তিনি আমার বাবা
রণদীপম বসু
বিষয়টা কেবল যে অস্বাভাবিক তা-ই নয়, অস্বাভাবিক রকমের অস্বাভাবিক ! কেবল একটা লুঙ্গি পরে উদোম গায়ের পুষ্ট শরীরটাকে একটা চেয়ারের পাটাতনে ঠেকিয়ে এ যাবৎ দেখে আসা অবিচল পাথর স্বভাবের যে মধ্যবয়সী লোকটি হাউমাউ চিৎকারে কাঁদছে আর কপাল চাপড়াচ্ছে, তিনি আমার বাবা ! জীবনে এই একবারই তাঁকে কাঁদতে দেখেছি আমি, তা-ও এরকম অদ্ভুতভাবে ! আর কখনোই নয়। আর আমার গর্ভধারিণী মা তখন শুয়ে আছেন দরজার সামনে মাটিতে পেতে দেয়া শীতল পাটিটাতে, নিথর। আশেপাশের জড়ো হওয়া ভীড়ে কেউ কেউ ফোঁপাচ্ছে, কেউবা থির হয়ে আছে। শৈশব পেরোনো বিস্ফারিত চোখ এতোসব অসংলগ্নতার অর্থ কি আর ধরতে পারে ! ফেলফেল করে মানুষগুলোর অস্বাভাবিকতা দেখছি, বুঝতে পারছি না কিছুই। মৃত্যু বিষয়ক ধারণা আর উপলব্ধিগুলো তখনো বুকে দানা বাঁধতে শুরু করে নি হয়তো।
মায়ের শিয়রের পাশে আমার জীবিত থাকা একমাত্র বড় ভাইটি চোখ দিয়ে দরদর পানি ঢালছে আর মাঝে মাঝে উথলে ওঠা দমকে কী যেন বলে যাচ্ছে, অস্পষ্ট। পাশ থেকে কে যেন আফসোস ঝাড়ছে- আহারে, দিদি মরার আগে শেষবারের মতো দিলীপ দিলীপ করে ডেকে ওঠেছিলো ! কথা শেষ হবার আগেই দিলীপ অর্থাৎ আমার সে বড় ভাই আবার হাউমাউ করে ‘মাগো’ বলে মার বুকে আছড়ে পড়লো। মৃত্যুমুহূর্তে মা’র কাছে থাকতে পারে নি। বালাটের শরণার্থী ক্যাম্পে কোথাও ডাক্তার ঔষধ বা স্যালাইন না পেয়ে উন্মাদের মতো খুঁজতে খুঁজতে কোথায় কোথায় যে গেলো ! শেষ পর্যন্ত ডাক্তার নামের এক ব্যক্তিকে স্যালাইনসহ নিয়ে আসলো ঠিকই, কিন্তু তার আগেই মা চলে গেছেন সবকিছুর উর্ধ্বে। দুপুরে আক্রান্ত হয়ে বিকেলেই শেষ ! জানিনা এই ঘটনাই আমার ভাইটির বুকে ভবিষ্যতে একদিন সংসার ছেড়ে বিবাগি হয়ে যাবার বীজ বুনে দিয়েছিলো কি না। সকালে আক্রান্ত দুপুরে শেষ হয়ে যাওয়া আমার অন্য ভাইটির মৃতদেহ তখনো সৎকার হয়নি। মৃত্যুর আগে ঘোর লাগা চোখে নাকি মা যখন ‘বিলু কই রে’ বলে গোঙাচ্ছিলেন, অদ্ভুত শক্ত মনের বাবা ‘বিলু ভালো আছে’ বলে মাকে সান্ত্বনা জানালেন ঠিকই। কিন্তু ক’দিন আগে যিনি একইভাবে তাঁর আরো দুটো সন্তান হারিয়েছেন, সেই গর্ভধারিণী মায়ের মন কি কিছুই আঁচ করে নি ?
