বেয়াদপি করিলে তকদিরে পোকায় ধরিবে...
রণদীপম বসু
[০১]
ইহা অলিআউলিয়াগণের স্থান। এইখানে যে বেয়াদপি করিবে তাহার তকদিরে পোকায় ধরিবে। সব্বনাশ, এ কোথায় এলাম ! ভেতরে ভেতরে রোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠতে লাগলো। ভীষণ কৌতূহল নিয়ে বিশাল বোর্ডে অঙ্কিত লেখাগুলো অনুসরণ করতে লাগলাম। নিম্নলিখিত কারণগুলি চরম ও জঘন্য বেয়াদপি বলিয়া গন্য হইবে।...
সম্ভবত উনিশশো ছিয়াশির মাঝামাঝি বা শেষের দিকে। সেশন শেষ, কিন্তু পরীক্ষার খবর নেই। ছাত্রজীবনের বিদায়লগ্নে এসে না ঘরকা না ঘাটকার মতো এরকম অদ্ভুত অবস্থায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিব্যি ঘুরছি ফিরছি আর ডুগডুগি বাজাচ্ছি। চিটাগাং ইউনিভার্সিটির পাহাড় টিলা বন বনানী ঝোপ জঙ্গলের প্রাকৃতিক আদিমতার সাথে বনাবনি খুব একটা খারাপ ছিলো না বলে নিজেকে নিজের পূর্বপুরুষ ভাবতেও যে এতো চার্ম, ওটাই ঝালিয়ে নিচ্ছি এই সুযোগে। এছাড়া ছাত্র হিসেবেও বিশেষ গোত্রের কিনা, তাই পরীক্ষা যতক্ষণ না দরজায় এসে লাথি দাগাতে শুরু করে লেখাপড়ার মুডই যে ওঠে না ; এতে আমারই বা দোষ কোথায় ! তারচে’ বরং সন্ধ্যা থেকে কমনরুমে জাতীয় সংগীত বেজে না ওঠাতক বিটিভিকে সঙ্গ দেয়া। তারপর হল থেকে বেরিয়ে চা-দোকানের ঝুপড়ির মৃদু আলোয় কুঁজো হয়ে নির্বিকার বসে থাকা কল্কিধারী দোস্তদের অত্যন্ত মহৎভাবে অভয়দান করা, অথবা হাওয়াইন গিটারসহ ভীষণ সংস্কৃতিবান বন্ধুকে নিয়ে শুক্লপক্ষের মধ্যরাতে শীতের কুয়াশা ভেঙে আধাকিলো দুরের খোলা মাঠে চাঁদের আলোয় বসে সর্বশক্তি দিয়ে কোন মহতি সুর সাধা, এবং আশেপাশে এদিক ওদিক থেকে অত্যন্ত সমিল কণ্ঠে সঙ্গ দেয়া শেয়ালের হুক্কাহুয়াকে শ্রোতাদের অমূল্য স্বীকৃতি ভেবে আত্মতৃপ্তি নিয়ে শেষ রাতে হলে ফিরে দিনের বারোটা পর্যন্ত সময়কালকে প্রভাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। এরকম সৃজনশীল কর্মকান্ডে ক্লান্তিহীন নিয়োজিত থাকতে দেখেই অতীব তুষ্ট হয়ে কি না কে জানে, জনৈক দ্বিতীয় পর্যায়ের বন্ধু অর্থাৎ বন্ধুর বন্ধুর কাছ থেকে প্রস্তাব এলো যে আমাকে তারা তাদের এক তীর্থযাত্রায় বেয়ারিং ভ্রমনসঙ্গি করতে চায়। তাও যে সে তীর্থ নয়। একেবারে আটরশি ! যার সানুগ্রহে এরা যাচ্ছে তিনি হলেন ফরিদপুর আটরশির বিখ্যাত পীরহুজুর বাবা কেবলাজানের একজন একনিষ্ঠ মুরিদ। কিন্তু এই তরিকায় আমাকে কোন্ যোগ্যতায় অন্তর্ভূক্ত করা হলো তা এক বিরাট ধাঁ ধাঁ হয়ে গেলো আমার কাছে। স্বভাবে ছন্নছাড়া বাদাইম্যা গোছের হলেও সেই বালক জীবনে ‘আউট বই’ পড়ে সীমা অতিক্রম করে ফেলায় ধর্মশাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের চোখে যার কিনা ‘স্বভাবচরিত্র ভালো তবে ধর্মে কর্মে মতিগতি কম’ খেতাবটাও পরবর্তীতে অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেছে, সেই আমাকে এমন প্রস্তাব ! অত্যন্ত অবমাননাকর বিবেচনা করে এক কথায় উড়িয়ে দিতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখা গেলো আমার সেই ফুলটাইম কল্কিধারী মেধাবী দোস্তসহ আরো দুজন বেদ্বীন ছাত্র ইতোমধ্যেই এই যাত্রার সফরসঙ্গি নির্বাচিত হয়ে আছে। অতএব বিষয়টা পুনঃবিবেচনার দাবি রাখে বৈ কি। এবং অনতিবিলম্বে একদিন আমার পরিচিত কেউ এমন কি হলের রুমমেটও জানলো না যে আমি ক্যাম্পাসে অপেক্ষমান রিজার্ভ করা চেয়ারকোচটাতে কখন কোন এক তাৎক্ষণিক মুহূর্তে এক কাপড়েই চড়ে বসেছি। সেলুলার নামক যে অদ্ভুত বিস্ময়কর পদার্থটা আরো বেশ কিছুকাল পর দেশে একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করে গোটা বিশ্বটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে, তার নামনিশানার খোঁজও তখন আমরা জানি না বা কশ্মিন শুনিও নি। অতএব হলের বন্ধুদের কাছে কোন অজ্ঞাত কারণে আমি আকস্মিক নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম !তেইশজন যাত্রি নিয়ে গাড়িটা চট্টগ্রাম শহরের দিকে ছুটলো। বাকি সীটগুলো খালি। শহর থেকে নাকি আরো যাত্রি উঠবে। কিছুক্ষণের মধ্যে হালিশহরের একটা সম্ভ্রান্ত এলাকায় নিয়ে এলো আমাদের। আগে থেকেই এখানে আরেকটা বাস দণ্ডায়মান। মাঝারি সাইজের একটা তাবুর নীচে অনেকগুলো চেয়ার জুড়ে বসে আছেন অধিকাংশই চকচকে চেহারার হুজুরগোছের মান্যগন্য ধরনের ব্যক্তিবর্গ। এদের কেউ কেউ যাত্রি হবেন, বাকিরা এসেছেন কুশল বিনিময় করতে। একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তুত। নির্ধারিত ফ্যাটের বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসে তো চোখ ছানাবড়া ! খাওয়া দাওয়ার এ কী আলীশান ব্যবস্থা ! বহুদিন এমন উন্নত ও সুস্বাদু খাবার খাই নি। এথলেট শরীরের চাহিদা অনুযায়ী বেশ তৃপ্তিসহকারে খেয়ে নিলাম।
