প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করছিল। একি জীবনব্যবস্থা, না সমাজ ব্যবস্থা? ভাগ্য বিধাতা এখানে কোথায়? আমারা যে সমাজের কিংবা যে সমাজ আমাদের তার ভুমিকা আমি এখনো খুজি বেড়াই।
(৩) বোধের অপরাধ(!?)
বোধ আছে বলেই এর উদয় হয়। আর বোধোদয় হয় বলেই আমরা অপরাধ বুঝতে পারি, বুঝতে পেরে তা মোছনের চেষ্টা করি। কোরবানির সময় গরু কিংবা কালি পঁজার সময় পাঁঠা জবাই করি পাপ মোছনের জন্য, পূণ্য হবে , মানুষ পাপমুক্ত হবে বলে(!)। কিন্তুু মানুষ জবাই করি কার পাপ মোছনের জন্য? নিশ্চয় রাষ্ট্র বিধাতা কিংবা ভাগ্য বিধাতার পাপ মোছনের জন্য। কুফরির জন্য গরু/ছাগল এর মত মানুষকে ছুরি দিয়ে হত্যা করা, অপরাধি বলে ক্রসফায়ারের গল্প বলা কিংবা কোন প্রাণীকে কোন উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া কোন রাষ্ট্রের, কোন সমাজের, কোন জীবনের বিধান হতে পারে কি না আমার সন্দেহ।
(৪)
বিধাতার উপহাস!
রইসুদ্দিনের বস্তির পাশের আবাসিক এলাকার মসজিদটিকে সুসজ্জিত করা হয়েছে ছয়টি এয়ার-কন্ডিশনার এবং প্রতি তিনজনের জন্য একটা করে ফ্যান ও দামি ঝাড়বাতি দিয়ে। মেঝে থেকে শুরু করে পিলার, দেয়াল ও ছাদ সবই দামি টাইলস্ দিয়ে বাঁধানো। এরপর ও গত শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে রইসুদ্দিনের সামনে মসজিদের আরও উন্নয়নের জন্য যখন দান বাক্সটি এল তখন রইসুদ্দিনের মনে পড়ে যায় গত বছর শীতে করিমের ছোট্ট মেয়েটি মারা গেছে গরম কাপড়ের অভাবে। ঠান্ডায় একেবারে বরফ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি। পুরো মূখ লাল হয়ে গিয়েছিল মেয়েটির। এইতো এবছর চালের কেজি ২১ টাকা, আলুর কেজি ২৮ টাকা হওয়ায় ভাল করে দুবেলা ভাত খেতে না পেরে পরলোক গমন করলেন জসিমের বুড়ো মা। অন্যের কথাই বা কেন ? স্বয়ং রইসুদ্দিনের ঘরের চালাটাই গত তিনবছর ধরে নুয়ে আছে ঝুঁকি নিয়ে সংস্কারের আশায়। রইসুদ্দিন ভাবছে বিধাতার একি উপহাস!
দিন মজুর সৈকতদের পাড়ার র্দূগা মন্দিরেও মা র্দুগতিনাশিনী সৈকতদের র্দূগতির জন্য দামি শাড়ি, সোনার অলংকার, মোটা-মোটা বালা পরে ডজনখানেক মোমবাতি জালিয়ে, নিজের অন্ধকার দুর করে আর বসেবসে উপহাসের দৃষ্টিতে পাথরের মত তাকিয়ে থাকে পাড়াবাসির র্দুগতির দিকে।
গির্জার ক্ষেত্রে এই উপহাসের দৃষ্টান্ত আরও তীব্র। মায়ের কোলে প্রভু যীশূ পরম আনন্দে, পরম মমতায় ঠিকই শুয়ে থাকে। কিন্তু আমেনার পাঁচ বছরের ছেলেটি ইট ভাঙ্গে সিকান্দারের ব্রিক ফিল্ডে।
(৫)
‘‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি
তার ভিতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে...।”
কল্পনা করা যাক একটি ঘটনা:
দিনের পর দিন মানুষের পিছনের দিকে লেজ গজাচ্ছে দেখে কুকুর গুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা ভয় পাচ্ছিল তারা ও কি তাহলে বিপরীত প্রক্রিয়ায় দিনদিন মানুষ বনে যাবে কিনা। ছি:, কি লজ্জা ! ভয়ে, লজ্জায় তারা সবাই গেল ভাগ্য বিধাতার কাছে। সভা হল, হল অনেক চেঁচামেচি। প্রতিবাদ করা হল এবং সমাধান চাওয়া হল এইরুপ বিরুপ প্রতিক্রিয়ার। কিন্তু হতাশ ও নিরাশ বিধাতার একটাই উত্তর: “ আমি ও তো ভাবছি মানুষগুলোর লেজ গজালো কোথা থেকে!”
(৬)
আমরা জাতিতে সেরা,
আমাদের রক্তক্ষয় সেরা,
আমরা পুরস্কারেও সেরা,
কিন্তু আমাদের মনষ্যত্ব, কেরাবেরা !
আমাদের সবকিছুতেই চাই সেরা, চাই সেরা খাদ্য, সেরা কাপড়, সেরা ঘুষ, সেরা ভুঁয়া খ্যাতি এবং সর্বপরি সেরা দূর্নিতী। কিন্তু ভাবুনতো, ফুটফুটে গোলাপের ন্যায় একটি বাচ্চা মেয়ে যদি তার কচি চাহনিতে অথচ নোংরা ভূষণে আপনার কাছে আপনার ঘরের বাসি কিংবা পঁচা কোন খাবার চায় তাহলে আপনার সেরা সেরা খ্যাতি গুলো কোথায় যাবে? আপনার পৃথিবীখ্যাত সেরা পুরষ্কারটি কি কেরাবেরা হবে না?