শরণার্থী ক্যাম্পের নোংরা পরিবেশে শনের ছাউনী আর বাঁশের তরজা ঘেরা অসংখ্য সারি সারি দায়সারা গোছের ছোট্ট জোড়াঘরের মধ্যে আশ্রিত হাজার হাজার পরিবারের মতো আমরাও ব্যতিক্রম নই। একদিকে যুদ্ধের দামামায় দেশের ভেতরে ধ্বংস মৃত্যু প্রতিরোধ, আর অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবার ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে লঙ্গরখানা আর রেশনের ভিক্ষালব্ধ খাদ্যনির্ভর এক আশ্রিত জীবনে উন্মুল। এটাই দুঃসহ বাস্তবতা। এখানে ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু কি থাকে ? চারদিকে পচা গলা মানব-পশুর বিষ্ঠার দুর্গন্ধময় বাতাস আর পঙ্গপালের মতো মনুষ্য-চেহারার হাজারে হাজারে দুপেয়ে প্রাণীর যথেচ্ছ বিচরণ। কিসের সম্ভ্রান্ত আর কিসের ছোটলোক ; সব একাকার। একেই বলে শরণার্থী শিবির। মৃত্যু এখানে গলাগলি করে হাঁটা অতিপরিচিত স্বজন যেনো। এটাই একাত্তর ! যেনো মৃত্যুর উৎসব ! এক অন্যরকম বাস্তবতা।জোর করে চৌত্রিশ বছর আগের ফ্লাশব্যাক থামিয়ে দিলাম। কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না, এই কি আমার সেই বাবা ! সরকারি হাসপাতালের ছোট্ট মলিন কেবিনের ধবধবে বেডে গুটিশুটি মারা চুরাশি বছরের ছোট্টখাট্ট শরীরটা দেখলে কে বলবে রাজপুত্তুরে চেহারার দশাসই শরীরধারী এক ঝলমলে অতীতের ক্ষয়ে যাওয়া করুণ ইতিহাস শুয়ে আছে এখানে ! আহা সময় ! তবু, নদী মরলেও নাকি সিকস্তি থেকে যায়।
প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত ভাঙা শরীরে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় ও চূড়ান্তবারের অপারেশনের আগে আত্মীয় পরিজন যখন অসহনীয় টেনশনে কীভাবে রুগীকে ‘ওটি’-তে পাঠাবেন ভেবে ভেবে নিজেরাই একেকজন রুগী হয়ে যাচ্ছেন, ওটি-তে যাওয়ার আগ মুহূর্তে দেখা গেলো নির্জন কেবিনের অপেক্ষমান রুগীটি নেই ! কোথাও নেই ! একেবারে লাপাত্তা ! কই গেলো কই গেলো রব তোলে হুড়াহুড়ি করে সবাই ছুটলো ডাক্তার আর ওটি’র দিকে।
সা সা বাতাস কেটে গাড়িটা জীবনের মতোই গন্তব্যের দিকে ছুটছে তীব্র। ধাবমান অপেক্ষা আর অস্থিরতা যুগপৎ তাড়িয়ে নিচ্ছে আমাকে পেছনে হটে যাওয়া অপসৃয়মান ধুসর প্রকৃতির মতোই। আসলে প্রকৃতির নিজস্ব কোন রঙ নেই। মানুষের অন্তর্গত আপেক্ষিক দৃষ্টিই প্রকৃতিকে রঙিন বা রঙহীন করে তোলে। কতক্ষণে পৌঁছবো গন্তব্যে ? চেপে ধরা হাতের মোবাইলটা উৎকণ্ঠায় বেজে ওঠলো আবার।
যে জটিল নৈরাশ্যময় অবস্থায় মানুষ অপারেশন টেবিলে ব্যবচ্ছিন্ন হওয়ার আগে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তাবাচক কাতরতায় কনফেশন আক্রান্ত হয়ে ওঠে, সে রকম অবস্থায়ও কাউকে কিছু না বলে বা বলার সুযোগ না দিয়ে সবার অগোচরে ক্যাথেটারটা হাতে ঝুলিয়ে গটগট করে একবারও পেছন না ফিরে যিনি নির্বিকার অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যান, তিনিই কি আমার বাবা ! বাইরের উৎকণ্ঠিত স্বজনদেরকে কিছুই কি বলার ছিলো না তাঁর ! এ কি তাঁর প্রচণ্ড মনোবল, না কি দুর্লঙ্ঘ্য অভিমান ?