[০২]
বিকেল মজে এলে এক সাথে দুটো বাসই ছাড়লো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তবে তার আগেই খালি সীটগুলো নতুন যাত্রিতে পূর্ণ করা হলো। কিন্তু এতো বড়ো আয়োজনের আয়োজক যিনি, মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, অন্য গাড়িটার আল্লাহওয়ালা বয়েসী যাত্রিদের সঙ্গি না হয়ে আমাদের গাড়িতেই এই অধিকাংশ নাবাল ছাত্রদের ভ্রমনসঙ্গি কেন হলেন তা আশ্চর্যের নয় কি ? তাঁর চেহারা দেখে হতাশও হলাম, একই তরিকার অন্যান্য বেয়ারিং যাত্রিদের তেলচকচকে উজ্জ্বল চেহারার তুলনায় তাঁর চাকচিক্যহীন চেহারায় মালিন্য দেখে। গাম্ভীর্যহীন হাসিখুশি মুখের আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে তাঁকে ভালো লেগে গেলো ঠিকই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে এরকম একজন লোক কী করে বছরে দুবার এতো বড় আয়োজন নিয়ে পীরবাবার দরবারে যান, এর সপক্ষে কোন যুক্তি অন্তত আমার মাথায় এলো না। আরো কতো বিস্ময় যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে তা কি আর জানি ! অবশ্য এটা জানতে বিলম্ব হলো না যে, ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সহায় সম্পদে উন্নতি পীর বাবা কেবলাজানের দয়ায় খুব কম নয়।যাত্রাশুরুর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে গেছে। শা শা বাতাসকাটা গুঞ্জনের মধ্যে গাড়ির ভেতর একটা অদ্ভুত নীরবতা ঘুরঘুর করছে। ঘুমঘুম ভাব নিয়ে জানলা দিয়ে সন্ধ্যার আবছা আঁধার মাপছি। হঠাৎ একটা গল্পের গুঞ্জন কানে এসে ধাক্কা মারলো। বয়ানে বুঝা যাচ্ছে এটা অলৌকিক ঘটনা।
‘তখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী আমি। বাঁচার আশা প্রায় শেষ। কোন ডাক্তার আর বাকি নেই। ডাক্তারদের সব ব্যবস্থাপত্রও ফেইল। চরম হতাশা বুকে নিয়ে ঘুম কি আর আসে ? মৃত্যুর প্রহর গুনছি। হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম ফেরেশতার মতো চেহারার একজন আউলিয়া ধবধবে সাদা চুল দাঁড়ি, আমাকে বলছে, তোর তো কিছু হয়নি। ভালো হয়ে গেছিস। চলে আয় আমার কাছে। ঘুম ভেঙে গেলো। যে শরীরটাকে নাড়াতেই প্রাণটা বেরিয়ে যেতো, দিব্যি উঠে বসলাম ! কিন্তু কে তিনি ? পরদিন সবাইকে বললাম। চেহারার বর্ণনা দিলাম। কেউ বলতে পারলো না। অবশেষে বাবার মুরিদ একজন, আমার কথা শুনে বললেন, তুমি আটরশির পীরবাবার দরবার থেকে একবার ঘুরে আসো। চলে গেলাম আটরশিতে। হুজুরকে দেখেই আমার কী যেনো হয়ে গেলো ! এই তো তিনি ! সাথে সাথে তাঁর পায়ে পড়ে গেলাম, বাবা আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আজ থেকে আমি আপনার গোলাম।’ধীরে ধীরে নৈঃশব্দের ভার কমে আসতে লাগলো। ভদ্রলোক এবার তাঁর এই অলৌকিক ঘটনার সপক্ষে আরো বললেন, বাবা তাঁর প্রত্যেক মুরিদকেই এরকম একেকটা অলৌকিক কাণ্ড দেখিয়েছেন। এক্কেবারে সাক্ষাৎ আউলিয়া তিনি ! পাশের অন্য কয়েকজন মুরিদও দেখি তার এই কথায় সায় দিয়ে ওঠলেন।
মানুষ স্বভাবগতভাবেই যুক্তিশীল। যুক্তি মানুক বা না মানুক, অবচেতনে এই যুক্তিবোধই মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। যদিও কখনো কখনো বিশেষ কোন অবস্থায় এই যুক্তি আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর এই বিশেষ অবস্থার স্থায়িত্বকাল কারো স্বল্প, কারো বা দীর্ঘ। আবার কারো কারো সারাজীবন এই আচ্ছন্নতা থেকে যায়। কেন তা হয় বা হয় না, এই যুক্তিচর্চা আমার এখনকার বিষয় নয়। হাঁ এবং না, এ দুটোর মাঝামাঝি কোন অর্থবহ শব্দ যেমন বাংলাভাষায় নেই, তেমনি পরস্পরবিরোধী দুটো বিষয় একই সাথে সত্য হতে পারে না। আমার নিজস্ব অদ্ভুত খেয়াল দিয়ে এই কাহিনীটাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করলাম না। ভুলে যেতে চাইলাম। কখনো কখনো ভুলে যাওয়াটাও স্বাস্থ্যকর বৈ কি ।