উল্টোস্রোতের কূল-ঠিকানা-প্রসঙ্গ: ক্ষুধা
রণদীপম বসু
ক্যাপশনটা ছিলো- ‘ক্ষুধা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা।’ পত্রিকা বা ম্যাগাজিনই হবে, কোথায় যেন একবার একটা ফটোগ্রাফিক্স দেখেছিলাম। ভিন্ন ভাষাভাষি কয়েকটি দেশের কয়েকজন ক্ষুধার্ত মানুষের এমন কিছু ছবি পাশাপাশি সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। ওখানে মুদ্রিত বা লিখিত কোন বক্তব্য ছিলো না। শুধু উপজীব্য ছবিগুলোতে ব্যক্তিক অভিব্যক্তির যে মানবিক প্রকাশ ঘটেছিলো, ছবিগুলোর দিকে একটিবার হৃদয়জ দৃষ্টি ফেললেই তিনি শিক্ষিত অশিক্ষিত পণ্ডিত মূর্খ বা যে ভাষাভাষিরই হোন না কেন, যে কেউ নিমেষেই বুঝে যান- এগুলো ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি! আর তাই হয়তো খুব সঙ্গতভাবে ছবির ক্যাপশনটা মনে গেঁথে রইলো।
অঞ্চলভেদে মানুষের সমাজ সংস্কৃতি চাহিদার ভিন্নতায় আবেগ প্রকাশের শরীরগত ভাষা-ভঙ্গিও ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা বুঝা না-বুঝা নির্ভর করে ব্যক্তির অবস্থানগত অভিজ্ঞতা থেকে শিখে নেয়ার মানদণ্ডের উপর। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মৌখিক বক্তব্যে অস্পষ্টতা থাকলেও কথা বলতে গিয়ে আমরা জান্তে অজান্তে যে স্বতঃস্ফূর্ত বডি ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার করে থাকি, অভিজ্ঞ চোখ তা থেকেই বক্তব্যের মর্ম অনুধাবন করে নেয়। এমন কি দেখে দেখে অভ্যস্ত একটা শিশুও তার পিতার রাগান্বিত চোখের ভাষা অনায়াসে বুঝে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু এসব আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে প্রকৃতিগতভাবেই তারতম্য হয়ে থাকে। সমাজ সংস্কৃতিভেদেও এসব ইঙ্গিতময়তার পার্থক্য ঘটতে পারে। ভালোবাসার প্রকাশ, বাৎসল্যের প্রকাশ, শ্রদ্ধার প্রকাশ বা ঘৃণার প্রকাশে এসব পার্থক্য ঘটতে পারে। ব্যক্তিক রুচির তারতম্যেও আবেগ প্রকাশের ভিন্নতা আমরা সচরাচর লক্ষ্য করে থাকি। এ সবই ব্যক্তির শারীরিক অঙ্গভঙ্গির সচল প্রকাশের কারণেই তা বোধগম্য হয়ে ওঠে।
আর যেসব অনুভব মানুষের শারীরিক কোন অঙ্গভঙ্গিতে প্রকাশ পায় না? ব্যক্তির অবয়বেই তা অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে। সময় ও ব্যক্তি নিরপেক্ষ এই অভিব্যক্তির প্রকাশ ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। এ কেবলই এক চিরায়ত মানবিক আবেদনময়ী ভাষা; যার কোন দেশ কালের সীমানা নেই, সমাজ সংস্কৃতির দায়বদ্ধতা নেই, খেয়াল খুশির স্বাধীনতাও নেই! আকার ইঙ্গিতহীন প্রকৃতিদত্ত এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাষাকেই আমরা আন্তর্জাতিক ভাষা বলতে পারি। আর তাই ক্ষুধা অবশ্যই একটি আন্তর্জাতিক ভাষা, যার বিক্ষত বুক জুড়ে বঞ্চিত মানবতার অপরিমেয় কষ্ট আর অভিশাপ স্বচ্ছ আয়না হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে।
বোধসম্পন্ন দৃষ্টি দিয়ে দেখলে শুধু মানুষ নয়, যে কোন প্রাণীর জন্যেই হয়তো এ অভিব্যক্তির অভিন্নতা জগতের একমাত্র ভাষা হয়ে যায় তখন। যদি বলি ক্ষুধা এক অভিন্ন ভাষার নাম, ভুল হবে কি? ক্ষুৎপীড়িত মানবসত্ত্বার ক্ষুধা নিবারণের অধিকার তাই দেশে দেশে কালে কালে মানুষের প্রধানতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে।
আমরা কি অনিবার্য এই অধিকারকে যথাযোগ্যভাবে সংরক্ষণ করতে পারছি?- মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
রণদীপম বসু, ঢাকা, বাংলাদেশ