সন্তান ছুটছে তার শেকড়ের দিকে। ওই কি বাসস্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে ? গন্তব্য......হাসপাতাল.. ,আর বহুদিন পরে ফেরা সাক্ষী শহরের প্রিয় প্রিয় চেহারাগুলো কোথায় ! সদ্য গর্ভযন্ত্রণায় ভেতরে মোচড়ে ওঠে প্রাচীন সেই অক্ষরমালা.../ মল্লিকপুর নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সায়
হাছন নগর হয়ে সদর হাসপাতাল
খুব একটা দূরে তো নয়-
বৃদ্ধ ক্লান্ত পিতা শুয়ে আছেন রোগ শয্যায়
চার নম্বর কেবিনের বেডে অবসন্ন একা।
হয়তো পরিজন বেষ্ঠিত
তবু জীবনের খাতায় নিঃসঙ্গ একাই ;
অনিবার্য বার্ধক্য মানুষকে এমন একা করে দেয় !
কৈশোরের পুরনো রাস্তা
রিক্সায় সওয়ারী আমি ছুটে চলি দিগবিদিক
পুরানো বাসস্ট্যান্ড ফেলে ট্রাফিক পয়েণ্ট ঘুরে
সোজা পথ চলে গেছে পাবলিক লাইব্রেরী হয়ে।
ভীষণ ব্যস্ত শহর, তবু
মনে হয় শীতের সুরমার নিস্তরঙ্গ বুকের মতোই কী যেনো হারিয়ে গেছে
সুউচ্চ দালান আর মার্কেটের ভীড়ে।
হারিয়েছে এ শহর মায়াময় শৈশব আর
দুরন্ত কৈশোর তার-
শহিদ মিনার আগের মতোই শুধু
স্মৃতিময় কদম আর কৃষ্ণচূড়া নেই-
পাশে পুরনো বালুর মাঠ এখন
ঝলমলে বিশাল পৌর বিপণী বিতান।
অতীতের চেনা চেনা মুখ বড়োই অচেনা ঠেকে আজ,
তুখোড় যে যুবকেরা একদিন হৈ হৈ মাতাতো শহর
এদিক ওদিক দেখি
কেমোন ন্যুব্জ আর ঘোলাটে দৃষ্টিতে খোঁজে
পুরনো স্বাক্ষর যতো
হয়তো বা যা কিছুই অন্যের দখলে সবি ;
আহা, দিন বদলের কষ্ট খণ্ডাতে পারে না কেউ !
বদলে গেছে কত কিছুই, রাস্তা-ঘাট-পুকুর-মাঠ
ছোট্ট শহরে এতো পরস্পর পরিচিত মুখ
সুখে দুখে হয়ে যেতো সবাই সবার
সে সবই বদলে গেছে
বদলে গেছে সময়েরা প্রজন্মের প্রজন্মের পর
বদলে গেছে প্রিয়তম শহর আমার।
রুগ্ন পিতা শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে,
উকিল পাড়া বাঁয়ে রেখে তাড়াহুড়ো গন্তব্য আমার
চমকে ওঠি তীব্রতায়- আকস্মিক ব্রেকের শব্দ !
হৈ হৈ করে ছুটে আসে পুরনো বন্ধু জমির
স্কুলের সহপাঠি এক কালের তুখোড় প্লেয়ার
স্বভাবটা তেমনি আছে এতোকাল পর।
হুড়হাড় কথার ফাঁকে চেয়ে থাকি অপলক
দুদিনের না কামানো দাড়ি ধবধবে সাদা আর
বয়েসটা ঝুলে আছে চামড়ার ভাঁজে,
ওটা কি আমারই বিম্ব তবে ! হায়
আর যারা সহপাঠি কে কোথায় আজ ?
বিপণ্ন প্রশ্নগুলো নিরুত্তর কথা হয়ে
জীবন্ত আয়নায় খোঁজে আপন আপন মুখ।
হাসপাতালে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ পিতা
অবসন্ন একা
আপাতত ওটাই গন্তব্য আমার
এবং একদিন আমাদের সবার... #
(২৯/০৯/২০০৫)
[গন্তব্য/ অদৃশ্য বাতিঘর/ রণদীপম বসু]