মাঝরাতের দিকে ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি ছ’তলা বাড়ির সামনে এসে আমাদের যাত্রা বিরতি হলো। ষষ্ঠ তলার চকচকে ফ্ল্যাটটাতেই আমাদের থাকার আয়োজন। যদিও এতোগুলো লোকের জন্য অপর্যাপ্ত, তবু এটাই বা আশা করেছে কে ? নীচের আরেকটা ফ্যাটে খাবারের ব্যবস্থা। এবার রাতের খাবার দেখে তো আক্কেল গুড়ুম ! এতো হাই ফাই ! বুঝতে পারছি না, এই আড়ম্বরের উদ্দেশ্য এবং উৎসটা কোথায়। চিটাগাংএর হালিশহরের সাথে ঢাকার ইন্দিরা রোডের লিঙ্কটাই বা কী ? শ্রান্ত মন আর ক্লান্ত শরীরে এতোসব ভাবাভাবি বাদ দিয়ে হামলে পড়লাম। খাবার আর শরীরের ভার এক করে ফিরে এসে দেখি, আরেব্বাশ, রুমের মেঝে সব নতুন নতুন তোশক আর দামী বেডশীটে আবৃত হয়ে ঝকমক করছে ! পরম প্রীত হয়ে বিড়ি টানার তুমুল অভ্যেসটাকে ঝালাই করতে ছাদে চলে গেলাম। প্রথমেই চোখ পড়লো সংসদ ভবনটার দিকে ! প্রশস্ত ছাদ থেকে হাতের কাছেই যেন, বিশ্ব-খ্যাত স্থাপত্যশিল্পী লুই কানের গড়া আমাদের সংসদ ভবনটি তার গোটা এলাকাসহ রাতের আলোয় ঝলমল করছে। এই প্রথম আমার এতো কাছে থেকে সরাসরি সংসদ ভবন দেখা। এর আগে দু-একবার ঢাকায় এলেও রাতের ঢাকাকে দেখার সুযোগ হয়নি। খুব ভোরে আবার গাড়িতে উঠতে হবে। তাই বেশিক্ষণ ছাদে থাকা হলো না। রুমের লাইট অফ। জানলার কাচ ভেদ করে বাইরের আলো রুমটাকে হালকা তরল আলোয় ভরিয়ে রাখলো। এতোগুলো লোক রুমে, তবু কেমন নীরব স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব একটা। কোথাকার কোন্ ভালোলাগায় ঘুম আসছে না আমার। জানলার পাশে ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে আশপাশগুলো দেখছি। হঠাৎ করে অজান্তেই সাক্ষী হয়ে গেলাম পাশের ফ্যাটের ডিমলাইটের গলন্ত আলোয় মিশে থাকা যুগল দৃশ্যের। আহা, তারুণ্যের চোখে যাকে আমি পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য হিসেবে বিবেচনা করতে ভালোবাসি।
[০৩]
অতি ভোরে ঘুম ভাঙানো হলো। শার্টপ্যাণ্ট পরা এক কাপড়ে গা ঝাড়া মানুষ। আলাদাকরে কাপড় পাল্টানোর দায় নেই। গাড়িতে উঠার আগে প্রাতের হোটেল থেকে যে যার মতো নাস্তা সেরে নিলাম। ঢাকা ছাড়লো গাড়ি। চূড়ান্ত পর্যায়ের জার্নি। প্রায় সবার মধ্যেই দেখছি একটা আধ্যাত্মিক ভাব চলে আসছে। আড়চোখে সেই দোস্তটির দিকে তাকালাম। মলিন মুখ। বড় ভুল হয়ে গেছে তার। চট্টগ্রাম ছাড়ার পর থেকেই খেয়াল করছি, পীর-ফকিরের আখড়ায় যাচ্ছে ভেবে যে উৎসাহ নিয়ে গাড়িতে উঠেছিলো, ফলাফল হয়ে গেছে উল্টো ! উৎফুল্লতার ধোঁয়াবঞ্চিত আমার দোস্তের অবিরাম হাসিখুশি থাকার অটোস্বভাব কেমন মিইয়ে এসেছে। যাত্রিরা সবাই যে একেকজন কৃচ্ছতার অবতার ! আহা, কখন যে ভ্রমন শেষ হবে তার ! কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে গেলো গাড়িফাটানো জিকির-আশকার। ফাঁকে ফাঁকে পীর বাবাকেবলাজানকে নিয়ে রচিত গানের সুরে টান দিচ্ছে কেউ, সাথে দোহা ধরছে অনেকেই। এক সময়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাবা ছাড়া জগতে আর কোনো ঠাঁই নেই ! এরকম ঘটনার পেটের মধ্যে থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম, এবং এটাই শেষ। নীরব শ্রোতা ও দর্শক হিসেবে বেশ উপভোগ করছি আমি। আরিচা থেকে দৌলতদিয়া ফেরি পার হয়ে জিকিরের তেজ বেড়ে গেলো আরো।ফরিদপুর শহরের সুবিধাজনক স্থানে এসে গাড়িটা থেমে গেলো। আয়োজক ভদ্রলোক জনাকয়েক সতীর্থ ভক্ত নিয়ে নেমে গেলেন। আটরশি আর দূরে নেই। সম্ভবত আঠারো মাইল। গাড়ির জানলা দিয়ে প্রথম দেখার চোখ দিয়ে শহরটা দেখছি। কেমোন যেন মলিন মলিন মনে হলো। লোকজনের জীবনযাত্রার মান হয়তো খুব উন্নত নয়। বাড়ি ঘর দোকানপাট সবকিছুতেই এই মলিনতার ছাপ। এবার দেখি মণে মণে মালামাল এসে গাড়ি বোঝাই হতে লাগলো। বিরাট বিরাট মানকচু, মিষ্টিকুমড়া, আলু, চাল, পাঁঠা ছাগল ইত্যাদি ইত্যাদি কত কিছু ! বোঝা গেলো, বড় শক্ত লিঙ্ক। আগে থেকেই কেনা হয়ে আছে এগুলো। আর সাথে সাথে আমার মাথাটাও বোঝাই হতে থাকলো আবোলতাবোল কত্তোরকমের নীরব প্রশ্নে। এর উত্তর আদৌ কখনো পাবো কিনা জানি না।
দক্ষিণাঞ্চলগামী মূল সড়ক থেকে নেমে সরু একটা রাস্তা ধরে গাড়িটা মন্থর গতিতে এগিয়ে যেতে থাকলো। যেখানে এসে থামলো, ওখান থেকে হুজুরের দরবার বেশি দূরে নয়। হেঁটে যেতে হবে। বাঁশের তরজায় তৈরি কতকগুলো ছোট ছোট দোকানপাট, ঝুপড়ির মতো। ফটক পেরিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে আরো ভেতরে। বেষ্টনিঘেরা বিশাল তল্লাট ফাঁকা প্রায়, কোন বাড়ি ঘর চোখে পড়ছে না। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে দরবারের মূল গেট। ঠিক বিপরীতে ছোটখাট মাঠটার পরেই বহুতল বিশাল মাদ্রাসা। মাঠের মাঝামাঝি চওড়া গোলাকার পাকা করা হেলিপ্যাডটা দেখে কৌতূহল জাগলো। তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈর-রাষ্ট্রপতি হো:মো:এরশাদ কেবলা হুজুরের পেয়ারের মুরিদ জানতাম। এবং তার দেখাদেখি সাঙ্গপাঙ্গ আমলা ব্যবসায়ী সুবিধাভোগী অনেকেই যে এই তরিকা গ্রহণ করেছেন তখন, তারই নমূনা হয়তো এটা।
মাদ্রাসার তৃতীয় তলার বিশাল একটা কক্ষের মেঝেয় আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা এবং রাতের থাকাও। আদৌ এখানে লেখাপড়া হয় কিনা জানি না। হয়তো এটা মাদ্রাসাই নয়। মাদ্রাসার আদলে মূলত দেশবিদেশ থেকে আসা হুজুরের মুরিদানদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। ওদিকে গাড়ি আনলোড করে মালামাল সব ভ্যানে করে হুজুরের দরবারে পাঠানো হচ্ছে। এখানকার ভাষায় এ-কে নজরানা বলে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মধ্যদুপুরের ক্লান্তি কাটিয়ে মূল দরবারের দিকে যাবো আমরা। মূল দরবার এলাকাও বিশাল। জুতো নিয়ে এলাকায় ঢোকার বিধান নেই। মাদ্রাসায় জুতো রেখে সবাই নগ্নপায়ে রওয়ানা দিলাম। স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে সম্পর্কের আদানপ্রদান কেমন বোঝার উপায় নেই। তবে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোকজনের আসাযাওয়া। কাউকেই খালি হাতে দরবারে ঢুকতে দেখিনি। একটা কুমড়া বা কচু বা লাউ বা মুরগী বা ছাগল গরু যার যা সাধ্য ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসপত্রের নিয়মিত প্রবেশমুখি স্রোত লেগেই আছে। কী আশ্চর্য, এতো মালামাল যায় কোথায় !দরবারের ফটক পেরিয়ে ছিমছাম পাকা রাস্তা ধরে কিছুদূর আগালেই দরবার শরীফের গায়ে লেগে দুভাগ হয়ে রাস্তাটা দুদিকে চলে গেছে। দুদিকে দুটো ভবন। মাঝখানদিয়ে ভেতর এলাকায় যাওয়ার রাস্তা। ডান দিকের ভবনটাই হুজুরের দরবার শরীফ। এর গঠনগাঠনই অন্যরকম। রাস্তা ধরে নবাগত কেউ দরবারে ঢুকেই আমার মতো নাবালের জন্য প্রথমেই যে সতর্কবাণী বিশাল বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে তা তো শুরুতেই বলেছি। হকচকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ! ইহা অলিআউলিয়াগণের স্থান। এইখানে যে বেয়াদপি করিবে তাহার তকদিরে পোকায় ধরিবে। নিম্নলিখিত কারণগুলি চরম ও জঘন্য বেয়াদপি বলিয়া গন্য হইবে। এরপর নীচে দীর্ঘ তালিকা। খুব সম্ভবত ছাব্বিশটি। প্রায় দুযুগ আগের স্মৃতিতে এগুলো থাকা উচিৎ ছিলো। বেয়াদবি বিষয়ক গবেষণায় যথেষ্ট উপকারে আসতো। কিন্তু আমার নাবাল স্মৃতি সে সুযোগ নিতে পারলো না। ক্রমান্বয়ে উল্লেখ করা বেয়াদপির নমূনা ও উপসর্গগুলো পড়তে পড়তে ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে ওঠছি। জোরে কথা বলা, শব্দ করিয়া হাসা, দাঁত দেখাইয়া রাখা, যত্রতত্র থুথু বা বর্জ্য পদার্থ ফেলা, দুই হাত ভাঁজ করিয়া রাখা বা দাঁড়ানো, খাবার মাটিতে ফেলা, দরবারের জানালা দরজা দিয়া উঁকিঝুকি মারা, নির্দেশিত নিয়ম মান্য না করা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেককিছু। কিন্তু নির্দেশ মনে না রাখাটাও যে একধরনের বেয়াদপি, ওখানে তা লেখা ছিলো কি না মনে করতে পারছি না। তবে নির্দেশই যদি মনে না থাকবে, মেনে চলা কী করে ? আমি কি বেয়াদপি করছি ? নির্দেশনামা পড়তে পড়তে হঠাৎ খেয়াল হলো আমি হাতদুটোকে রীতিমতো পেছনে ভাঁজ করে দিব্যি ফুলবাবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ! তাড়াতাড়ি হাতের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে দুপাশে সটান ঝুলিয়ে দিলাম। এদিক ওদিক মাথায় ও কোমরে গামছাবাঁধা বিশাল ভুড়িঅলা পাণ্ডাগুলো যেভাবে ঘুরাফেরা করছে, এই যদি বেয়াদপ বলে ধরে এসে ? এখানে নাকি তাদের কথাই আইন। ঘাড় ধরে বের করে দেবে। এতে আরেক সমস্যা দেখা দিলো এবার। বেআক্কেলের মতো হাত দুটো দুপাশে জগরদভের মতো ঝুলে পড়ে নিজেকেই কেমন বেআক্কেল বেআক্কেল লাগছে।
হঠাৎ করে উদ্বৃত্ত হয়ে পড়া হাতদুটোকে নিয়ে এই অবস্থার মধ্যে আরেক উপসর্গ আবিষ্কার করে আরো জবুথবু অবস্থা আমার। হে হে মার্কা মুখে কোদাইল্যা দাঁতগুলো সারাক্ষণ কেলিয়ে থাকার চিরায়ত স্বভাব। এখন কী করি ? একটাই উপায়। ঠোঁটদুটোকে জোর করে সংযুক্ত রেখে মুহূর্তের জন্যেও অসতর্ক বা অসচেতন না হওয়া। একে তো বেদ্বীন, তার উপরে বেয়াদপি, নিজেকে সংযত করার সাধ্যাতীত প্রচেষ্টার ফলাফল নিজের চেহারায় নিজে দেখার তো কোন উপায় নেই। অকস্মাৎ কোত্থেকে আমার দোস্ত এসে হাজির। কী হয়েছে তোমার দোস্ত ! তার চোখে উৎকণ্ঠা। আমি ততোধিক আশ্চর্য, কই, কিছু না তো ! চলো চলো, খেতে ডাকছে। খেয়াল হলো, দুপুরে খাওয়া হয়নি এখনো। শুক্রবার জুম্মাবার হওয়ায় দরবার শরীফের সামনে বিশাল এলাকাজুড়ে টিনের চালার নির্ধারিত স্থানটিতে সবাই নামাজ আদায়ে যাওয়ায় আমি অলস সময়টা এভাবেই ব্যয় করছিলাম। নামাজ শেষ। এখন খাবার পালা। দরবার ভবনের পাশ ঘেষে দুই ভবনের মাঝে দিয়ে ঢুকে ভেতরেই খাবারখানা। ঢুকার পথে ডান পাশে দরবার ভবনের দেয়ালে কয়েকটি কাউণ্টার। ওখান থেকে অত্যন্ত স্বল্প হাদিয়ায় খাবারের টিকিট নিতে হয় আগে। আয়োজক ভদ্রলোকের কল্যাণে আমাদের টিকিট একত্রে কাটা হয়ে গেছে। খাবারখানার দিকে যাওয়ার পথে ডানের সুরম্য দরবার ভবন ঘেষে একটা বাঁধানো কবর। তার গায়ে উৎকীর্ণ সতর্কবাণী, কবর জেয়ারত করা নিষেধ।
খাবারখানা মানেই স্বল্পপরিসরের একটা বারান্দার মতো কক্ষে শত শত বা হাজারও হতে পারে, মাটির সানকি উপুর করে রাখা। ওখান থেকে একটা তুলে নিয়ে মেলে ধরো। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশালদেহী পাণ্ডাব্যক্তিটি একটা বড় হাতা দিয়ে তাতে এক হাতা ভাত এবং একহাতা ডাল ও লাবড়া বা অন্য কোন আইটেম ধাম করে ঢেলে দেবে। এবার মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে ওগুলো মিশিয়ে গপাগপ গিলে ফেলা। খেতে বসে একদুটা ভাত মাটিতে পড়লে তা আবার সানকিতে তুলে নেয়াসহ এই সিস্টেমটা মন্দ লাগেনি আমার কাছে। এখানে দিনে একবেলাই সর্বসাধারণের খাবারের এই আয়োজন হয়ে থাকে। গরীব ধনী উচু নীচু কোন ভেদাভেদ নেই বলেই জানানো হলো আমাদেরকে। শুনে প্রীত হলাম। আবার ভাবলাম সত্যি কি তাই ? খাবার শেষে পাশের টিউবওয়েলে ধুয়ে নিয়ে সানকিটা জায়গামতো রেখে দিয়ে আসতে হয়। এরইমধ্যে খাবারপর্ব শেষে আমাদেরকে জানানো হলো, ঘণ্টাখানেক পর দরবারের বিশেষ গাইডের সহায়তায় আমাদেরকে দরবার শরীফের উল্লেখযোগ্য এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হবে। আপাতত বিশ্রাম।
অধিকাংশই মাদ্রাসায় চলে গেলো। কিন্তু আমার মধ্যে তখন ভর করেছে অদম্য কৌতূহল। যারা নিজ নিজ বিশ্বাস থেকে এখানে পবিত্র ভ্রমনে এসেছেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু আমার যে বিশ্বাসবোধে ঘাটতি রয়েছে ! তাছাড়া দরবারে প্রবেশ করাতক একটা বিষয় আমার চোখ এড়ায়নি, দামী দামী কারগুলো সরাসরি এদিকে ঢুকে পাশের ভবনের সামনে সারি সারি পার্ক করে তা থেকে যে সুবেশি মুরিদানরা ভারী ভারী ব্রীফকেস হাতে বেরিয়ে আসছেন, সরাসরি দরবার শরীফের একটি বিশেষ কক্ষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন খালি হাতে, বেশ কিছুক্ষণ পর। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে ফের ফিরতি পথে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো। আমি একা একা এই বিরতিকালটা এদিক ওদিক ঘুরঘুর করতে লাগলাম। হঠাৎ গোটা এলাকা জুড়ে অসংখ্য মাইক সচল হয়ে ওঠলো। স্থায়ী স্থাপনার উপর বিশেষভাবে সেট করা মাইগুলোতে কেবলাহুজুরের বয়ান বর্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ হুজুরকেবলা দরবারে তসরিফ নিয়েছেন এবং দর্শনার্থীদেরকে দর্শন ও দোয়া দিচ্ছেন। বিশেষ কোন জরুরি কাজে জড়িত না থাকলে যে যেখানেই আছেন বাইরে সবাই দেখছি হাতজোর করে অত্যন্ত বিনয়সহকারে দাঁড়িয়ে হুজুরের বয়ান শ্রবণ করছেন। আমার মতো আজাইরা আর একজনও পেলাম না যিনি হাতজোর না করে আছেন।
একইসাথে বিব্রত ও দ্বিধাগ্রস্ত আমি কী করবো না করবো বুঝে ওঠতে পারছি না। কিন্তু দেখাদেখি হাতজোর করবো তাও রুচিতে দিচ্ছে না। লোকসমাবেশ থেকে একটু একটু দূরে সরতে থাকলাম। এই সরতে গিয়ে কখন যে কী বেয়াদপি করে বসলাম তা বলতে পারবো না। অনেক বইপত্র দেখে যে কক্ষে ঢুকলাম ওটা লাইব্রেরী। হুজুরের উপর লেখা নিজস্ব প্রকাশনার অনেক অনেক বই আর পীরবাবার বয়ান সমৃদ্ধ অগুনতি ক্যাসেট। কিছু সময় নেড়েচেড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে আরেকটা কক্ষের জানালার কাচে উঁকি মারলাম। মনেই ছিলো না যে বেয়াদপি হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস কোন পাণ্ডাবাবাজীর চোখে পড়িনি। তবে আমার চোখে যা পড়লো, তাতে একটা ফাঁকির মধ্যে পড়ে গেলাম যেন। বিশাল বড়ো ডাইনিং রুম ? ওটাতে রাখা সুদৃশ্য ডাইনিং টেবিল কতোগুলো হবে ? গুনে দেখার ঝুঁকিতে গেলাম না। আগের কথাটাই ভাবছি, এখানে গরীব ধনী উচু নীচু কোন ভেদাভেদ নেই ! বিপজ্জনক হলেও এবার আর কিছুতেই কৌতূহল দমাতে পারছি না। দরবার ভবনের সেই বিশেষ কক্ষটির দিকেই বারান্দাধরে হাঁটা শুরু করলাম কোনধরনের ইতস্তততা না দেখিয়ে। সামনে দিয়ে দরজা পার হয়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে যা দেখলাম, হতবাক হয়ে গেলাম ! আমার চোখ এমন দৃশ্য আগে আর দেখেছে কিনা মনে করতে পারলাম না। বিরাট এক রুমের মধ্যেই একটা কারাগার যেন। বিশাল কলাপসিবল গেটের মতোই একটা গড়াদে রুমটা দুভাগ করা। গড়াদের ভেতরে শতশত ব্রীফকেসের পাহাড় ! পাক কেবলাহুজুরের বিশিষ্ট মুরিদদের সামান্য নজরানার এই নমূনা ! ওগুলোর ভেতরে কী ? গড়াদের পাশেই কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বসে মোটা খেড়োখাতায় কি এসবই পোস্টিং দিচ্ছে ? পাশেই বড়আকৃতির কয়েকটা টুইনওয়ান এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কীসব রেকর্ড হচ্ছে। মনে হচ্ছে হুজুরের বয়ান। ভেতরের দরজার ওপাশেই সম্ভবত কেবলাহুজুরের তাসরিফ। ভাবতে ভাবতে ঘাড়বাঁকা করে দেখতে দেখতে রুমটা পেরিয়ে গেলাম এবং পরমুহূর্তেই থমকে গেলাম। সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে যথারীতি হাঁটুদৈর্ঘ্যের লুঙ্গি আর এক্সারসাইজ গেঞ্জি গায়ে মাথায় কোমড়ে গামছাবাঁধা রক্তচোখা বিশাল ভুড়িধারী পাণ্ডাটি ! ভয় পেয়ে গেলাম। বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে গেলেও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি যে জিজ্ঞেস করলেই বলবো বাথরুম খুঁজছি। আদৌ তা কোনো কাজে আসবে কিনা জানি না। কিন্তু জ্বলজ্বল করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করছে না দেখে আমিও আচমকা পথ ভুল হয়ে গেছে ভাব দেখিয়ে ঘুরে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এক্ষুনি ঘাড়ে বিশাল থাবাটা পড়বে। সে আশঙ্কায় ঘাড়ের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে গেছে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে দমবন্ধের মতো হাঁটছি। খেয়াল হলো, কই না তো, থাবা তো পড়েনি ! পেছন ফিরে দেখি অনেক নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি। যাক বাবা, এবারের মতো রক্ষা পেলাম। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই আমাদের দলটাকে সামনে পেয়ে গেলাম। গাইড চলে এসেছে। চিটাগাং ইউনিভার্সিটির ছাত্রভাইদেরকে দরবার শরীফের এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হবে। আমার সেই দোস্তটি হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ এনে প্রায় নিঃশব্দ কিছু উষ্ণ বাতাস ঢেলে দিলো, দোস্ত, সব ভণ্ডামী !
[০৪]
দরবারের প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে বায়ে মোড় নিয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটছি। কিছুদূর যেতেই সামনে উঁচু অয়ারলেস টাওয়ারটা চোখে পড়লো। পুলিশ ফাঁড়ি। পাশেই সোনালী ব্যাংকের শাখা। আশ্চর্য ! আশেপাশে এ তল্লাটের ধারেকাছে কোন বাড়িঘর বা লোকালয় চোখে পড়ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ব একটা ব্যাংকের ব্রাঞ্চ চলার মতো ফিডার কোথায় ? হঠাৎ মাথার ভেতরে অগুনতি কালো কালো ব্রীফকেসের পাহাড় ভেসে ওঠলো। মনে হলো উত্তরটা হয়তো পেয়ে গেছি। ওগুলো পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে আরো কিছুদূর। একটা সংরক্ষিত খামার এলাকার মতো মনে হলো। গোশালা, ছাগলশালা, মহিষশালা কাগজে লেখা ইত্যাদি সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। যেটাতেই ঢুকছি অনেকগুলো সারিতে গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদির অগনিত সমাবেশ। সব্জির গোডাউন, একেক পদের সব্জির জন্য একেকটা। এগুলোর বিশালতা দেখে চোখে আমার বিস্ময় নাঁচছে। এটা দেশের কেন্দ্রিয় কোন পাইকারী আড়তের সমাহার নয়। একটা দরবার শরীফের সংরক্ষণাগার মূলত। দূরদূরান্ত থেকে আসা মুরিদানদের দেয়া নজরানাগুলো এখানে সাময়িক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ একটা বিদ্যাপিঠের ছাত্রদেরকে দাওয়াত করে এনে এগুলো দেখানোর উদ্দেশ্যটা কী ? এর মাজেজাই বা কোথায় ? সঙ্গিদের বিস্ময় কৌতুহল সবই শুনতে পাচ্ছি। পশুশালার বেড়ার গায়ে নির্ধারিত দূরত্ব পর পর কাগজের উপর হাতে লেখা কিছু সতর্কবাণী টাঙানো। বুঝাই যাচ্ছে এগুলো অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে রাখা। ইহা অলিআউলিয়াগণের স্থান, এইখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ।আটরশির দরবার শরীফ এলাকার মতো এতো বড়ো এলাকা নিয়ে দেশে আর কোন দরবার শরীফ আছে কিনা আমার জানা নেই। যেদিকেই তাকানো যায় বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চাষযোগ্য জমি আর জমি ছড়িয়ে আছে। ওখানে চাষাবাদও হচ্ছে। বিভিন্ন জাতের সব্জি ধান হয়তো মাছও। যারা চাষাবাদগুলো করছে তারা কোনো বণ্টনচুক্তি মেনে তা করছে, না কি স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে আমার জানা নেই। পরিদর্শন সময়ে গাইডকে যে জিজ্ঞেস করবো তা মাথায়ও আসে নি। আসলে প্রাথমিক বিস্ময়গুলোই একেকটা এতো উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠছিলো যে ওইসব মৌলিক চিন্তা সাপ্লাই দেবার মতো মস্তিষ্কটা তখনও হয়তো গড়েই ওঠেনি। একটা জায়গায় এসে আমাদের দরবারী গাইড অঙ্গুলি নির্দেশে এবার যা দেখালেন তাও বিস্ময়ের বৈ কি ! শত শত পাকা করা সিমেণ্টের বড় বড় চূলো, সারি সারি, বিশাল এলাকা জুড়ে ! ব্যাপার ? গাইড এর উত্তর দিলেন। ওরসের সময়ে দেশ বিদেশ থেকে যে লক্ষ লক্ষ মুরিদানের মহসমাবেশ ঘটে, তখনই কেবল এই চূলোগুলো জ্বলে ওঠে। লক্ষ লক্ষ লোকের খাবার তৈরি ! এই মহাযজ্ঞ সামলানো কি যে সে কথা ! বিস্ময়ে থ হয়ে রইলাম আমরা। তাহলে সে অনুযায়ী হাড়ি পাতিল ডেকচি কড়াই বা বাসনপত্রও রয়েছে ! যদিও তা আর দেখা হয়নি। কিছু কল্পনা করার জন্যেও সংরক্ষিত রাখা জরুরি।
হাঁটতে হাঁটতে এলাকাটা রাউণ্ড আপ হয়ে যাচ্ছে হয়তো। দিনের রূপালি আলোয় কখন যে সোনালি রঙ ধরে গেছে। ক্লান্তি যে আমাদের আসতেই পারে সেটা গাইড লোকটি ঠিকই বুঝেছে। যেখানে নিয়ে এলো সেটা দরবার শরীফের কেণ্টিন। হায় হায়, এরকম সুবিধা যে রয়েছে এখানে তা তো আগে জানি না ! অনেক মুরিদানই চা নাস্তা পান বিড়িতে মজে আছে। উপোসীর মতো আমরাও হামলে পড়লাম। দীর্ঘবিরতির পর সিগারেটটা কেবল ধরিয়েছি, সাকুল্যে দুতিনটা টান দিয়েছি হয়তো। হঠাৎ একটা অস্থিরতা কেণ্টিন জুড়ে। হুজুর আসছে হুজুর আসছে। হকচকিয়ে গেলাম। যে যার বিড়ি সিগারেট নিভিয়ে মুখের ভেতরে থাকা পানসুপারি থুক করে ফেলে কুলকুচি করে কেণ্টিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং সংলগ্ন পাকা রাস্তাটার পার্শ্বে জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে পড়ছে ! আমি এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাপের রোজগারের সীমিত টাকায় ধরানো সিগারেট নিভাই কী করে ! সিগারেটটা হাতের মুঠোয় আড়াল করে হাতদুটোকে পিছমোড়া অবস্থায় নিয়ে ক্যাণ্টিনের দরজা থেকেই ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছি, কী হতে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে জমিতে যে লোকগুলো কাজ করছিলো, এরাও দেখি একইভাবে রাস্তার কাছে সরে এসে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে সে আমালের ভয়ঙ্কর কোন সামন্ত জমিদারের রাজত্বে চলে এসেছি। হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটা খোলা জীপ মন্থরগতিতে অতিক্রম করে চলে গেলো। হুডখোলা জীপের পেছনটায় সিংহাসনের মতো বিরাট একটা চেয়ার ধরে দুপাশে দুই পাণ্ডা দাঁড়িয়ে আছে আর চেয়ারটাতে বসে আছেন শুভ্র কেশদাঁড়িমণ্ডিত গৌড়বর্ণের অত্যন্ত সুদর্শন চেহারার বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিটি। তিনিই আটরশির বিখ্যাত হুজুরে পীর বাবা কেবলাজান। এই প্রথম আমি দেখলাম তাঁকে। গুঞ্জন থেকে বুঝলাম নির্মিয়মাণ হাসপাতাল পরিদর্শনে যাচ্ছেন তিনি। তখনই লক্ষ্য করলাম বেশ দূরে নির্মাণাধীন ভবনের স্থাপনা দেখা যাচ্ছে। ওটা একটা আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতাল হবে। পরবর্তীতে ওটা কেমন সুযোগ সুবিধা নিয়ে চালু হয়েছিলো বা এখন এতোগুলো বছর পরে এসে ওটার কী অবস্থা তা আর জানি না। জানার আগ্রহও হয়তো ছিলো না। যেভাবে এটাও জানি না যে, দরবার শরীফের সামনের ডানপাশ ঘেষে তখনো কেবল নির্মাণ প্রস্তুতি নেয়া আরেকটা স্থাপনা পরবর্তীতে কতোটা জাকজমকপূর্ণ মসজিদে রূপ পেয়েছে।
ক্যাণ্টিনের সামনে বিনা ব্যবহারে অর্ধেক পুড়ে যাওয়া সিগারেটটা টানছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, জীপটা নির্মানাধীন হাসপাতালটার কাছে গিয়ে থেমে গেলে পাণ্ডারা ধরাধরি করে চেয়ারটা নামিয়ে নিলো। হুজুর হয়তো এই রাজকীয় চেয়ার ছাড়া কোথাও বসেন না। হঠাৎ ফিক্সড মাইকে একটা বিশেষ ঘোষণা প্রচারিত হতে লাগলো গোটা এলাকা জুড়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রভাইদের জন্য বিশেষভাবে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বার কয়েক ঘোষণাটা দেয়া হলো। তাহলে সর্বসাধারণের জন্য দিনে একবার খাবার তৈরির রীতিটা অলঙ্ঘনীয় কোন বিধান নয় ! নয়তো বিদ্যাপিঠ থেকে আসা দরবার পরিদর্শনকারী এই ছাত্ররা সর্বসাধারণের পর্যায়ের নয় ! তারচে’ একটু ভিন্নতর ? অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করলাম। শুধু বুঝা হলো না, আমরা এই ছাত্ররা হঠাৎ এমন বিশেষ সম্মানের অধিকারী হলাম কী করে।
[০৫]
সন্ধ্যায় সাধারণ দর্শনার্থীদেরকে দর্শন ও দোয়া দেয়া পীরবাবার নিয়মিত রুটিনকাজ। আমরাও যথারীতি লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ লাইন, বহু দর্শনার্থী। বারান্দা হয়ে মাঝে একটি কক্ষ পেরিয়ে তবে মূল দরবার কক্ষ। একটু একটু করে লাইন এগুচ্ছে। এলাকার শত শত মাইকে বাবার বয়ান শুনতে পাচ্ছি আমরা। কত লোক কত সমস্যা নিয়ে বাবার কাছে আসে। কারো ব্যক্তিগত সমস্যা, কারো ধর্মীয় আদর্শগত সমস্যা, কারো রোগশোক ইত্যাদি কতো কিছু। মূল দরবার কক্ষে ঢুকার মুখেই দরজায় ভেতরের দিকে দাঁড়ানো উগ্রমুখি পাণ্ডাটি প্রত্যেক দর্শনার্থীর কাছ থেকে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই নগদ নজরানাগুলো আগেই আদায় করে নিচ্ছে। নজরানা জমা হচ্ছে বাবার পার্শ্বে রক্ষিত একটি বড় পাত্রে। ঢুকার আগে সবাই যার যার হাতে নজরানা বা দর্শনী মুঠোবন্দী করে নিচ্ছে। সময় নষ্ট করার মতো সময় এই আল্লাহওয়ালা জায়গায় নেই বললেই চলে। কক্ষের মৃদু আলোয় বাবা বসে আছেন একটি রাজসিক আরাম কেদারায়। তাঁর শুভ্র পদযুগল সামনেই লাগোয়া একটা জলচৌকির উপর বিছানো। বাবার পেছনে রাজদরবারের বিরাটকায় হাতপাখার মতো একটা চামড় দোলাচ্ছে আরেকজন পাণ্ডা। পাশেই স্ট্যাণ্ডে আটকানো একটা মাইক্রোফোন বাবার মুখের কাছে ফিক্সড করে রাখা। পবিত্র মক্কা মদীনাসহ আরো কী চমৎকার সব সম্ভ্রান্ত চিত্রকর্ম চারদিকের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। উপরে যে ঝলমলে বহুবর্ণিল মণিমুক্তোসদৃশ স্বচ্ছ পাথরখচিত বিরাট ঝালরটা তার সমস্ত অহঙ্কার নিয়ে ঝুলে আছে, আমার দেখা এযাবৎ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সম্ভ্রান্তময় বলেই মনে হয়েছে। অনেকক্ষণ এই ঝালরটার দিকেই চেয়ে থাকলাম। কত দাম হতে পারে এটার ? কোন ধারণাই নেই আমার। লাইনটা কক্ষের ভেতরে ঢুকে একটু গিয়ে তারপর একটা নব্বই ডিগ্রী বাঁক নিয়ে বাবার পাশে দিয়ে এগিয়ে সামনে আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কাউকে কোথাও থামতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে লাইনে স্থির অচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই।
দরজার কাছে পৌঁছতেই দেখি পাণ্ডাটি তুখোড় চিলের মতো দর্শনার্থীদের হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে মেলে ধরা নজরানাগুলো। হঠাৎ কোত্থেকে কী হলো, দেখি আমার সামনের ছাত্রটিকে পাগল পাগল বলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিচ্ছে। কক্ষে একটু অস্থিরতা দেখা গেলো। কী ব্যাপার ? নতুন দর্শনার্থী হিসেবে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় একটা ভয়াবহ বেয়াদপি করে ফেলেছে সে, এটা আর পাণ্ডাটিকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। ঘটনা গুরুতর। নজরানা দিতে বুক পকেট থেকে টাকার নোট বের করতে গিয়ে বিশটাকার নোটের বদলে পঞ্চাশ টাকার নোটটি হাতে ওঠতে না ওঠতে নোটের মালিক নিজে দেখার আগেই পাণ্ডার ছোঁ-এ হাতছাড়া। ‘এটা না এটা না’ বলে ছাত্রটি আর কিছু বলার আগেই পাণ্ডার ধাক্কা, এই পাগল পাগল ! বাইর হ বাইর হ ! যে নোট বাবার পাত্রে জমা হয়ে গেছে তা আবার ফেরৎ নেবে ! বড় সাংঘাতিক কথা ! নজরানা তো জমা হয়েই গেছে, মাঝখান থেকে বেচারাকে ঠেলে বের করে দেয়া হচ্ছে ! খুবই অপমানকর অবস্থা। যাক, আমাদের মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে বিষয়টা শেষপর্যন্ত এতোটা হতাশাজনক খারাপ পরিস্থিতিতে আর গড়ায়নি। তবে আশ্চর্য হলাম, বাবা তাঁর বয়ানেই ব্যস্ত, এদিকে তিন চার হাত দূরে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা বুঝি তিনি জানেনই না !রুমে ঢুকেই যে দৃশ্যটা প্রথমে চোখে পড়লো তাতেই আমার মাথা ঘুলিয়ে গেলো ! আহা, প্রায় সব মুরিদানই বাবার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে জলচৌকিতে বিছিয়ে রাখা বাবার পায়ের তালুতে মুখ নামিয়ে নিবিড় চুমু খেয়ে যাচ্ছে ! তাও কি সম্ভব ! চিন্তার অগম্য এরকম দৃশ্যে আমি মোটেও প্রস্তুত নই। ধর্মীয় বিধানে কী বলে জানি না। তবে কারো পায়ে সরাসরি চুমু খাওয়া ব্যক্তিগত রুচিতে আমার সাংঘাতিক আঘাত করলো। যা বোঝার তা বুঝলাম কিনা জানিনা। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আর বিন্দুমাত্র আগ্রহও রইলো না আমার। আস্তে করে সটকে পড়লাম।
[০৬]
রাতের খাবার সেরে মাদ্রাসায় ফিরে আমার জুতো জোড়াটা কোথাও খুঁজে পেলাম না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ফজরের নামাজ সেরে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে সঙ্গিরা আমার ঘুম ভাঙালেন ফের। এক কাপড়ে গা ঝাড়া মানুষ আমি। ওঠেই বিষন্নতায় ভার হয়ে আসা শরীরটাকে নিয়ে সোজা গাড়িতে চড়ে বসলাম। বিরতিহীন দীর্ঘ এক ফিরতিজার্নি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় আঙিনায় এসে নগ্নপায়ে নামলাম যখন, বন্ধুদের বিস্ময়মাখানো প্রশ্নবোধক দৃষ্টির সপক্ষে নিরুদ্দেশফেরা আমার একটাই উত্তর তখন-হা হা হা ! বেয়াদপি করিলে তকদিরে পোকায় ধরিবে !
(২৯/০৮/২০০৮)